শোকের বিগ্রহ
The Words of Grief: শোক যখন পিছু নেয়, মানুষ সামাল দেয় কীভাবে, সমবেত উদযাপনের মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই কিছুটা ভারলাঘব হয়।
বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট শেষ হলো। মানুষকে চিরপ্রতারণা করা শাসক যেভাবে ভোট শেষ করতে চায়, সেভাবেই হলো। চোখের জলে, তাজা লাশে। ক'দিন ধরে নানা মাধ্যমে ওই লাশের পরিবারভুক্তদের মুখগুলি দেখছিলাম। শৈশব থেকেই জানি রক্তেভেজা গ্রামের শোকের ছবি নির্দিষ্ট সময় বাদে বাদে আসবে। এই শোকের ছবির বাজারমূল্য দিন দশেকের জন্য ভালো। দু'দিন পরেই ফোকাস শিফট হয়ে যাবে মানুষের, খোঁজ চলবে অন্য কোনও শোকসন্তপ্ত ছবির। এই একটা যাওয়া আর একটা আসার মধ্যবর্তী সময়ে আমার মনে যে প্রশ্নটা আটকে থাকে, তা হলো, শোক আদতে কেমন দেখতে? আজ প্রথম নয়, প্রশ্নটা দানা বাঁধছিল বেশ কয়েক দিন। সেই যেদিন করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পুত্রহারা পিতা লাশের স্তূপে ঘুরে ঘুরে সন্তানের মৃতদেহ শণাক্ত করছিলেন,সেদিন থেকে। মিডিয়াকে দেওয়ার মতো যুৎসই উত্তর সে সময় তার জানা ছিল না। 'ছেলেকে পেলেন?' প্রশ্নের উত্তরে তিনি ঘোলাটে চোখে চেয়ে বলছিলেন, 'ঢুন্ডনেসে নেহি মিলতা'। খুঁজলে জনমভর মেলে না। যে চলে গেছে, সে চলে গেছে সব সুতো ছিন্ন করে। আমি এই পিতার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এই তবে শোকের ছবি, ভ্যাবলা, ভূতে ধরা, কথাহারা। জানি এটাই একমাত্র ছবি নয়, সন্তাপের দৃশ্যায়ন সময় বা সমষ্টির আয়তন ভেদে, ঘটনার অভিঘাত অনুযায়ী শোকের চেহারা বদলে বদলে যায়। কিন্তু তার বদলে যাওয়া মুখচ্ছবিটাই বা কেমন, কেউ কখনও তাকিয়ে দেখেছে? তার মধ্যে কতটুকু পারফরমেন্স, কতটা নিঃসীম শূন্যতা থেকে উঠে আসা বিলাপ? কতটুকু বিক্রয়যোগ্য, কতটা পড়ে থাকে রাস্তায় পড়ে থাকা হাওয়াই চটির একটা পাটির মতো, একা?
মনে পড়ল ২০১৩ সালের একটা দুপুরের কথা। চাকরির অনিশ্চয়তা আর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আফিমে বুঁদ আমি একদিন দেখা করি অমর পালের সঙ্গে। তিনি থাকতেন কুঁদঘাট এলাকায়। অর্বাচীন আমায় তিনি সেই দুপুরে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। মুখোমুখি বসে একের পর এক গান শুনিয়েছিলেন। অহেতুক প্রশ্নমালার উত্তরও দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল, কেন তিনি গানের জগতে এলেন? অমর পাল সেদিন বলেছিলেন,
"কলকাতায় প্রথম আসি ১৯৩৪ নাগাদ। বড়বাজার এলাকায় থাকতাম। একদিন বারান্দায় বসে আছি হঠাৎ মনে হলো দূরে একদল মেয়ে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। নিরঞ্জনদাকে জিজ্ঞেস করলাম কারা গান গাইছে। নিরঞ্জনদা বলল কেউ মারা গেছে, সেই মরদেহর সঙ্গে একদল মেয়ে সুর করে কাঁদতে কাঁদতে জগন্নাথ ঘাটে যাচ্ছে। তখন বুঝলাম বাঙালি মেয়ের কান্নায়ও সুর আছে।"
অমর পাল নেই। এত বছর পরে আজ সুরেলা শোক কথাটার দিকে তাকিয়ে বসে আছি। কোনও কোনও শোকে মেয়েরা কাঁদে সুরে, সমবেতভাবে। যে সেই শোকে অংশ নিচ্ছে না, তার দল থেকে নামকাটা পড়ে। ছোটবেলায় দেখেছি, পাড়ার কোনও মেয়ের বিয়ে হলে আমার মা, জেঠিমা, বিকেলে শাড়ি পরে তাদের বাড়ি যেতেন। সেই মেয়ে বিদায় নিলে চোখ ভিজিয়ে বাড়ি ফিরতেন। যে চলে গেল, সেই মেয়েটি কি তার প্রাণপ্রিয় ছিল, হয়তো নয়। যদি শোক হয়েও থাকে, তবে নিভৃতে দু'ফোঁটা চোখের জল কি ফেলা যেত না তার জন্য? বাঙালি মেয়েদের, বাঙালি বলছি কেন, ধরাধামের কোনও মেয়েরই নিজস্ব সময় সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। তাদের কৌম গোপনীয় এক জগত। দূর থেকে মনে হয়, এই কৌম থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, উপড়ে ফেলা হচ্ছে তাকে- সেই শোকেই সমবেত হয়ে বিকেলের হাওয়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদত আমাদের মা-জেঠিমারা। কৌমের ক্রন্দনে ব্যক্তিগত নিভৃত শোকের জন্যে এতটুকুও ফাঁকফোকর ছিল না, বরং কড়া নজরদারি ছিল, চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফেরা মহিলারা আলোচনা করতেন, অমুক বাড়ির ছোট বউয়ের বড্ড দেমাক, আসেনি! শোকের হাজিরাখাতা! অশ্রুফোঁটার রাজনীতি! কী বলব একে!
আরও পড়ুন- পথ বেঁধে দিল…
অবশ্য এর মধ্যে কেবল আবেগের তালে তালে ওঠাপড়া আর সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির জীবন বাধ্যতামূলক ভাবে বাঁচা মেয়েদের সঙ্ঘবদ্ধতা ছাড়া অন্য কোনও দেনাপাওনা ছিল না। তবে দেনাপাওনার কান্নাও যে থাকে, তা জেনেছিলাম দূরদর্শনে রুদালি দেখে। রুদালিরা রাজস্থান থেকে শোকের খেলনাপাহাড় বুকে বাংলা রাজপথে নেমে এসেছে মেয়েরা, প্রমাণ আমায় বলা অমর পালের ওই কথাগুলি।
সম্প্রতি প্রিয়জন পড়ে শোনালেন নাইয়ার মাসুদের গল্প-বাই'স মৌরনার্স । এক বাইজীর ঠাঁই হয়েছে নবাবের খাসমহলে। ভালবাসার ঋতু একদিন ফুরল। নবাব চলে গেলে মহল ছেড়ে। চাকর খানসামা সব রয়েছে, শুধু ভালোবাসার মানুষ নেই। শোকে-অসুখে বাইজীর মৃত্যু হলো একদিন, লখনউর পুরনো মহল্লা থেকে রিকশায় করে তাকে শেষ দেখা দেখতে এলেন বাইজীরা। সারাদিন মৃতার দেহ ঘিরে তারা কাঁদলেন উপুড় হয়ে। যাওয়ার সময় একে একে সব গয়না খুলে নিল তারা। সামান্য বস্ত্রটুকু বাদে মৃতার গায়ে আর কিছুই রইল না। এসবই জানলা দিয়ে দেখছিলেন কথক। গল্পের শেষে সেই কথক দেখলেন, বহুদিন পরে নবাব এসেছে সেই খাসমহলে। প্রেমিকার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ নীরবে। আমরা তিন ধরনের শোকের বিগ্রহের সামনে দাঁড়ালাম। একাকিত্বের শোক যা মানুষকে ভিতর থেকে খেয়ে ফেলে, গালে গ্রিলের দাগ বসে যায় অপেক্ষায় অপেক্ষায়। দেখলাম শোকের সমবেত পারফরমেন্স যার সঙ্গে সংস্কার জুড়ে থাকে। দুঃখও কি থাকে না? হয়তো থাকে, কিন্তু দুঃখীজন আত্মজ্ঞান হারান না, বাড়ি ফেরার পথে মৃতার গয়না খুলে নেন। আর দেখলাম, অনুতপ্তের নির্জনতম শোক। ল্যাডলীদার (ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়) সুবলখ্যাপাকে নিয়ে তৈরি করা ছবিতে দেখেছিলাম শোকসন্তপ্ত বাউলসমাজ সুরে সুরে সমাধিস্ত করছেন প্রিয় গুরুকে। ইহদেহ যেদিন যায়, সুর কি সেদিন স্বজন বন্ধুর শোককে শরীরের বন্ধন ছাড়িয়ে আকাশের দিকে নিয়ে যায়? বাউলসমাজ নিশ্চয়ই এর উত্তর জানে।
শোক যখন পিছু নেয়, মানুষ সামাল দেয় কী ভাবে, সমবেত উদযাপনের মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই কিছুটা ভারলাঘব হয়। কিন্তু তারপর! যখন একা থাকতে হবে, শোক যদি আয়নায় এসে হানা দেয়! কী ভাবে তার মুখোমুখি হব! করমণ্ডল ঘটনা পরের দিন ঘোলাটে চোখের সেই পিতৃহারা বাবাকে দেখে আমার মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের কথা। জীবনে বারবার শোকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি অবিচল। শোকের সামনে মগ্নমৈনাক। স্নেহের শমীন্দ্রনাথের মৃতদেহ ঘিরে মুঙ্গেরে সকলে বিলাপ করছে, রবীন্দ্রনাথ অন্য ঘরে ধ্যানরত। এই শোকমুহূর্ত অতিক্রমের শিক্ষা সম্ভবত তিনি তাঁর বাবার থেকেই পেয়ে থাকবেন। পরে জগদীশ বসুকে তিনি চিঠিতে লেখেন, "আমাদের চারদিকে এত দুঃখ, এত অভাব, এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের সুখ লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষ রূপ দুর্ভাগ্য কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জা বোধ হয়।" অর্থাৎ বড় দুঃখে নিজেকে ভুলিয়ে দিয়ে ক্ষুদ্র দুঃখটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ। একই সঙ্গে নিজেকে প্রবল পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গোরার কিস্তি জমা দিচ্ছেন। মাঘোৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শ্রমনিবিড়তা আর দৃষ্টিপ্রসারণ- শোক নামক দৈত্য কি এতে পরাভূত হয়? আশ্বিনের রাতে সে ফেরে নাকি ভূতের মতো পা টিপে? না হলে রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেটে শমীন্দ্রনাথকে ডাকবেন কেন? একই ঘটনা নজরুল ইসলামের জীবনেও ঘটেছে। পুত্রশোক থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে কাজের সাগরে ডুব দিয়েছেন। কিন্তু অন্তরের নিকষ আঁধারে রয়ে গেছে প্রিয়মুখ৷ ঝুঁকে পড়েছেন অতীন্দ্রিয়তার দিক। তাঁর গুরু বরদাচরণ মজুমদার সম্পর্কে বন্ধুরা সন্দেহ প্রকাশ করলে, নজরুল বলেছেন, বরদাচরণের সৌজন্যে তিনি বুলবুলকে দু'বার দেখেছেন। শোক অনেকটা ভ্যাম্পায়ারের মতো। ক্রমে রক্ত চুষে খায়, সন্তপ্তকে সে ভুলপথে চালনা করে অবিরাম। দিশেহারাজন পরিত্রাণ খোঁজে, সহমর্মীজনের থেকে ঋতুপারাপারের আলো চায়।
এই লেখা যখন লিখছি, যখন শোক নিয়ে ভাবছি, তখন হঠাৎই এক অচেনাজনের মেসেজ পেলাম। তিনি লিখছেন, তাঁর বাবা হাসপাতালে ভর্তি। ক্যানসার আক্রান্ত। ডাক্তার বলছেন, এবার মন প্রস্তুত করতে। তিনি চান, তাঁর বাবাকে একটু ফলের রস খাওয়াতে। কিন্তু ডাক্তার না করছে। তিনি মধ্যরাতে বিশদে সব জানিয়ে বলেন, আমার বাবাকে নিয়ে লেখা সাম্প্রতিক একটি টুকরো গদ্য তিনি ঘুরেফিরে পড়েন। তিনি চান, আমি ওঁর বাবাকে নিয়ে দু'কথা লিখি৷ ওঁকে আমি কী বলব! অক্ষর কি দুঃখহরা! লিখলে অসুখ সেরে যাবে! যদি যেত! শোক চাইছে অক্ষর। অক্ষর আর শোক দুইই মসিকৃষ্ণ, অশ্রুজলরেখা শুষে জেগে থাকে। আমি অক্ষরের অভিশাপ সরিয়েই যদি এই মানুষটার শোকের পাশে দু'দণ্ড বসতে পারতাম, যদি আয়ুরেখা দিতে পারতাম ওঁর মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে, দিতাম। শোকই তা হতে দেবে না, লেখার মতোই সে। ঘাতক।