গোটা বিশ্বে হু হু করে বাড়ছে গরম, তবু এসি ছাড়া চলা সম্ভব?

Green Living: তীব্র গরম থেকে বাঁচতে এসির কী কোনো বিকল্প নেই? বিজ্ঞানীদের মতে সামান্য বদল ঘটিয়ে একাধিক প্রাকৃতিক উপায়ে ঘর ঠাণ্ডা রাখা সম্ভব এসি ছাড়াই।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী। গরমে নাজেহাল উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণমেরুর মানুষ। উষ্ণতা যত বাড়ছে মানুষ ততই স্বস্তির খোঁজে এয়ার কন্ডিশনাররের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। সাময়িক শান্তি তাতে মিলছে বটে তবে পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতিমধ্যেই অনুভব করছেন বিশ্ববাসী। এবছর গ্রীষ্মে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। শুধু জার্মানি নয়, তাপমাত্রার বিচারে এবারে লন্ডনও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। চলতি মাসে সেখানেও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পার করে গেছে। আমাদের দেশ এমন তীব্র গরমের সঙ্গে পরিচিত হলেও পশ্চিমী সভ্যতার ছবিটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। এই দেশগুলির বেশিরভাগ বাড়িতেই এসি ,ফ্যান নেই।তাই নাগরিকদের অস্বস্তি চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু তীব্র গরম থেকে বাঁচতে এসির কী কোনো বিকল্প নেই? বিজ্ঞানীদের মতে সামান্য বদল ঘটিয়ে একাধিক প্রাকৃতিক উপায়ে ঘর ঠাণ্ডা রাখা সম্ভব এসি ছাড়াই।

এসির চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী

জলবায়ুর সংকট বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহকে আরও তীব্র করে তুলছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, ২০১৮ সালের হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১০% খরচ হয়েছে এয়ার কন্ডিশনার এবং বৈদ্যুতিক ফ্যানে। মনে করা হচ্ছে,২০৫০ সাল নাগাদ বিদ্যুতের চাহিদা বর্তমানে ভারত ও চীনের যৌথভাবে ব্যবহৃত বিদ্যুতের চেয়ে তিনগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু বিদ্যুতের ব্যবহার যত বাড়বে পরিবেশের ওপর তত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে বিশ্ব উষ্ণায়নও।এমন অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বিকল্প উপায় বেছে নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। বিকল্প এই কুলিং পদ্ধতি অনুসরণ করলে ন্যূনতম শক্তি ব্যবহার করেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

সমাধান কী?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক আলেকজান্ডার রেমপ্লের মতে,' বিকল্প কুলিং পদ্ধতি সামান্য খরচেই স্বস্তি দিতে পারে এবং এয়ার কন্ডিশনারের ওপর নির্ভরতা কমাতেও সক্ষম। ভারতেও বর্তমানে এই পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে গবেষনা চলছে। বিল্ডিংয়ের নকশা, শেড বদলে কীভাবে তাপ প্রতিরোধ করা যায় তার কৌশল অন্বেষণ করাই এই গবেষণার মূল আকর্ষণ। ইন্টারন্যাশনল এনার্জি এজেন্সির মতে, এই পদ্ধতিতে তাপ নিয়ন্ত্রণ করলে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে অনন্ত ৫০% শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে।

অতিরিক্ত তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে কিছু সহজ সমাধান হল রাতের বেলা পর্যাপ্ত ঠান্ডা হাওয়া ঘরে প্রবেশ করার জন্য জানালা খুলে রাখা। অন্যদিকে দিনের বেলা প্রচন্ড সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে জানালায় ছাউনি ব্যবহার করা হয়।

গবেষক রেম্পেলের একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক ভেন্টিলেশন এবং ছাউনি তৈরি করেই কোনো বদ্ধ ঘরের তাপমাত্রা প্রায় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম করা সম্ভব এবং এর ফলে ঘরের এসির ওপর চাপ প্রায় ৮০% কমে যাবে। এক্ষেত্রে নতুন কোনো ব্যবস্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজন নেই। রেম্পেলের এই গবেষণায় ২০২১ সালের উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় তাপ প্রবাহের কারণে মৃত্যুর জন্য দায়ী একাধিক তথ্য ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি অতীতের তাপ প্রতিরোধের উপায় ও কৌশলগুলি মানুষকে ভালোভাবে শিখিয়ে ও বুঝিয়ে দিতে পারলেও তাৎপর্যপূর্ণ বদল আসতে পারে বলেই মনে করেন রেম্পেল। তিনি আরো জানিয়েছেন যে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষদের বাড়িতে এখনও এসি নেই। এই এলাকার মানুষদের টার্গেট করে তাপ প্রতিরোধের শিক্ষা দিলে তা এসির প্রতি তাদের নির্ভরতা কম করবে এবং পরিবেশ ও রক্ষা পাবে।

বিল্ডিংয়ের নকশা বদল

বিল্ডিংয়ের নকশায় কিছু বদল এনে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় উত্তর আফ্রিকার উইন্ডক্যাচারস বিল্ডিং এবং মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি হওয়া বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের নকশার কথা। উইন্ট ক্যাচারস বিল্ডিংয়ের একেবারে মাথায় একটি বড় খোলা জানালা রয়েছে যার মাধ্যমে ঠান্ডা বায়ু বিল্ডিংয়ের মধ্যে প্রবেশ করে এবং গরম হাওয়াকে টেনে বাইরে বার করে দেয়, ফলে বিল্ডিংয়ের তাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এছাড়াও লো-ওভার জানালা যার মধ্যে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে না পারলেও বায়ু চলাচল করতে পারে, ডবল গ্লেজিং জানালা এবং ফোয়ারা ব্যবহার করেও তাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দুবাইয়ের আবাসনগুলি এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বার্ষিক ২০% বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে পারে জানা গেছে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়।

বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ

বিকল্প কুলিংয়ের অর্থ শুধুমাত্র বিল্ডিংয়ের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা নয়,বরং বিল্ডিংয়ের উপরিতল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই রাস্তার পাশে ফুটপাতের একদিকে গাছ লাগানো যেতে পারে। এর ফলে শহরের তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাবে। পাশপাশি বিল্ডিংয়ের বাইরে অন্তত ১০ মিটার এলাকা জুড়েও গাছ থাকলেও প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যাবে বিল্ডিংয়ের উপরিতলের তাপমাত্রা। তাই পরিবেশ রক্ষার্থে প্রাকৃতিক ও সহজ উপায়গুলি বেছে নেওয়াই শ্রেয়, এর ফলে পরিবেশও রক্ষা পাবে এবং মানুষও স্বস্তিতে বাঁচতে পারবে।

More Articles