পিস্তলের হোমডেলিভারি! হোয়াটস্যাপে যেভাবে হু হু করে বাড়ছে অবৈধ বন্দুক বিক্রি
Guns sale on WhatsApp: হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বন্দুক বিক্রি করে প্রতি মাসে ৪ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন উত্তরপ্রদেশের বিক্রেতারা।
হোয়াটস্যাপ যোগাযোগকে সহজতম করেছে, অস্বীকার করে লাভ নেই। শুধু সামাজিক নয়, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যোগাযোগও অত্যন্ত সুলভ এখন। হোয়াটস্যাপে বার্তা পাঠানো যায়, মেনু পাঠানো যায়, উপভোক্তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখা যায়, কেনাবেচাও করা যায়। বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে, হোর্ডিং দিয়ে, টিভিতে প্রচার করার চেয়ে আরও সহজে আরও নিবিড়ভাবে গ্রাহকের হাতের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে পণ্য। সে প্রসাধনী হোক বা ঘর সাজানোর জিনিস, খাবার হোক বা শাড়ি, ওষুধ হোক বা বন্দুক! হ্যাঁ, হোয়াটস্যাপে বন্দুকও কেনা যায়! আশ্চর্যের বিষয়, ভারতে ক্রমেই হোয়াটস্যাপে বাড়ছে বন্দুকের বিক্রি!
ধরা যাক উত্তরপ্রদেশের বন্দুক বিক্রেতা রাহুলের কথাই, বছর খানেক আগে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়াতে, আরও গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে প্রথম হোয়াটস্যাপ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তখন কেই বা জানত, এই মুহূর্তে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০টি ব্যবসায়িক প্রশ্ন পাবেন তিনি মেটা-মালিকানাধীন হোয়াটস্যাপে! রাহুল নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলিতে তাঁর পণ্যের ছবি পোস্ট করেন। কিছু গ্রুপ তাঁর নিজেরই তৈরি করা, কিছু গ্রুপে আবার লিঙ্ক পেয়ে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। ছবি পোস্ট করলেই সম্ভাব্য গ্রাহকরা সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, বন্দুক কিনতে চান। কেন এত মানুষ বন্দুক কিনতে চান তা নিয়ে অবশ্য খুব বেশি মাথা ঘামান না রাহুল। বলেন, "কেউ হয়তো কাউকে খুন করার জন্য কিনছে, কিন্তু আমাদের তারা বলে যে শুধুমাত্র নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কিনছে।”
আরও পড়ুন-সিনেমা বানাতে লাগে কেবল মহিলা এবং বন্দুক, কেন একথা বলেছিলেন জঁ লুক গোদার
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রের ডিজিটাল উইটনেস ল্যাবের অনুসন্ধান বলছে, ভারতে ক্রমেই বাড়ছে অবৈধ বন্দুকের বিক্রি। রাহুলের মতো অজস্র বিক্রেতা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করে চলেছেন হোয়াটস্যাপ মারফৎ। অথচ মেটার নীতিতে বলা আছে আগ্নেয়াস্ত্রের বিক্রয় বা বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, তা সত্ত্বেও রমরমিয়ে চলছে বিক্রিবাটা। মজার বিষয় হচ্ছে, অন্য অনেক দেশের চেয়ে কিন্তু ভারতে বন্দুকের মালিকানা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইন জারি রয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা এবং ব্যবসা করার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বন্দুক বিক্রেতারা ভারতের আইন লঙ্ঘন করেই এই ধরনের কেনাবেচা করে চলেছেন।
২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেশে লোকসভা নির্বাচন ঘটে গেছে। ডিজিটাল উইটনেস ল্যাবের গবেষকরা বলছেন, এই সময়কালে ভারতে ২৩৪টি হোয়াটস্যাপ গ্রুপে আগ্নেয়াস্ত্রের বিজ্ঞাপনের ৮,০০০ টিরও বেশি মেসেজ পাঠানো হয়েছে৷ গবেষকদের মতে, সমস্ত গ্রুপগুলিই 'ওপেন', অর্থাৎ যে কেউ তাতে জুড়তে পারেন। কিছু কিছু গ্রুপে কয়েকশ সদস্য রয়েছে। ডিজিটাল উইটনেস ল্যাবের তথ্য সাংবাদিক এবং ইঞ্জিনিয়ার সূর্য মাট্টু বলছেন হোয়াটস্যাপ এমন একটি মাত্রায় বন্দুক বিক্রি সক্ষম করছে যা এই প্ল্যাটফর্ম আসার আগে সম্ভবই ছিল না।
এর আগেও মেটা-র প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে ভারতে আগ্নেয়াস্ত্র বাণিজ্যের সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভারতই হলো হোয়াটস্যাপের সবচেয়ে বড় বাজার। ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী এদেশে হোয়াটস্যাপ ব্যবহার করেন। গত অক্টোবরেই, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অস্ত্র বিক্রি করে এমন একটি দলকে আটক করে। ২০২৩ সালে ধর্মীয় চরমপন্থীদের জন্য একটি ফোরামে বন্দুক কেনার প্রস্তাব দিয়ে বেশ কিছু পোস্ট করা হয়েছিল। মেটা ফেসবুক পোস্টগুলি সরিয়ে দেয়। বিশ্বব্যাপী একই ধরনের নানা অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে মেটা। ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, এমন অনেক উদাহরণই পাওয়া গেছে যেখানে দেখা গেছে যে মেটা বন্দুক, আনুষাঙ্গিক এবং গোলাবারুদের বিজ্ঞাপন অনুমোদন করেছিল। ইওরোপিয় ইউনিয়নে ওই বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল। ২০২২-এর আরেকটি গবেষণা সমীক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেটার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলিতে আগ্নেয়াস্ত্র-সম্পর্কিত অজস্র বিজ্ঞাপনের তালিকা তৈরি করে।
কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও ভারতে ব্যাপকভাবে দেশিয় পিস্তলের মতো অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন হয়। ২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ভারতীয় প্রশাসন যে ১০৪,৩৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছিল তার ৯৭ শতাংশই লাইসেন্সবিহীন এবং অপরিশোধিতভাবে তৈরি।
হোয়াটস্যাপে মেসেজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই প্ল্যাটফর্মের চ্যাটগুলি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্ট করা হয় কিন্তু ডিজিটাল উইটনেস ল্যাবের গবেষকরা ১২টি এমন উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন যেখানে গ্রুপের বিষয় এবং বর্ণনায় বন্দুক বিক্রির স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এটি এমন তথ্য যা হোয়াটস্যাপ চাইলেই নজরে রাখতে পারে। ডিজিটাল উইটনেস ল্যাবের গবেষকদের মতে, তাঁদের নজরে থাকা বন্দুকের বিজ্ঞাপন দেওয়া প্রায় অর্ধেক প্রোফাইলই ব্যবসায়িক প্রোফাইল। অথচ হোয়াটস্যাপের ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্ম নীতিতে স্পষ্ট বলা আছে এই অ্যাকাউন্টগুলি থেকে অস্ত্র সংক্রান্ত ব্যবসা নিষিদ্ধ।
২০২৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে বন্দুকের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ঢালাও। গবেষকরা দেখেছেন, এই একই গ্রুপে নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়বস্তুও পোস্ট করা হয়েছে। আর এই গোষ্ঠীগুলি প্রায় সব ক'টিই হিন্দুত্ব সমর্থকদের। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, অনেক বন্দুকের বিজ্ঞাপন এইভাবে শুরু হয়েছে, "রাম-রাম নমস্কার জিস মেরে ভাই কো সামান 🔫 চাহিয়ে"। গবেষকরা দেখেছেন, অনেক সদস্যই হিন্দু ডানপন্থী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক পোস্ট করেছেন তাঁরা। রাহুল নিজেই প্রায় ছয়-সাতটি গ্রুপ পরিচালনা করেন। প্রত্যেকটিতে ২০০ থেকে ১,০০০ জন সদস্য রয়েছে। সবাই কট্টর হিন্দু, জানিয়েছেন তিনি নিজেই।
আরও পড়ুন-বন্দুকের জয়গান গেয়েছে যে, বন্দুক আজ তাকেই তাক করছে
কিছু গ্রুপের নামকরণ করা হয়েছে কুখ্যাত গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নামে। ডিজিটাল উইটনেস ল্যাব হোয়াটস্যাপে এমন কথোপকথনও পেয়েছে যেখানে ব্যবহারকারীরা হয় ভাড়াটে খুনি বা সুপারি কিলার হিসাবে নিজেদেরকে তুলে ধরেছে, অথবা কোনও ভাড়াটে খুনির খোঁজ করেছে। বাড়িওয়ালাকে ভয় দেখাতে, স্ত্রীকে ভয় পাওয়াতে গুন্ডা খুঁজেছেন অনেকে।
বিশ্ব যেমন হাতের মুঠোয়, অস্ত্রও ঠিক সেভাবেই নাগালে চলে এসেছে মানুষের। পিৎজা আর পিস্তল দুই-ই দুয়ারে! হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ করলেই চলে আসছে বন্দুক! উত্তরপ্রদেশের বন্দুক বিক্রেতা রাহুল এবং দীপক ১৫ বছর ধরে অস্ত্রের ব্যবসা করছেন। দু'বার হোয়াটসঅ্যাপে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তারা। আর তাতেই সারা ভারত থেকে মানুষ খোঁজ করছেন বন্দুকের। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বন্দুক বিক্রি করে প্রতি মাসে ৪ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন এই বিক্রেতারা।
আশ্চর্যের বিষয় ভারতীয় পুলিশ এখনও এই অবৈধ বাণিজ্যের নাগালও পায়নি! রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ধন্য পুলিশের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবেই চুপ করে থাকার অভিযোগও আছে। আর মেটা বা হোয়াটস্যাপ? যার মাধ্যমে সারা ভারতে নিমেষে বন্দুকের খুল্লমখুল্লা বাণিজ্যের বিস্তার, দায় নেই তাদের? হোয়াটসঅ্যাপ এমন ভয়াবহ অভিযোগের দায়সারা উত্তর দিয়েছে। বলেছে, "যদি আমরা বেআইনি কাজ করা নেওয়া অ্যাকাউন্টগুলিকে শনাক্ত করতে পারি তবে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে নিষিদ্ধ করে দিই।" এমন উত্তরে হতাশাপূর্ণ হাসি ছাড়া কীই বা দেওয়ার থাকে আম নাগরিকের!