প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি, ইজরায়েলকে অস্ত্র : ব্রিটেনের দ্বিমুখী নীতি

Britain Palestine Israel conflict: অক্সফ্যাম গ্রেট ব্রিটেন -এর প্রধান হালিমা বেগম আরও কড়া ভাষায় মন্তব্য করেছেন, “যুক্তরাজ্য একইসঙ্গে গাজায় সহায়তা পাঠাচ্ছে আর ইজরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে—এটা একেবারেই অনৈতিক।”

একদিকে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সরকার স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচারের বার্তা দিচ্ছে, আরেকদিকে একই সরকার ইজরায়েলকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করে সেই বার্তাকে অকার্যকর করে তুলছে। এই দ্বিমুখী অবস্থান ব্রিটিশ নৈতিকতা তথা গোটা পাশ্চাত্যের মানবিক মূল্যবোধের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও কাঠগড়ায় তুলছে।

লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, শুধু আগস্ট মাসেই ব্রিটেন থেকে ইজরায়েলে অন্তত এক লাখ দশ হাজার গুলি সরবরাহ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় বিশ হাজার পাউন্ড (প্রায় ২৭ হাজার মার্কিন ডলার)। এছাড়াও অস্ত্রচালানের মধ্যে ছিল ট্যাংকের যন্ত্রাংশ, শটগান ও রাইফেলের যন্ত্রাংশ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরক ও বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ। আগস্ট মাসে ব্রিটেনের অস্ত্র রপ্তানির মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ পাউন্ডে, যা ২০২২ সালের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাসিক সরবরাহ। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোর-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইজরায়েলি কর কর্তৃপক্ষের তথ্য। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শুধু জুন মাসেই ইজরায়েলে ব্রিটেন থেকে প্রায় চার লাখ পাউন্ডের অস্ত্র পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে তথ্য সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর থেকে এটিই এক মাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র চালান।

অথচ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্য সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ইজরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির ২৯টি লাইসেন্স বাতিল করছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ওই অস্ত্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হতে পারে। তবু বাস্তবে তিন শতাধিক লাইসেন্স কার্যকর রয়ে গেছে, যার মধ্যে অন্তত ১৬০টি সরাসরি সামরিক রপ্তানি হিসেবে চিহ্নিত।

আরও পড়ুন- গাজায় গুলেন-বেরি সিনড্রোম! ইজরায়েলি হানাদারির মধ্যেই হু হু করে বাড়ছে এই রোগ

এ অবস্থাকে ভণ্ডামি বলে আখ্যায়িত করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। Campaign Against Arms Trade (CAAT)-এর মুখপাত্র অ্যান্ড্রু স্মিথ বলেন, “সরকার একদিকে প্যালেস্টাইনের গণহত্যার নিন্দা জানাচ্ছে, অন্যদিকে সেই আবার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করছে। এটি চরম ভণ্ডামি।” অক্সফ্যাম গ্রেট ব্রিটেন -এর প্রধান হালিমা বেগম আরও কড়া ভাষায় মন্তব্য করেছেন, “যুক্তরাজ্য একইসঙ্গে গাজায় সহায়তা পাঠাচ্ছে আর ইজরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে—এটা একেবারেই অনৈতিক।”

জাতিসংঘের কমিশন অব ইনকোয়ারি গাজায় ইজরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সরাসরি “গণহত্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “কিছু রাষ্ট্র ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করছে, প্যালেস্টিনীয় জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যায় তাদেরও দায় রয়েছে।” জাতিসংঘ বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানেসা বলেছেন, “ইজরায়েল আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যাগুলোর একটির জন্য দায়ী। বিশ্বকে অবশ্যই ইজরায়েলের ‘গণহত্যার অর্থনীতির’ সাহায্যার্থে সব ধরনের বাণিজ্য সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।”

তবে যুক্তরাজ্য সরকার ভিন্ন দাবি করছে। আদালতে জমা দেওয়া এক আইনি নথিতে সরকার বলেছে, “গাজায় গণহত্যা হচ্ছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিংবা ইজরায়েলি সেনারা নারী ও শিশুদের উদ্দেশ্য করে হামলা চালিয়েছে—এমন প্রমাণও নেই। গণহত্যার আইনি সংজ্ঞায় নির্দিষ্ট ‘ধ্বংস করার উদ্দেশ্য’ প্রমাণিত হয়নি।” বিদেশ সচিব ডেভিড ল্যামি এ বিষয়ে বলেছেন, “আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি যে ইজরায়েল গাজায় গণহত্যা করছে।” প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলে মন্তব্য করেছেন, “এটি নির্দোষ বা দোষী সাব্যস্ত করার বিষয় নয়… আমারা ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারে অবিচল।”

ইজরায়েল অবশ্য এই সমালোচনার জবাবে উল্টে ব্রিটেনকেই দোষারোপ করছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “ব্রিটেনের এই বিবৃতি লজ্জাজনক। কিন্তু ব্রিটিশ অস্ত্র থাকুক বা না থাকুক, ইজরায়েল এই যুদ্ধে জয়ী হবেই।”

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের ভেতর থেকেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। প্রাক্তন লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, “ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না করলে প্যালেস্টাইনে গণহত্যা ঠেকানো যাবে না, আর ব্রিটেনের নাম ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে।” স্কটল্যান্ডের প্রথম মন্ত্রী জন সুইননি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “আমি উদ্বেগ ভাগ করে নিয়েছি… গাজায় একটি গণহত্যা সংগঠিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”

আরও পড়ুন- ১৯৬৭ থেকে ২০২৫! যেভাবে গাজায় বারবার নিশানা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের

বাস্তবে গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং প্রাক্তন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ফক মন্তব্য করেছেন, “গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখানে নারী ও শিশুদের গণহারে হত্যা করা হচ্ছে। যে রাষ্ট্র এই হত্যাযজ্ঞে অস্ত্র সরবরাহ করে, সে রাষ্ট্রও নৈতিকভাবে অপরাধে জড়িত।” আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এক বিবৃতিতে বলেছে, “গাজায় মানুষের জীবন এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমে গেছে, কারণ খাদ্য, জল ও চিকিৎসার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ইজরায়েলি আগ্রাসনে নিহত হয়েছে অন্তত ৬৬ হাজার ফিলিস্তিনি, যাদের বিশাল অংশ নারী ও শিশু। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজার অবকাঠামো, বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে অধিকাংশ এলাকা, হাসপাতাল ও স্কুল পর্যন্ত মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। জাতিসংঘ কমিশন তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “ইজরায়েল কেবল গণহত্যাই ঘটাচ্ছে না, তা ঠেকাতে বা অপরাধীদের শাস্তি দিতেও ব্যর্থ হয়েছে।”

এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান যুক্তরাজ্যের জন্য কেবল নৈতিক সংকটই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে কূটনৈতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিও তৈরি করছে। একদিকে মানবিকতা ও ন্যায়ের বুলি আওড়ানো, অন্যদিকে ইজরায়েলের সামরিক ব্যবস্থায় অস্ত্র সরবরাহ—এই দ্বিমুখী নীতি ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, পশ্চিমা বিশ্বের ঘোষিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কি আসলেই মানবিক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে, নাকি যুদ্ধ অর্থনীতির স্বার্থেই বারবার পুনর্লিখিত হচ্ছে?

More Articles