বাজারের পাশাপাশি আড্ডার ঠেক, যেভাবে গড়ে উঠেছিল বাঙালির প্রিয় মল সিটি সেন্টার

City Centre, Kolkata: এই মলটির ডিজাইনের জন্য হর্ষ ছোটেন বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি চার্লস কোরিয়া সাহেবের কাছে। হর্ষের কথায়, “তখন তিনি ইন্ডিয়ার মোস্ট সেলিব্রেটেড আর্কিটেক্ট।” বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি।

কলকাতা তখনও পুরনো শহরের মোড়ক ছেড়ে এই ভাবে বেরিয়ে আসেনি। তখনও শহরের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠেনি কাচ-ঘেরা বিপণী, মল। তবে পশ্চিমি হাওয়া এ শহরের বুকে এসে লাগতে চলেছে ঠিকই। সেই সময় কলকাতা শহর পেয়েছিল এক অন্যরকম স্বপ্নবাজার, যার নাম সিটি সেন্টার। শহরের মধ্যমণি হয়েই আজও সল্টলেকের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই প্রিয় শপিং কমপ্লেক্স।

কলকাতা শহর প্রথম মল পেয়েছিল ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সাহেব রবার্ট লেডলের হাত ধরে। তিনি ছিলেন পোশাক ব্যবসায়ী। সেই ব্যবসার স্বপ্ন থেকেই ধর্মতলার বুকে তিনি তৈরি করেছিলেন এক পেল্লাই ভবন, যা তখন খ্যাত হয় হোয়াইট লেইডল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হিসেবে। পরে অবশ্য চৌরঙ্গী রোডে মেট্রোপলিটন বিল্ডিং নামেই খ্যাত হয় সেই স্থাপত্যটি। তবে কলকাতার মলের ইতিহাসে খাতা খুলে দিয়েছিল সেই ভবনটি।

তবে বাংলার বিখ্যাত শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া টেন্ডারে পেয়েছিলেন সল্ট লেকের বুকের ওই জমিটি। যেখানে শপিং মল তৈরি করার বরাত পান তিনি। ২০০৩ সালে উদ্বোধন হয় কলকাতা শহরের প্রথম মল ফোরাম কোর্টইয়ার্ডের। তার ঠিক এক বছরের মাথায় কলকাতা শহরের বুকে আত্মপ্রকাশ করবে তাদের প্রিয় কেনাকাটা, আড্ডার ঠিকানা সিটি সেন্টার। এই মলটির ডিজাইনের জন্য হর্ষ ছোটেন বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি চার্লস কোরিয়া সাহেবের কাছে। হর্ষের কথায়, “তখন তিনি ইন্ডিয়ার মোস্ট সেলিব্রেটেড আর্কিটেক্ট।” বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি। ততদিনে রয়াল ইন্সটিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস তাকে রয়্যাল গোল্ড মেডেল ফর আর্কিটেকচার পুরস্কারে ভূষিত করেছে। ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছেন পদ্মশ্রীও। তাঁর কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল তাঁর সংবেদনশীলতা। শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্থাপত্য তৈরি করতে পছন্দ করতেন তিনি। আহমেদাবাদের সবরমতি আশ্রমে মহাত্মা গান্ধি মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, মুম্বাই-এর কাঞ্চজঙ্ঘা অ্যাপার্টমেন্ট, জয়পুরের জওহর কালা কেন্দ্র, কেরালার পারুমালা চার্চ, মধ্যপ্রদেশ বিধানসবা ভবনের নকশা থেকে শুরু করে নয়া দিল্লিতে ন্যাশনাল ক্র্যাফটস মিউজিয়ামের মতো একাধিক স্থাপত্য তৈরি হয়েছে তাঁর হাতেই। সেই চার্লস কোরিয়া সাহেবের হাতের কাজের একটি নিদর্শন এই শহরের বুকেও থেকে যাক, এমন ইচ্ছা বহুদিন ধরেই ছিল হর্ষের।

আরও পড়ুন: অনলাইন শপিং না গড়িয়াহাট? কলকাতা বাঁচে কীসে?

সেই সুপ্ত বাসনা থেকেই টেন্ডারটি পাওয়ার পরেই চার্লস কোরিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। কিন্তু প্রথমেই সমস্ত প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন কোরিয়া সাহেব। জানিয়ে দিলেন, এই কাজে তাঁর আগ্রহ নেই। এমনকী শপিং কমপ্লেক্সের ধারণাতেই তিনি বিশ্বাস করেন না। ততদিনে পশ্চিমের শহরগুলিতে শপিং কমপ্লেক্স, মলের ছড়াছড়ি। হর্ষ জানালেন, “আসলে ওঁর আইডিয়া কনটেম্পরারি হলেও ভারতীয়সংস্কৃতির গভীরে শিকড় প্রোথিত ছিল। এক রকম নিরাশ হয়েই চলে আসি ওঁর কাছ থেকে।” তবে হাল ছাড়লেন না হর্ষ। সব মিলিয়ে অন্তত তিন বার এই প্রজেক্টটি নিয়ে কোরিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। অবশেষে রাজি হলেন তিনি। সে সময় তিনি বেশ ব্যস্ত। ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-তে পড়ানোর জন্য বেশিরভাগ সময়টাই বিদেশে থাকেন। ফলে দেশে কার্যত থাকাই হয় না তাঁর। ফলে এই প্রজেক্টটিতে তাঁর নিজস্ব যে দল, তারাই বেশিরভাগটা দেখেছিল।

যাই হোক, নকশা ততদিনে হাতে। শিল্যান্যাসের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গিয়েছে। তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি আসবেন শিল্যান্যাসে। হর্ষ জানালেন, “কোরিয়া সাহেবকে বারবার অনুরোধ জানাই, সেই অনুষ্ঠানে থাকার জন্য। সৌভাগ্যবশত তিনি তখন এ দেশেই। এলেন শিল্যান্যাস অনুষ্ঠানে। ততদিনে সিটি সেন্টারের মডেল তৈরি। প্রায় সমস্ত কাগজে সেই অনুষ্ঠানের ছবি-খবর বেরিয়ে গিয়েছে। এমন সময় কোরিয়া সাহেব জানান, তিনি দেখা করতে চান, এবং সেটা ওই দিন রাতেই। পরের দিন বিকেলে তাঁর ফ্লাইট, বেরিয়ে যাবেন তিনি।” সে রাতে অফিসেই কোরিয়া সাহেবের সঙ্গে বৈঠক হল। দেখা মাত্র, মলের প্ল্যানের নকশা ছিঁড়ে দিলেন কোরিয়া সাহেব। বললেন,“না না, আমার ভুল হয়েছে। এই নকশা আমার পছন্দ নয়, এমনটা আমি চাই না।” হর্ষ-সহ গোটা দলের তখন মাথায় হাত। ততক্ষণে প্ল্যান সাংশনের জন্য চলে গিয়েছে। শিল্যান্যাস হয়ে গিয়েছে, মডেলও তৈরি। কোরিয়া সাহেব জানালেন, তিনি দেশে এসে কলকাতার আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন, নিউ মার্কেট ঘুরে দেখেছেন। দেখে বুঝেছেন, বাজারের মতো মল করতে হবে। অথচ মানুষ তখন চাইছে পশ্চিমি আদবকায়দায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাচ-ঘেরা মল, যেখানে এক ছাদের তলায় সব কিছু মিলবে। হর্ষের কথায়, “এদিকে ততদিনে সব জায়গায় কোরিয়া সাহেবের নাম ছড়িয়ে গিয়েছে। ওঁকে বাদ দিতে মনও চাইছে না। খুব উদ্বেগে পড়লাম। বুঝলাম আর্থিক ভাবে বিরাট ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ব। কারণ দোকানদার যাঁরা, তাঁরাও এমন বাজারের মতো মল চাইছে না।”

সম্পূর্ণ এপিসোডের লিঙ্ক:

বরাবরই মানুষের জন্য ভাবনাচিন্তার ছোঁয়াচ থেকেছে হর্ষের প্রতিটা কাজে। তাঁর তৈরি মলে মানুষ আসছেন, অথচ খাবার পাচ্ছেন না, এই ব্যাপারটা মানতে পারেননি তিনি। বাঙালির আড্ডায় অন্তত একটা চায়ের দোকান না থাকলে চলে নাকি। হর্ষ তখন সকালের দিকে হাঁটতে যেতেন বলবন্ত সিং ধাবার দিকে। তাঁর অন্যতম পছন্দের ফুড ডেস্টিনেশন ছিল সেটি। তড়িঘড়ি বলবন্ত সিংকে খবর দেন, অনুরোধ করেন একটি অন্তত চায়ের দোকান খুলতে তাঁর সদ্য উদ্বোধন হওয়া মলে। কিন্তু বলবন্ত জানিয়ে দেন, তাঁরা এ ভাবে অন্য কোথাও বিপণী খুলতে পারবেন না। কোনও মতে কয়েকজনকে জোগাড় করে চা বানানোর বরাত দিয়ে সিটি সেন্টারে বসিয়ে দেন হর্ষ। ওভারনাইট তৈরি হল টি জংশন।

যা আজও তরুণ প্রজন্মের অন্যতম এক পছন্দের ফুড স্টপ। তখন অবশ্য মিলত শুধুমাত্র ভাঁড়ে চা আর গরম গরম সিঙাড়া। সেই টি জংশন দিনে দিনে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেল যে আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না। বর্তমানে সিটি সেন্টারে বিরাট ফুড কোর্ট, দশ-বারোটা রেস্তরাঁ সত্ত্বেও টি জংশনের বাজার কিন্তু পড়েনি। এখনও সমানতালে গ্রাহকেরা ভিড় করেন সেই ফুড-স্টপে।

আরও পড়ুন:উদ্বোধন করতে এসেছিলেন নেতাজি, সব ঐতিহ্য মুছে ‘মিত্রা’ সিনেমা হল এখন শপিং মল

ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন বিপণী এসে ভিড় জমাতে লাগল সিটি সেন্টারে। দেখতে দেখতে একটা দোকানও খালি রইল না আর। প্রায় ৫০,৪০০ বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে তৈরি এই শপিং কমপ্লেক্সে কলকাতার একাধিক বড় ব্র্যান্ডের দোকান রয়েছে আজ। কেনাকাটা করতে তো বটেই, তার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, গল্প করতেও অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান এই তল্লাটে। হর্ষের কথায়, সাধারণত দোকান দেখে গ্রাহকেরা ভিড় জমান। সিটি সেন্টারের গল্পে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভিড় দেখে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, দোকানেরা ভিড় জমিয়েছেন সেখানে।” সে সময় সিটি সেন্টারকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ইভেন্টসের ব্যবস্থা করতেন হর্ষ। আজ সেই সিটি সেন্টার এক ডাকে বিখ্যাত। ভাগ্যিস সেদিন ওই নকশাখানা ছিঁড়েকুটে ফেলেছিলেন কোরিয়া সাহেব। ভাগ্যিস অত যত্ন করে অন্যরকম শপিং কমপ্লেক্স বানিয়েছিলেন হর্ষ ও তাঁর সংস্থা, নাহলে কলকাতাবাসীর এক অন্যরকমের আড্ডাখানা পাওয়া হত নাকি, মিলত স্বপ্নের বাজার সিটি সেন্টার!

More Articles