দুর্গাপুজোয় উৎসব নয়, মহিষাসুরের স্মরণে সভা পালন করে তার বংশধররা!
Hudur Durga:পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রতি বছরের মত এবছরও দুর্গাপুজোর আনন্দে মাতবে 'অসুর'রা।
এমন কি কখনও শুনেছেন, দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে যে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়েছিল তাঁর কোনও বংশধর রয়েছে, তাও আবার এই পৃথিবীর বুকে? শুনে অবাক হলেন তো? ভাবছেন কী সব আজগুবি ঘটনা রে বাবা! গোটা ঘটনাটি নিয়ে নানা সময়ে নানা বিতর্ক চলে আসলেও, ভারতবর্ষের কিছু বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলেই মনে করে। তাই আজও তাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছে কিছু আচার-আচরণ। আজও তারা হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তিকে পুজো করে না। বিশেষ করে দেবী দুর্গা তাদের কাছে যমদূতের প্রতিনিধি হিসেবেই পরিগণিত হন। আর তাই আশ্বিনের দুর্গোৎসবের চারদিন এই 'অসুর বংশের' বংশধররা বাড়ি থেকে বেরোন না। পাছে দেবী দুর্গার কোপে বেঘোরে প্রাণটা হারাতে হয়।
মা দুর্গার আরাধনার মাঝেই আপনাদের নিয়ে যাব সেই 'অসুরদের' সঙ্গে পরিচয় করাতে। ভারতের প্রাচীনতম উপজাতিদের একটি অংশ এই অসুর সম্প্রদায়। পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে ডুয়ার্সের একটি অংশ এবং ঝাড়খণ্ড ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশে বাস এই অসুরদের। ডুয়ার্সের পাহাড়, চা-বাগান ঘেরা অরণ্যভূমিতে বাস এই অসুর সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের। এখনও শিক্ষার আলো সেভাবে তাঁদের কাছে পৌঁছায়নি। সেইসঙ্গে নেই সভ্যতার বিবর্তনও। এখনও তারা নিজেদের আদিম সম্প্রদায়ভূক্ত বলেই মনে করে। উপার্জন বলতে বন সংলগ্ন এলাকায় সামান্য চাষাবাদ। কেউ কেউ আবার অরণ্যের কাঠ, পাতা সংগ্রহ করে দিন গুজরান করে। আর এসবের মাঝে তারা যে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে, তা সকলের থেকেই আলাদা।
একটি-দু'টি পরিবার নয়, এমন 'অসুর'-এর সংখ্যাটা কয়েক হাজার। ২০১১ সালের সেন্সাস অনুসারে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যে অসুর বংশের সদস্যদের সংখ্যা ১০ হাজারের কিছু বেশি। তাদের ধারণা, দুর্গাপুজোর চারদিন দেবী মর্ত্যে আগমন করে অসুর নিধন করেন। সেই ভয় থেকেই আজও তারা নিজেদের ঘরে বন্দি করে রাখে। দুর্গাপুজোর চারদিন এই সম্প্রদায়ের মানুষরা বাড়ি থেকে বেরোয় না। শুধু তাই নয়, দশমীর দিন মা দুর্গার বিসর্জনের পরই তারা বাইরের আলোর মুখোমুখি হয়। 'অসুর' বংশের সদস্যরা এক সময় খনি থেকে লোহা তোলার কাজে নিযুক্ত ছিল যদিও কালের বিবর্তনে এখন আর তাঁরা তা করেন না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উপজাতিভুক্ত মানুষদের চা-বাগানের কাজে লাগানো হয়। সেই সময়ই অসুরদের অনেকে সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তবে, আগের থেকে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই পাল্টেছে। বর্তমানে অসুর বংশের বেশ কিছু মানুষ শিক্ষার আলোয় আসছে, মিশে যাচ্ছেন আমার-আপনার সঙ্গে, আমাদের ভিড়ে।
আরও পড়ুন- জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?
অসুরের স্মরণসভা
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালীরা যে সময়ে তাদের সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজো উদযাপন করেন, ঠিক সেই সময়েই শোক পালন করেন অসুর বংশীয় আদিবাসীরা। তাদের লোককথা অনুযায়ী, আর্যদের দেবী দুর্গা এই সময়েই তাদের রাজা মহিষাসুরকে ছলনার মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন। রাজাকে হারানোর শোক হাজার হাজার বছর ধরেও ভুলতে পারেনি আদিবাসী সমাজ। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে 'মহান অসুর সম্রাট হুদুড় দুর্গা স্মরণ সভা'-র আয়োজন প্রতিবছরই বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন আদিবাসী সমাজ-গবেষকরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহিষাসুরের নাম 'হুদুড় দুর্গা' কেন?
আমরা ছোট থেকে শুনে এসেছি, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তবে ওই আদিবাসী সমাজ মনে করে, দুর্গা আসলে তাদের 'সম্রাট মহিষাসুর'-এর নাম, যেখানে তিনি পরিচিত 'হুদুড় দুর্গা' বলে। আসলে 'হুদুড়' শব্দটার অর্থ হল ঝঞ্ঝা, বিদ্যুৎ বা বজ্রের ধ্বনি। এক্ষেত্রে মহিষাসুরের প্রভাব আর শক্তি ছিল বজ্রের মতো। আর দুর্গা শব্দটা 'দুর্গের রক্ষক' অর্থে ব্যবহৃত। এটা পুংলিঙ্গ। প্রবল শক্তিশালী এক দুর্গের রক্ষক, অর্থাৎ রাজাই ছিলেন মহিষাসুর বা 'হুদুড় দুর্গা'। অসুর জাতির মতে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বলশালী এবং প্রজাবৎসল এক রাজা। আদিবাসীদের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী এক গৌরবর্ণা নারীকে দিয়ে তাদের রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল। রাজা মহিষাসুরের সময়ে নারীদের অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হত। এবং এরকম একজন রাজা কোনও নারীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না, বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না, এরকমটাই ধারণা ছিল আর্যদের। তাই তারা দুর্গাকে এই কাজে ব্যবহার করেছিলেন বলেই মনে করে আদিবাসী অসুর সমাজ।
আরও পড়ুন- দুর্গাদর্শক সবাই, দুর্গাদ্রষ্টা আছেন কেউ?
চিরাচরিত ভাবে দুর্গাপুজোর সময়টাতেই মহিষাসুরের জন্য শোক পালন করে থাকে এই আদিবাসী সমাজ। কোথাও অরন্ধন পালন করা হয়, কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে আদিবাসীরা, যাতে দুর্গাপুজোর সেই মন্ত্র বা ঢাকের শব্দ কোনোটাই তাদের কানে না যায়। দুর্গাপুজোর এই সময়ে তারা অশৌচ পালন করে এবং ভুয়াং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নাচ হয়। দাসাই নাচ করে তারা, যেখানে পুরুষরা নারী যোদ্ধার ছদ্মবেশ ধারণ করে কান্নার সুরে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তাদের গানটা এরকম— 'ওকার এদম ভুয়াং এদম জনম লেনা রে, ওকার এদম ভুয়াং এদম বছর লেনা রে'। তারা বিশ্বাস করে এই গানের মধ্যে যে প্রশ্ন আছে, তার উত্তর একমাত্র জানেন 'হুদুড় দুর্গা'। সে যদি এই গান শুনতে পায়, তাহলে জবাব দেবে এবং 'হুদুড় দুর্গা'কে তারা চিহ্নিত করতে পারবে। তারা 'বিন্দি' বা মাকড়সাকে বলে, 'ও বিন্দি, তোমরা কি কেউ আমার রাজাকে দেখেছ? আমাদের রাজাকে কোনও এক গৌরবর্ণা নারী চুরি করে নিয়ে গেছে'।
বর্তমান অবস্থা
অসুর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, মহিষাসুর তাদের পূর্বপুরুষ। তাই পূর্বপুরুষের হত্যাকারিণী দুর্গার মুখ দর্শন করা নিষেধ তাদের। বরং অসুর পুজো করে তারা। পুজোর ক'দিন বাড়ির চারপাশ কালো কাপড়ে ঘিরে রাখে শোকের চিহ্ন হিসেবে। তবে ধীরে ধীরে ছবি বদলাচ্ছে। খেলতে খেলতে সঙ্গীদের হাত ধরে পুজো মণ্ডপে পা রাখছে খুদেরা। কিশোর-কিশোরীরা গা ভাসাচ্ছে উৎসবে। শিথিল হচ্ছে আজন্মলালিত সংস্কারের বাঁধন। মাঝেরডাবরি চা-বাগানের এক অসুর জাতির আদিবাসী এ'প্রসঙ্গে বলেন, "আমরা মহিষাসুরের বংশধর। কয়েক বছর আগেও দুর্গাপুজোর পঞ্চমী থেকেই নিজেদের গৃহবন্দি করে রাখতাম আমরা। এখন ছেলেমেয়েরা আর সে সব মানছে না। এখন সময় বদলেছে। চা-বাগানের বাইরে বিভিন্ন কাজে যাচ্ছে অসুর সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা। পড়াশোনা শিখে বাগানের গণ্ডির বাইরে বের হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম সব দিক থেকেই আধুনিক হচ্ছে। তাই নিজেদের দেবতাতুল্য মহিষাসুরকে অবজ্ঞা না-করেও দেবী দুর্গার মণ্ডপে গিয়ে অঞ্জলি দিচ্ছে অসুর ছেলেমেয়েরা, প্রতিমা দেখতে বের হয়। মেলাতেও যায়"। বলাই বাহুল্য, পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রতি বছরের মত এবছরও দুর্গাপুজোর আনন্দে মাতবে 'অসুর'রা।

Whatsapp
