নাটকের চরিত্রের ফাঁসির বিরোধিতায় রাস্তায় মানুষ! কেন আজও পড়তেই হয় হুমায়ূন আহমেদ
Humayun Ahmed: রাস্তায় মিছিল নামল, “বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে,” স্লোগানও শোনা যেতে লাগল। আর এভাবেই হয়তো শিল্প মানুষকে সিমপ্যাথি থেকে এমপ্যাথির দিকে এগিয়ে দেয় কয়েক ধাপ।
হুমায়ূন আহমেদ। জীবন পথের পথিক, জীবন রসিক। দীর্ঘদিন ধরে কলমের জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছেন সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের। তাঁর ৭৪তম জন্মদিন পেরিয়ে এল বাঙালি পাঠক। মনের চোখ দিয়ে হুমায়ুন দেখেছেন জীবনকে। তাই লিখতে পেরেছেন, “দুনিয়াতে খুব অল্প কিছু মানুষ আছে, যারা আসলেই আলাদা। সারা জীবনেও তারা কারও আপন হতে পারে না; তাদের কেউই বুঝে না। তাদের সব থেকেও আসলে শূন্যতা ছাড়া তাদের কিছুই থাকে না। তারা একা আসে, একা ঘুরে, একাই থাকে, একাই চলে যায়!” জীবনের কঠিন সত্য, মানুষের মনের নানা রঙকে এভাবেই তো ফুটিয়ে তুলেছেন হুমায়ুন নিজের ক্যানভাসে। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্ম হুমায়ূন আহমেদের। সবাই অবশ্য ডাকত কাজল নামেই। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা আয়েশা ফয়েজ গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে কাজলই সবার বড়। তাঁর অন্য দুই ভাইও আগামীতে বরেণ্য ও প্রতিভাবান হয়ে জয় করেছেন মানুষের মন। কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তাঁর ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবিব বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন হুমায়ুন। তাঁর বিখ্যাত ‘হিমু’ সমগ্রের কথা জানেন না এমন মানুষ দুই বঙ্গেই কম! কথা সাহিত্যে- ‘নন্দিত নরকে’, ‘লীলাবতী', 'কবি', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'গৌরীপুর জংশন', 'নৃপতি', 'বহুব্রীহি', 'এইসব দিনরাত্রি', 'দারুচিনি দ্বীপ', 'শুভ্র', 'নক্ষত্রের রাত', 'কোথাও কেউ নেই', 'আগুনের পরশমণি', 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'জোছনা ও জননীর গল্প', এমন বহু মনোমুগ্ধকর উপন্যাস উপহার দিয়েছেন তিনি। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে তিনশো। 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস দিয়েই তাঁর অভিষেক ঘটে, সাড়া ফেলেন পাঠক মহলে।
আরও পড়ুন- মৃত ছেলের শোক নিয়েই বাটামাছের বিকিকিনি! গ্রামের হাটে-বাজারে নানা রঙের গল্প
এসব লেখনী জারিত চেতনা শুধু দুই মলাটে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এসে মিলে গেছে সেলুলয়েডের পর্দায়। নিজের উপন্যাসেরই নাট্যরূপ দেন হুমায়ূন আহমেদ। 'এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’- বাংলাদেশের টেলিভিশনের জগতে মাইলস্টোন বলা যায়, সেই জনপ্রিয়তা হয়তো আজও বর্তমান। এই সব নাটকের নাকি একটা পর্বও বাদ দেওয়া যায় না। একই রকমের চরিত্র, একই হেঁয়ালিপনায় ডোবা, নির্লিপ্ত সংলাপ—অল্প কথা কিন্তু ছুরির ফলার মতো।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে রাজাকারের পুনর্বাসনের হিড়িকে ‘তুই রাজাকার’ মুখে মুখে ফেরে। বহু কথা না বলে ছোট্ট দু’টি শব্দ নাটকে পাখির মুখ দিয়ে বলা হয়! নাটক অনেক বেশি টানে, পাঠও বাড়ে। লেখকের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে পাঠকের। তাঁর নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায় বাংলাদেশ। নাটকের চরিত্র বাকের ভাই, তার ফাঁসি হবে। মুনা কাঁদছে। কিন্তু দেখা গেল কাঁদছে সব দর্শক। বাকের ভাই যতই মস্তান হোক, মিথ্যা কেসে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। রাস্তায় মিছিল নামল, “বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে,” স্লোগানও শোনা যেতে লাগল। আর এভাবেই হয়তো শিল্প মানুষকে সিমপ্যাথি থেকে এমপ্যাথির দিকে এগিয়ে দেয় কয়েক ধাপ। সেই উত্তাল দামাল সময়কে নিজের কলমের পাশাপাশি টিভির পর্দাতেও ফুটিয়ে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। এছাড়াও, তাঁর সৃষ্ট নাটক 'আগুনের পরশমণি', 'শ্যামল ছায়া', 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী', 'চন্দ্রকথা', 'নয় নম্বর বিপদ সংকেত' ও 'ঘেঁটুপুত্র কমলা' দর্শকমহলে যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে।
আরও পড়ুন- দুঁদে গোয়েন্দা না বিচারপতি! অভিজিতের নতুন স্ট্র্যাটেজি হার মানাবে ফেলুদাকে
হুমায়ূন আহমেদ প্রকৃতই এক শিল্পী, এক রসিক মানুষ। কেবল সেলুলয়েডের জন্য নাটক লেখা নয়, নাটকের জন্য তিনি লিখেছেন গানও, আবার তাতে সুরও দিয়েছেন- যা আজও জনপ্রিয়। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো’, ‘চাঁদনী পসরে কে’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’, ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা’, ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা বেড়া ভাঙা চালার ফাঁকে’, ‘চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’ গান মানুষ আজীবন রেখে দিয়েছেন ভালোবেসে, নিজের প্রাণে।
স্বাভাবিকভাবেই হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও তাঁর পাঠকদের কৌতূহল ছিল শীর্ষে। বিশেষত তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনকে নিয়ে। মেহের আফরোজ শাওন একজন বাংলাদেশি অভিনেত্রী ও গায়িকা। ভালোবাসা বয়সের তোয়াক্কা করে না। ২০০৪ সালে সে কথা প্রমাণ করেন শাওন। ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বিয়ে করেন হুমায়ূন ও শাওন। তাঁদের রয়েছে দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত। কিন্তু খুব বেশিদিন শাওনের ঘর করা হয়না হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। দীর্ঘ ১০ মাস ক্যান্সারে ভোগার পরে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এই লেখক চিরনিদ্রায় শায়িত হন। শিল্পী চলে গেলেও তাঁর সৃষ্টি থেকে যায়। আর সেখানেই তাঁর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি করে বোঝা যায়। তাই প্রতিটা মুহূর্তেই পাঠক হৃদয়ে উদযাপিত হয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অস্তিত্ব।