পাকিস্তান মানেই দুর্নীতি! ইমরান খানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে
ইমরান খানের গদিচ্যুতি হওয়ার পরেও ঠিক যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল তেহরিক-এ-ইনসাফ, তখনই এই ঘটনা সামনে আসা আবারও যে তাদের যথেষ্ট বিপদে ফেলবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর আসন চলে যাওয়ার পর অভিযোগ তুলেছিলেন বিদেশি ষড়যন্ত্রের। কিন্তু সময়ের চাকা এগোতেই দেখা যাচ্ছে অন্য ছবি। জানা যাচ্ছে, পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ, যা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল, তারা আইন-বহির্ভূতভাবে অর্থ সংগ্রহ করেছে, যা এসেছে বিদেশ থেকে।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছে যেখানে সেই সব অর্থদাতাদের তথ্য রয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ইন্দো-আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার, রমিতা শেট্টি। যিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর দেওয়া অনুদানের অঙ্ক হলো ১৩,৭৫০ ডলার। নির্বাচন কমিশন এই ধরনের অনুদানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যদি ইমরানের দল পিটিআই এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে, ইমরান খানের দল বেআইনিভাবে সাত মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশি অনুদান গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে সিংহভাগই এসেছে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং কানাডা থেকে। অস্বচ্ছ কিছু ট্রাস্টি, এবং বেনামে খোলা কোম্পানির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে এই টাকা। বিগত সাত বছর ধরে এই বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং তাদের অভিযোগ, পুরো বিষয়টাতে দেরি হয়েছে শুধু মাত্র ইমরানের দলের কারণে। এখনও পর্যন্ত ৩৪টি অনুদান চিহ্নিত করে বেআইনি ঘোষণা করেছে তারা।
আরও পড়ুন: চরমে কাগজ সংকট, বই নেই পড়ুয়াদের! পাকিস্তান এগোচ্ছে শ্রীলঙ্কার পথেই?
পাক ব্যবসায়ী আরিফ খানের সংযুক্ত আরব এমিরেটসের ভুউটন ক্রিকেট লিমিটেডের ওপরও নজর রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। জানা যাচ্ছে, সেই সংস্থা থেকে ২১,৫১,৫০০ ডলার অনুদান পেয়েছে তেহরিক-এ-ইনসাফ।
এছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাঁরা অনুদান দিয়েছেন, তাঁদের তথ্যও সামনে এসেছে। তাঁদের মধ্যে একজন সুইজারল্যান্ডের ই-প্ল্যানেট ট্রাস্টির নাম করে এক লক্ষ ডলার পাঠিয়েছেন। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটির নথি সুইজারল্যান্ড বললেও এটি আসলে কেম্যান আইল্যান্ডের। যেখান থেকে অনুদান নেওয়া এমনিতেই নিষিদ্ধ পাকিস্তানে।
আরও এক তাৎপর্যপূর্ণ অনুদানকারীর খোঁজ পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। মজিদ বসির নামের একজন ব্যক্তি, যিনি দুবাই-এর ব্রিস্টল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের মালিক, তিনি ২০১৩ সালে ৫০,০০০ ডলার পাঠিয়েছিলেন। দুবাই-এর আইন অনুযায়ীও এইভাবে রাজনৈতিক দলের তহবিলে অর্থ পাঠানো নিষিদ্ধ।
এছাড়াও টাকা এসেছে ম্যানচেস্টার থেকে, অস্ট্রেলিয়া থেকে। নির্বাচন কমিশন পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে প্রায় তেরোটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খোঁজ পেয়েছে, যেখানে আরও এক মিলিয়ন ডলারের অনুদান ঢুকেছে। পিটিআই এখন সেই গুলির মালিকানা অস্বীকার করলেও নির্বাচন কমিশনের হাতে আসা নথি তা হতে দিচ্ছে না। মালিকানা রয়েছে পিটিআই পাঞ্জাবের বেশ কিছু নেতার। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সম্প্রতি সেই রাজ্যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে ইমরানের দল।
আমরা যদি একটু পিছনে ফিরে যাই, যখন ইমরানের সরকার ক্ষমতায়, তখনই দেখা যাবে যে, আর্থিক দুর্নীতি এবং টাকা পাচারের অভিযোগে কী মারাত্মকভাবে জর্জরিত ছিলেন ইমরান। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সময় প্রায় ৬০০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খোঁজ পাওয়া যায়, যার সঙ্গে সরাসরি নাম জড়িয়ে ১৪০০ পাকিস্তানি নাগরিকের। তাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন আইএসআই-এর প্রাক্তন প্রধান, তেমনই ছিলেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। অভিযোগ এতটাই গুরুতর ছিল যে, তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী চৌধুরী ফাওয়াদ হুসেন পর্যন্ত বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, আর্থিক দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে।
২০১৬ সালের পানামা পেপারস, ২০১৭ সালের প্যারাডাইস পেপারস এবং ২০২১ সালের প্যান্ডোরা পেপারস-এর ঘটনা সামনে আসা ওই সব অভিযোগকেই স্বীকৃতি দেয়। তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ধরনের বেআইনি আর্থিক কার্যকলাপ, এই টাকা পাচার করার খবর সামনে আসা আরও ভয়ঙ্কর একটি দিক তুলে ধরে। তা হলো সন্ত্রাসবাদ দমন করতে পাকিস্তানের সদিচ্ছার অভাব। অনেকেই আশঙ্কা করেছেন যে, এইসব অর্থে লাভবান হয়েছে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী এবং উগ্রপন্থী সংগঠনও।
আরও একটি ঘটনা নিয়ে আবারও জোর চর্চা চলছে। তা হলো, জনৈক আরিফ নকভির গ্রেফতারি। তিনি আবাজ গ্রুপ নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আর্থিক দুর্নীতির, প্রতারণার। তিনি শুধুমাত্র ব্রিটেনেই দোষী সাব্যস্ত হননি, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে আমেরিকাতেও। শোনা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডে গৃহবন্দি নকভি-র বিরুদ্ধে এতটাই গুরুতর অভিযোগ আছে যে আমেরিকার কোর্ট তাকে ২৯০ বছর পর্যন্ত জেলের সাজা দিতে পারে।
সেই আরিফ নকভি ২০১৩ সালে ইমরানকে বাইশ মিলিয়ন ডলারও পাঠিয়েছিলেন, যা পিটিআই-এর নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত হয়। বিষয়টি শুধুমাত্র এই বাইশ মিলিয়নেই থেমে নেই। ইমরান এবং নকভির যোগাযোগ হয় নয়ের দশকেই এবং তখন থেকেই নাকি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে নকভি জড়িত। উঠে আসছে একটি বিশাল অঙ্কের দুর্নীতির কথা, যা প্রমাণিত হলে বড়সড় বিপদের মুখে পড়তে পারেন ইমরান। দুর্নীতির অঙ্ক প্রায় ২৫০ মিলিয়ন।
তবে ইমরান খানের গদিচ্যুতি হওয়ার পরেও ঠিক যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল তেহরিক-এ-ইনসাফ, তখনই এই ঘটনা সামনে আসা আবারও যে তাদের যথেষ্ট বিপদে ফেলবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তদন্ত সবে শুরু হয়েছে এবং সামনে আসতে পারে অনেককিছুই, যা ইমরানকে জেলের দরজাও দেখাতে পারে। পড়শি দেশ ভারতে এই ধরনের দুর্নীতির খবর বিশেষ প্রভাব ফেলে না। অন্তত ভোটবাক্সে। পাকিস্তানের ইতিহাসও অন্যরকম কিছু বলছে না। দেখা যাক, ইতিহাস পাল্টায় কিনা।