বেড়া ভাঙার কথা বলে বৃন্দাবনের বিধবা দোল
Vrindavan Widow Holi 2024: ২০১৩ সাল থেকে বৃন্দাবনে বিধবাদের হোরিখেলা শুরু হয় প্রকাশ্যে। এর আগে বিধবাদের একাংশ দোল খেলতেন ঠিকই কিন্তু তা শুধু কৃষ্ণের সঙ্গে।
সাদা। অথবা রংহীনও বলা যায়। সমস্ত রং তুলে নেওয়ার পর সাদার মধ্যে পড়ে থাকেন ভারতের বিধবারা। আনন্দ নেই, কামনা নেই, ইচ্ছে নেই, স্বাদ নেই, গন্ধ নেই, শখ নেই, আস্ত নেই-রাজ্যের বাসিন্দা করে দেওয়া হলো যাদের, কোনওদিনই কি তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয় আসলে তাঁরা কীভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন? উৎসব বিমুখ করে রাখা হয়েছে ভারতের স্বামীহীনাদের। শুধু উৎসববিমুখ না, তীর্থের নামে ভিনরাজ্যে গিয়ে স্বজনরাই ফেলে এসেছেন বাড়ির বৃদ্ধাটিকে। এই সাদা হয়ে যাওয়া, অপাংক্তেয় করে দেওয়া বিধবারা থেকেছেন কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আশ্রয়ে, আশ্রমে। বৃন্দাবনে এমন আশ্রম রয়েছে অজস্র। ঘটনাচক্রে সেখানেই সুযোগ হয়েছিল এক অদ্ভুত উৎসব প্রত্যক্ষ করার। বিধবাদের দোল!
২০১৬ সালে বৃন্দাবনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। একটি জার্মান সংস্থার হয়ে বিধবাদের দোল বিষয়ে একটি ভিডিও শ্যুট করছিলাম। বৃন্দাবন, মথুরা সব জায়গার দোলই দেখেছি তখন। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সেখানে উদযাপন চলে। রংহীনতার ঠিক ১৮০ ডিগ্রি উল্টোপিঠে রঙের সে কী হুল্লোড়! মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষদের এ এক নিজস্ব উৎসব। কৃষ্ণের মন্দির ঘেরা শহর বৃন্দাবনকে অনেকেই বিধবাদের শহরও বলেন। বলবেন নাই বা কেন? প্রায় হাজার ছয়েক বিধবা রয়েছেন এখানে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের হলো, এই মহিলাদের বেশিরভাগই পশ্চিমবাংলার। কেউ রাস্তায় ভিক্ষা করতেন, মন্দিরের সিঁড়িতে শুয়ে থাকতেন, নোংরা গলিতে বসে খাবার ভিক্ষা চেয়েছেন তারা। তাঁদের শুধু সাদা কাপড়, তাঁদের কপাল জুড়ে অনিশ্চয়তা, অধিকারহীনতা। দোল হোক বা দীপাবলি, তাঁদের কোনওটাতেই যোগদানের সামাজিক অনুমতি নেই। ২০১২ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি চ্যারিটির দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে বিধবাদের ভরণপোষণ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সেই থেকে সুলভ ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা বৃন্দাবনের বিধবাদের জীবনের উন্নতি নিয়ে নানা কাজ করছে।
আরও পড়ুন- উত্তর কলকাতার দোল নিষেধ ভাঙার কার্নিভাল
২০১৩ সাল থেকে বৃন্দাবনে বিধবাদের হোরিখেলা শুরু হয় প্রকাশ্যে। এর আগে বিধবাদের একাংশ দোল খেলতেন ঠিকই কিন্তু তা শুধু কৃষ্ণের সঙ্গে। ২০১৩ পরবর্তী সময়ে বৃন্দাবনে এই বিশেষ হোলি খেলা হয়ে ওঠে এখানকার নিজস্ব উৎসব। যে বিধবাদের থেকে সমস্ত রং কেড়ে নিয়ে ফেলে গেছিলেন স্বজনেরা, বৃন্দাবনের সেই বিধবাদের দোলের মতো রঙিন উৎসব ভারতে কমই দেখা যায় এখন! তবে এখানের হোলির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে ফুল দিয়ে হোলি খেলা। বিভিন্ন রঙের ফুল নিয়ে, তা গুঁড়ো করে খেলা হয়। আবির বা অন্য রঙের ব্যবহার কমই। সমস্তটা আয়োজন করেন এই বিধবারাই। নিজেরাই ফুল বাছেন, সমস্ত গুছিয়ে নিয়ে রঙের উৎসবে মাতেন।
বৃন্দাবনে বহু শতাব্দী ধরেই বিধবা হিন্দু মহিলাদের আশ্রয়। সমাজ যাদের ব্রাত্য করেছে সেই মহিলাদের আশ্রয় দিয়েছে বৃন্দাবন। স্থানীয় বহু দাতব্য সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, মন্দির, আশ্রম এখানে রয়েছে বিধবা মহিলাদের সেবার্থে। বাংলা থেকে হাজার হাজার বিধবা মহিলা এসে পৌঁছন বৃন্দাবনে। ২০১০ সালের জাতীয় মহিলা কমিশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, এখানে বাঙালি বিধবাদের হার ৭৪ শতাংশ! ঐতিহাসিকদের অনেকে বলেন, ১৬ শতকের চৈতন্য মহাপ্রভু সতীদাহ থেকে বাঁচাতে বিধবাদের একটি দলকে এই স্থানে নিয়ে আসেন। তারপর থেকেই বিধবারা এই শহরে জড়ো হন। এখনও অনেক বিধবাই স্বেচ্ছায় বৃন্দাবনে আসেন। অনেকে বাড়িতে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে বাঁচতে এখানে আসেন। আর বাকিদের স্বজনরাই ছেড়ে চলে যান এখানে, তাঁরাই সংখ্যায় বেশি। পরিবারের কেউ কেউ আসেন মাঝেসাঝে দেখা করতে। বাকিদের জীবনে তারা বাতিলের খাতায়।
জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্যই বলছে, এখানে এসে পড়া বিধবাদের প্রায় ৯০ শতাংশই অশিক্ষিত, অনেকেই বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিক শ্রম করতেও পারেন না। ফলে দুইবেলার খাবার জোগাড় করতে তাঁদের ভিক্ষাবৃত্তিই বাছতে হয়। তার উপর সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। স্ত্রীহীন পুরুষদের জন্য সেই সমাজে কোনও বেড়া নেই। অথচ কর্তা না থাকলে দৈন্য স্ত্রীটিকে এভাবেই একঘরে করে রাখা হয়েছে। বৃন্দাবনের দোল তাই এক বেড়া ভাঙার কাহিনি বলে। সাদা ক্যানভাসে সমস্ত রঙই তো তীব্র, সমস্ত রঙই অত্যন্ত প্রাণোজ্জ্বল। দোল উৎসবে ঠিক সেভাবেই সেজে ওঠে বিধবাপাড়া।
আরও পড়ুন- শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব আস্ত এক ব্যাধি এখন
যৌবনের দোল খেলার ছায়া তারা খুঁজে পেয়েছেন পড়ন্ত বেলায়। সাদাটে, পাংশুটে হয়ে যাওয়া জীবনে এই বসন্তই নিয়ে এসেছে রং! রোমাঞ্চ তাহলে এখনও জাগে? এখনও জাগে বেঁচে থাকার আনন্দ উত্তেজনা। সাদা শাড়ি পরেই নেচে ওঠেন বিধবারা, বৃন্দাবনের ঐতিহ্যবাহী হোলির গান গুনগুনিয়ে ওঠেন। একে অন্যকে রাঙান, নিজে রঙিন হয়ে ওঠেন।
তবে শুধু এই বিধবাদের দোলই নয়, বৃন্দাবনের আশেপাশে নানা ধরনের রঙ খেলার উৎসব দেখা যায়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লাঠমার হোলি। এখানে মেয়েরা ছেলেদের লাঠি দিয়ে মারে। বহু বছরের প্রথা। মেয়েদের মার খেয়ে ওই পুরুষ আবার সেই মহিলাকে টাকাও দেন। খানিক আশীর্বাদের প্রণামীর মতো। সবটা মিলিয়ে ভারতের অন্য অংশের থেকে বৃন্দাবন স্বতন্ত্র। বৃন্দাবনের দোল প্রকৃতই রঙের বিচ্ছুরণ!