উষ্ণতম দিনে যেভাবে প্রাণ জুড়োতে পারে সাধের তিলোত্তমা
Heat wave: আমরা যদি পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ এখন থেকেই পুরোপুরি বন্ধ করে দিই, তারপরও পরিবেশের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বেড়ে যাবে
গত কয়েক বছর তিলোত্তমা কলকাতার পারদ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। শুধু কলকাতাই নয়, দেশের প্রতিটি মহানগরীর একই অবস্থা। ২০২৩ সালেই বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৪৫ ডিগ্রি! ২০২৪ সালে বেড়েছে ১.৫৫ ডিগ্রি। যেখানে উত্তর ও পূর্ব গোলার্ধে এপ্রিল-জুন মাসে গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হয়, সেখানে গতকয়েক বছর স্বাভাবিক সময়ের আগেই তীব্র দাবদাহ দেখা দিয়েছে; অসহনীয় তাপের পাশাপাশি আর্দ্র পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠেছে উপমহাদেশের মানুষজন। চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের দেশের অনেক শহরই তাপপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছে, গতবছর যেখানে প্রথম তাপপ্রবাহ চালু হয়েছিল মে মাসে। পরিসংখ্যান বলছে গত দশকগুলোর তুলনায় এই দশকে তাপপ্রবাহের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনই এই অবস্থার জন্য দায়ী। তবে প্রশ্ন তো ওঠেই, কয়েক বছরের মধ্যে কী এমন হলো যার ফলে পরিস্থিতি এই জায়গায় এসে পৌঁছেল? তা জানতে হলে আগে জানতে হবে তাপপ্রবাহ আসলে কী? এটি মাপার জন্য কোনও বিশেষ সূচক আছে?
সাধারণত কোনও জায়গায় গত তিন দশকের তাপমাত্রার গড়মানকে ওই জায়গার স্বাভাবিক তাপমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একইভাবে গড় উচ্চ তাপমাত্রাও নির্ণয় করা হয়। যদি এর থেকে ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি কোনও স্থানে বিরাজ করে, তখন একে তাপপ্রবাহ বলে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (World Meteorological Organization) পাঁচ দিন ধরে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে আমাদের দেশের আবহাওয়া দফতর ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক তাপমাত্রা তিন দিনের বেশি স্থায়ী হলেই তাপপ্রবাহ চলছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আবহাওয়াবিদদের হিসাবে, বাতাসের আর্দ্রতার সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রা হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়, এই তথ্যের ভিত্তিতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক মাত্রাকে তাপপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর একটা অন্য পরিমাপও আছে। ভারতীয় মৌসম ভবনের মতে, সমতলের উষ্ণতা ৪০° সেলসিয়াসের বেশি, উপকূলীয় অঞ্চলে ৩৭° বা পাহাড়ে ৩০° সেলসিয়াসের বেশি হলে তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে। আবহাওয়া দফতর একটি তাপ সূচক (Heat Index) চালু করেছে, যা থেকে আর্দ্র অবস্থায় কীরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, তার ধারণা পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-গ্লোবাল ওয়ার্মিং আসলে একটি বিশুদ্ধ মিথ্যা? চমকে দেবে বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা
সাধারণত আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রির আশেপাশে, তাপপ্রবাহের ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা এর চেয়ে বেড়ে গেলে আমাদের শরীর পরিবেশে অভ্যন্তরীণ তাপ মুক্ত করতে পারে না। এর প্রভাব পড়ে বিপাকীয় হারে (BMR); ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহের ফলে বৃদ্ধ, শিশু, শ্রমিক, এমনকী গবাদি পশুরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এককথায়, এটি এক নীরব ঘাতক। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে গেলে হিটস্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। সেই সঙ্গে তীব্র দহনে জ্বর, চামড়ায় র্যাশ, কিডনির সমস্যা, পেশির টানও দেখা দিতে পারে।
কীভাবে তৈরি হয় এই তাপপ্রবাহ? দীর্ঘ দিন ধরে কোনও অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলে উচ্চ-চাপ বজায় থাকলে বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহের জন্ম হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিশেষত শহর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন এর জন্য দায়ী। অনবরত গাছ কেটে বিশাল অট্টালিকা নির্মাণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কংক্রিট এবং অ্যাসফল্ট দিয়ে নির্মিত আবাসনগুলি দিনের বেলায় তাপ শোষণ করে এবং রাতে তা পরিবেশে ছেড়ে দেয়। আকাশচুম্বী উন্নত অট্টালিকাগুলি এতটাই গায়ে গায়ে লাগানো যে ঠিক ঠাক বাতাস চলাচল করতে পারে না; উপরন্তু তাদের বাসিন্দাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে নির্গত বর্জ্য তাপ পরিবেশের তাপমাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
মফসসল বা গ্রামেও থাবা বসিয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এসি, রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার এখন এতটাই বেশি হয়ে গেছে যে পরিবেশে নিঃসৃত কার্বনের মাত্রা বিপদসীমা পার করে চলে গেছে। যত দিন যাচ্ছে, জলবায়ুর ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি এক পরিবেশবিদের মন্তব্য বেশ উদ্বেগজনক, "আমরা যদি পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ এখন থেকেই পুরোপুরি বন্ধ করে দিই, তারপরও পরিবেশের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বেড়ে যাবে"। অর্থাৎ তাপপ্রবাহ চলতেই থাকবে। আর যদি এই হারে কার্বন নিঃসরণ চলতেই থাকে, তাহলে এই শতাব্দীর শেষ দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ৭ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে!
এর থেকে পরিত্রাণের উপায়? রাস্তা তিনটি। প্রথমত, কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে, না হলে এর থেকে নিস্তার নেই। দ্বিতীয়ত, প্রচুর গাছ লাগাতে হবে, এর কোনও বিকল্প নেই। তৃতীয়ত শহরের বাড়িগুলি পরিকল্পনা মাফিক করা উচিত। বেআইনিভাবে নির্মিত ভবনগুলো মহানগরীর পরিবেশকে বাসের অযোগ্য করে তোলে।
শহরাঞ্চলে গাছ লাগানোর জায়গার সমস্যা থাকলেও পরিকল্পনা মাফিক গাছ লাগানোর চেষ্টা করলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেই পরিবেশবিদদের ধারণা। শহরের বিভিন্ন আবাসন, অফিস, আদালত, প্রশাসনিক ভবনের মাথায় ছাদবাগান করা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই পড়শি দেশ, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে এর সুফল দেখেছে সেখানকার মানুষজন। আমাদের শহরগুলিতে পৌরসভা ভিত্তিক এই কাজ করা যেতে পারে। এতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বাড়ির জন্য কিছু করছাড়ের ঘোষণা করতে পারে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া মহানগর জুড়ে এত মেট্রো রেল, ওভারব্রিজ— সেগুলির স্তম্ভে উলম্ব বাগান (Vertical garden) করা যেতে পারে। কলকাতায় অনেক জায়গায়, বিশেষ করে নিউটাউনে সেই ব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। শহরের প্রতিটি ফুটপাথের ধারে নিয়ম করে গাছ লাগানো উচিত, সেই সঙ্গে প্রতি বছর খোঁজ নেওয়া উচিত, ক'টা গাছ বেঁচে আছে। শহরে পরিকল্পনার অভাব নেই কিন্ত সেটা কতদূর বাস্তবায়ন হলো তার হদিশ আর ক'জন রাখে?
বড় বড় বাড়িগুলিতে শুধু বাতানুকূল যন্ত্রের ওপর নির্ভর না করে, সেগুলি নির্মাণের সময় ক্রস-ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে বাড়ির এক পাশ থেকে অন্য পাশে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গরম বাতাস আপনা আপনিই বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে আর শীতল বাতাস ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। শহরের মাঝে প্রায়শই একই উচ্চতার বিরাট বিরাট অট্টালিকা দেখা যায়। তার পরিবর্তে যদি ছোট, বড় ও মাঝারি মাপের বিল্ডিং নির্মাণ করা হয় তবে হাওয়া চলাচল করতে সুবিধা হয়। ইদানীং, অনেক দেশেই আবাসন নির্মাণের সময় এই বিষয়গুলি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
আরও পড়ুন-বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ভাষাও! যে ভাবে ধ্বংস ডেকে আনছি আমরা
উঁচু টাওয়ারগুলির বাসিন্দারা প্রায় প্রতিটি ফ্ল্যাটে আলাদা করে এসি ব্যবহার করেন। পৃথকভাবে ছোট জায়গাগুলি শীতল করার পরিবর্তে, পাইপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শীতল জল চালনা করে একবারে অনেক ভবনকে ঠান্ডা করা সম্ভব। এই কুলিং নেটওয়ার্ক একাধিক ছোট এসি ইউনিটের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের মেরিনা বিচ সংলগ্ন আবাসনগুলিতে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। যদিও প্যারিস-সহ পাশ্চাত্যের অনেক শহরে এর ব্যবহার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল।
সিঙ্গাপুর সরকার অন্য আরেকটি কৌশল গ্রহণ করেছে গরম কমানোর জন্য। সেখানে কিছু বাড়ির ছাদে হালকা রঙের আস্তরণ দেওয়া হয়েছে, যাতে দিনের বেলা ছাদ কম তাপ শোষণ করে। এর ফলে গবেষকরা দেখেছেন, বাড়িগুলির চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে গিয়েছে!
বারবার পরিবেশ বাঁচাও সম্মেলন করে, আর বেশি গাছ লাগাতে হবে জাতীয় স্লোগানে ফলপ্রসূ কাজ হওয়া সম্ভব নয়। তাই গাছ লাগানোর পাশাপাশি কীভাবে অধিকাংশ গাছ বাঁচাতে পারা যাবে সেই বিষয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে। শহরের আনাচে কানাচে পরিবেশবান্ধব ভবন গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে বার্তা পৌঁছতে হবে, ইলেকট্রনিক বর্জ্য কমানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতেই হবে। সারা বিশ্বের অনেক কম ক্ষমতাশালী দেশ এসব পারলে আমরা কেনই বা পারব না?