যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে সমুদ্রে নামিয়ে দিল ভারতীয় নৌবাহিনী
Rohingya Refugee: তাঁরা এও বলেন, তাঁদের লাইফ জ্যাকেট ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয়নি, কোনো ভাবে সাঁতার কেটে মায়ানমারের ভূখণ্ডে পৌঁছান, যেখান থেকে প্রাণভয়ে একদা তাঁদের পালাতে হয়েছিল।
ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে আন্দামান নিকটস্থ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে দিন কয়েক আগেই। এই ঘটনায় জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বলেও ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। কী অভিযোগ রয়েছে?
সর্বভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রোলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮ মে সন্ধ্যায়, দিল্লির এক তরুণ রোহিঙ্গা শরণার্থীর কাছে মায়ানমার থেকে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেছিলেন তাঁর বাবা -মা। ওই তরুণ স্ক্রোলের প্রতিবেদককে বলেন, "আমার বাবা-মা জানিয়েছিলেন তাঁদের সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে"। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে আন্দামান সাগরে তাঁদের নামিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা এও বলেন, তাঁদের লাইফ জ্যাকেট ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয়নি, কোনো ভাবে সাঁতার কেটে মায়ানমারের ভূখণ্ডে পৌঁছান, যেখান থেকে প্রাণভয়ে একদা তাঁদের পালাতে হয়েছিল। সমুদ্র উপকূলে পৌঁছে স্থানীয় একজন মৎস্যজীবীর ফোন থেকে ফোন করে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। তাঁদের ছেলে বলেন, "তাঁরা (বাবা-মা) ভয় পাচ্ছিলেন, কারণ মায়ানমার সেনাবাহিনী তাঁদের যে কোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার করে নিতে পারে"।
ওই তরুণের দাবি, এই ঘটনার ঠিক দুই দিন আগে, তাঁর বাবা-মা দিল্লির বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। সেদিন পুলিশ তাঁদের মোট ৪১ জনকে আটক করেছিল বলে জানা যায়। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, তাঁদের ভাগ্য ভালো ছিল তাঁরা যে উপকূল অঞ্চলে সাঁতার কেটে এসেছিলেন তা মায়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। অঞ্চলটি মায়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশটির আসামরিক সরকার, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা নির্বাসিত অবস্থায় কাজ করছে। জাতীয় ঐক্য সরকারের সদস্যরা স্ক্রোলকে নিশ্চিত করেছেন, ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী তাঁদের সশস্ত্র শাখা, পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের হেফাজতে রয়েছে।
সরকারের উপ-মানবাধিকারমন্ত্রী এবং সেখানের একমাত্র রোহিঙ্গা সদস্য অং কিয়াও মো স্ক্রোল-কে বলেন, উদ্ধার শরণার্থীরা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জানিয়েছেন- ওই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারত থেকে বের করতে জোর করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, "আমরা স্থানীয় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গে কথা বলেছি যেন ওই রোহিঙ্গা পরিবার নিরাপদে থাকে এবং তাঁদের যেন প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা প্রদান করা হয়।" পাশাপাশি এও বলেন, "তাঁরা যেন তাঁদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, আমরা তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।"
আরও পড়ুন-মীরা নায়ারের পুত্র, মোদি সমালোচক— নিউ ইয়র্ককে দিশা দেখাবেন ভাবী মেয়র মামদানি?
স্ক্রোল ছেলেটির ফোন কলের রেকর্ডিং পর্যালোচনা করেছে। ফোন রেকর্ডিংয়ে শোনা যাচ্ছে, একজন শরণার্থী অভিযোগ করেছেন, তাঁকে এবং অন্যদেরকে জাহাজে কেউ মারধর করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার ভিত্তিহীন অভিযোগও তোলা হচ্ছিল বলে জানান। শুধু তাই নয়, তাঁরা এও বলেছিলেন, শরণার্থীরা হিন্দুদের হত্যা করেছেন বলেও দাবি করেন ওই কর্মকর্তারা। বলাই বাহুল্য, কাশ্মীরে হামলায় রোহিঙ্গা যোগ এখনও অপ্রমাণিত।
স্ক্রোল মায়ানমারে আটক শরণার্থীদের পরিচয় যাচাই করতে জাতীয় ঐক্য সরকারের দেওয়া ৪০ জন শরণার্থীর নাম এবং বয়সের একটি তালিকা, দিল্লিতে আটক করা শরণার্থীদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে। তাতে ছত্রিশজনের নামের সাথে মিল পাওয়া গিয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি।
স্ক্রোল এই ঘটনাকে আরও নিশ্চিত করেতে মায়ানমারের শরণার্থীদের ছবি- যা জাতীয় ঐক্য সরকারও শেয়ার করেছে, তা দিল্লির একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেখিয়েছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও ৬ মে আটক করা হয়েছিল। তিনি পাঁচজনকে চিনতে পেরেছিলেন। জাতীয় ঐক্য সরকারের পাঠানো ছবি দেখে তাঁর স্বস্তি হয় যে তাঁরা নিরাপদে আছেন।
সুপ্রিম কোর্টে আবেদন
দিল্লির দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন দাখিল করেছেন। সেখানে অনুরোধ করা হয়েছে, ফেরত পাঠানো শরণার্থীদের দিল্লিতে ফিরিয়ে আনা হোক। এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া আর কোনও রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যেন নির্বাসিত না করা হয়।
ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। স্ক্রোল এই ঘটনার জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। কিন্তু এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে প্রত্যর্পণ করা ভারতীয় আইনি নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের মৌলিক নীতি উভয়েরই লঙ্ঘন। জাতিসংঘে এই নিয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বিবৃতিতে বলেছে, "মায়ানমারে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতন ও সহিংসতার হুমকির সম্মুখীন হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে প্রত্যাবর্তনের যে কোনো প্রচেষ্টা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।" ২৬ জুন বৃহস্পতিবার, জাতিসংঘ এই অভিযোগগুলির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
আরও পড়ুন-বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে সেনা কনভয়ে হামলা! ঠিক কী ঘটেছে ওয়াজিরিস্তানে?
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের মুখপাত্র বাবর বালুচ স্ক্রোলকে বলেছেন, জাতিসংঘ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য চেয়েছে এবং নির্দেশ দিয়েছে শরণার্থীদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।
পিপলস ইউনিয়ন অফ সিভিল লিবার্টিজ জানিয়েছে, এই ঘটনা মৌলিক আন্তর্জাতিক আইন নন-রিফুলমেন্ট লঙ্ঘন করে। এই আইনে বলা হয়েছে, শরণার্থীদের এমন দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তাঁদের নিপীড়নের ভয় রয়েছে বা স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। তবে ভারত ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনের পক্ষে না হলেও প্রত্যাবর্তন না করার আন্তর্জাতিক আইন সব রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। এছাড়া ভারত নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনেরও স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। পিইউসিএল-ও বলেছে, মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের বলপূর্বক প্রত্যাবর্তন এই আইনের লঙ্ঘন।
উল্লেখ্য, এই ধরনের ঘটনা যে এই প্রথম ঘটেছে এমন নয়। এর আগেও ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশী নাগরিকদের সাথেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ। যেমন, বিবিসি-র একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ১৮ মে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে কাজ করা একটি সামাজিক সংগঠন 'মাসুম' শীর্ষ আদালতের কাছে একটি চিঠি দেয়। সংগঠনটি ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়ে লিখেছে- সম্প্রতি রাজস্থান ও গুজরাতের মতো রাজ্যগুলি থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের যেভাবে প্রত্যাবর্তন করা হচ্ছে, তাতে "ভারত সরকার মেনে চলতে বাধ্য এমন আন্তর্জাতিক আইন যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তেমনই ভারতীয় সংবিধানে যেসব অধিকার দেওয়ার কথা রয়েছে, তারও লঙ্ঘন হচ্ছে।" সংগঠনটির প্রধান কিরীটী রায় প্রধান বিচারপতির কাছে ওই চিঠিতে আরও লিখেছেন," ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত অভিযোগে যাঁদের আটক করা হচ্ছে, তাঁদের যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করা হয় এবং তাঁরা যাতে আইনি সহায়তা পান, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।"
ভারতের বিরুদ্ধে বলপূর্বক প্রত্যাবর্তনের একের পর এক অভিযোগ উঠছে। কিন্তু কখনোই এই নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি ভারত। প্রশ্ন উঠছে, কেন সরকার নিরুত্তর?