শাটডাউনে স্তব্ধ হতে পারে মার্কিন অর্থনীতি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মূল্য দেবে সাধারণ মানুষ?

America shutdown crisis: ঘন ঘন এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে দেশের রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে এবং সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, আমেরিকার রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেতে পারে।

​মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার এই মুহূর্তে আংশিকভাবে অচল হয়ে পড়েছে। নতুন আর্থিক বছরে সরকারি সংস্থাগুলি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিল অথবা সাময়িক অর্থ বরাদ্দের বিল পাস করাতে সেনেট ব্যর্থ হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চরম রাজনৈতিক বিভাজন এবং পারস্পরিক সমঝোতার অভাবই এই অচলাবস্থার মূল কারণ, যার জেরে মার্কিন অর্থনীতি তো বটেই, লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মীর জীবিকাও অনিশ্চয়তার মুখে।

​মার্কিন আর্থিক বছর শুরু হয় ১ অক্টোবর। এই তারিখের আগে, মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষকে সরকারি কাজ চালানোর জন্য অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন করতে হয়। কিন্তু ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান দলের মধ্যে সরকারি ব্যয় সংকোচন, স্বাস্থ্যসেবা নীতি এবং অন্যান্য নীতিগত বিষয় নিয়ে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় এবার শেষ মুহূর্তে আলোচনা ভেস্তে যায়। রিপাবলিকানরা সরকারের ব্যয় কমানোর দাবিতে অনড় ছিলেন, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মসূচিগুলির জন্য অর্থায়ন বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন। ফলে, ৩০শে সেপ্টেম্বরের সময়সীমা অতিক্রম হওয়ার সাথে সাথেই 'আংশিক শাটডাউন' কার্যকর হয়।

​শাটডাউন বলতে আসলে কী বোঝায়?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার মার্কিন কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত। সেই কারণে মার্কিন সরকার প্রতি বছর তাদের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন পেয়ে থাকে। এই বরাদ্দকৃত অর্থ সাধারণত ১২টি পৃথক বার্ষিক বিলের মাধ্যমে পাস হয়। তাই মার্কিন আর্থিক বছর শুরু হওয়ার আগে কংগ্রেস (সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ) যদি সরকারের কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল অনুমোদন করতে এবং তা প্রেসিডেন্টকে দিয়ে সই করাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার তার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আইনগত অধিকার হারায়। এই অবস্থাকেই ‘শাটডাউন’ বলা হয়।

আরও পড়ুন- ট্রাম্পের ভিসা নীতি, কতটা দুর্বল হবে মার্কিন গবেষণাক্ষেত্র?

কেন এই অচলাবস্থাকে ‘আংশিক শাটডাউন’ বলা হচ্ছে?

‘শাটডাউন’ শব্দটি শুনলে মনে হতে পারে পুরো সরকারি ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। মার্কিন আইনে স্পষ্ট বলা আছে যে জীবন রক্ষা, সম্পত্তি সুরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত পরিষেবাগুলি কখনই বন্ধ করা যাবে না। ফলে সামরিক বাহিনী, বিমান ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার, ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং জরুরি চিকিৎসার কর্মীরা—যাঁদের ‘অপরিহার্য’ কর্মী বলা হয়—তাঁরা বেতন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যান। অন্যদিকে, অপরিহার্য নয় এমন সরকারি পরিষেবাগুলি, যেমন জাতীয় উদ্যানগুলির অধিকাংশ কাজ অথবা পাসপোর্ট ও ভিসার অ-জরুরি প্রক্রিয়াকরণ, এই পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, এই বিভাগের কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি দেওয়া হয়। এই কারণে সরকার অচল হলেও পুরো ব্যবস্থা বন্ধ না হওয়ায় একে ‘আংশিক শাটডাউন’ বলা হয়।

শাটডাউনের তাৎক্ষণিক পরিণতি

​বর্তমান শাটডাউনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

​এই শাটডাউনের ফলে দেশের প্রায় ৭৫০,০০০ ফেডারেল কর্মীকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি দেওয়া হবে, অর্থাৎ অপরিহার্য নন এমন কর্মীরা বেতন ছাড়া ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে, বিমান ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার, সামরিক বাহিনী এবং সীমান্ত সুরক্ষার মতো 'অপরিহার্য' পরিষেবার কর্মীরা কাজে থাকলেও বেতন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যাবেন। শাটডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য বেতন পাবেন না, যা তাঁদের ব্যক্তিগত আর্থিক জীবনের উপর চরম চাপ সৃষ্টি করবে।

​শাটডাউনের কারণে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি পরিষেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। নতুন পাসপোর্ট বা ভিসা আবেদন প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়বে, যার জেরে জরুরি ভ্রমণ বা আন্তর্জাতিক পরিকল্পনাগুলিকে ঝুঁকিতে ফেলবে। একইভাবে, ছোট ব্যবসার জন্য ফেডারেল ঋণ অনুমোদন স্থগিত হয়ে যাবে, ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শ্লথ হবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এর ফলে চাপ পড়বে বাজারে।

​আংশিক এই অচলাবস্থা মার্কিন অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। লক্ষ লক্ষ কর্মীর বেতন বন্ধ হওয়ায় তাঁদের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে, যা খুচরা বাজারের উপর সরাসরি আঘাত হানবে। একই সাথে, সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ফেডারেল ঠিকাদাররা কাজ এবং পাওনা টাকা হারাবেন, কারণ তাঁরা শাটডাউন পরবর্তী সময়ে বকেয়া বেতন পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা পান না। সব মিলিয়ে, এই শাটডাউন মার্কিন অর্থনীতিতে বহু বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

​অতীতের শাটডাউন

​তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের পরিস্থিতি এই প্রথম নয়। ১৯৭৬ সালে বর্তমান বাজেট প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ বারেরও বেশি অর্থায়নে ঘাটতি দেখা গেছে, যার মধ্যে অন্তত ১০ বার পূর্ণ বা আংশিক শাটডাউন হয়েছে।

 ​•১৯৯৫-১৯৯৬ আর্থিক বছরে মোট ২৬ দিন শাটডাউন হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের মধ্যে তীব্র ব্যয় হ্রাস নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় এটি ঘটে।

• ​২০১৩-২০১৪ আর্থিক বছরে ১৬ দিনের শাটডাউন হয়। মূলত রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ওবামা’র স্বাস্থ্যসেবা আইন (ওবামাকেয়ার) বাতিল করার দাবিতে এই অচলাবস্থা শুরু হয়।

• ​২০১৮-২০১৯ আর্থিক বছরে ৩৫ দিনের শাটডাউন হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য অর্থ চাওয়ার কারণে এটি মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ শাটডাউন ছিল।

উত্তরণের উপায়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে বারবার আলোচনা ও সমঝোতার মধ্যে দিয়েই শাটডাউন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রায় প্রতিটি শাটডাউন শেষ হয়েছে কংগ্রেস কর্তৃক একটি অস্থায়ী অর্থ বরাদ্দের বিল (Continuing Resolution বা CR) পাস করার মাধ্যমে। এই সিআর সাধারণত কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য সরকারকে অর্থায়ন করে, যা দুই পক্ষকে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আলোচনার সুযোগ করে দেয়। জনগণের স্বার্থের কথা ভেবে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত আপোস করতে বাধ্য হয়।

​ফলে এই শাটডাউন কত দিন চলবে তা নির্ভর করছে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট এই দুই রাজনৈতিক দলের উপর। এদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত অচলাবস্থা কাটবে না। কবে নাগাদ এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটবে, এই মুহূর্তে তা একেবারেই অনিশ্চিত। যতক্ষণ না উভয় দল একটি নতুন অর্থায়ন বিল বা স্বল্প-মেয়াদি সিআর পাস করে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে সই করাতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের একটি বড় অংশের সরকারি কাজ বন্ধ থাকবে।

পরিণতি

​এই শাটডাউন স্বল্পস্থায়ী হলে অর্থনৈতিক প্রভাব সীমিত থাকবে। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে আমেরিকার অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।

আরও পড়ুন- ট্রাম্প-পুতিন-আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?

​অর্থনীতিবিদদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল শাটডাউনের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে। তাঁদের অনুমান, প্রতি সপ্তাহে ত্রৈমাসিক জিডিপি প্রায় ০.১৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে পারে। কারণ, এই অচলাবস্থা জনগণের মনোবল ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবোধে প্রভাব ফেলতে পারে। যখন সরকারি কর্মীরা বেতন না পেয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে, তখন তাঁরা সাধারণত গাড়ি বা ইলেকট্রনিক্স-এর মতো বড় কেনাকাটা স্থগিত রাখেন। বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও, এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতি বা বেকারত্বের হারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ বন্ধ রাখা হয়। সঠিক তথ্য না পেলে দেশের নীতিনির্ধারকদের পক্ষে সময়মতো সঠিক আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যা সংকটকে আরও গভীর করতে পারে।

​এই শাটডাউন ভবিষ্যতে আমেরিকার রাজনীতিতে এবং সরকারি কাজেও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনতে পারে। ঘন ঘন এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে দেশের রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে এবং সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, আমেরিকার রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেতে পারে।

মার্কিন প্রশাসন ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, শাটডাউন দীর্ঘস্থায়ী হলে সরকার ফেডারেল কর্মীদের স্থায়ীভাবে ছাঁটাই করবে এবং প্রশাসনিক বিভাগগুলির আয়তন ছোট করবে। সহজ কথায়, অচলাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে সরকার বাধ্য হয়ে অনেক বিভাগ বন্ধ করে দেবে। পরবর্তীতে অচলাবস্থা কাটলেও, সব বিভাগ আগের মতো ক্ষমতা বা বাজেট নাও পেতে পারে। সরকার তখন চাইবে প্রতিরক্ষা, আইন, সীমান্ত রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কাজগুলিতেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখতে, যার ফলে অন্যান্য সামাজিক বা জনকল্যাণমূলক বিভাগগুলির ক্ষমতা বা আকার কমে যেতে পারে।

​রাজনৈতিক সংঘাত শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উপরই চাপ সৃষ্টি করে — এই শাটডাউন তার স্পষ্ট প্রমাণ। মার্কিন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা নিজেদের মতবিরোধ ভুলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কবে এই অচলাবস্থা কাটান, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

More Articles