আজও বিসর্জনে মিলে যায় দুই বাংলা! কেমন ছিল এবারের ইছামতীর ভাসান?
Durgapuja 2022: বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতির ইতিহাস বহন করে চলেছে দুই বাংলার ইছামতি।
বিসর্জন। বিজয়ার শুভ আবহে আর উমা-বিদায়ের সামগ্রিক চিত্রে, আজও ইতিহাস বহন করে চলেছে উত্তর ২৪ পরগনার টাকি। করোনাকালে খানকিটা থমকে যাওয়ার পরে এবছর ফের উদযাপিত হলো ৩০০ বছরের ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আগেই যে প্রথার উদ্ভব হয়েছিল, তা আজও বহমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রীতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে ভাবনাও কিন্তু আজও সেই ইতিহাসই বহন করে চলেছে দুই বাংলার ইছামতি। কালিন্দী, ইছামতি আর বিদ্যাধরীর মিলনক্ষেত্র আজও দেখিয়ে চলেছে সম্প্রীতির ছবি।
বিসর্জন ইতিহাসে টাকি
কচু শাক আর পান্তাভাত। সঙ্গে চালতার চাটনি। আজও দশমীর সকালে কৈলাশের উমার পাতে পড়ে এই পদ। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সন্তান-সন্ততি সমেত প্রায় ২৬ বেয়ারার কাঁধে চাপেন ঘোষ বাড়ির মেয়ে। গন্তব্য কৈলাশের শ্বশুরবাড়ি। ইছামতির রাজবাড়ির ঘাটে নৌকা ধরেন দেবী। সঙ্গে বাকিরাও। তারপর নদীবক্ষে চক্কর কেটে মাঝ নদীতে বিলীন হন দেবী দুর্গা। ৩০০ বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি। জলের মাঝেই বিলীন হন মা, মিলে যায় দুই দেশ। রাশি রাশি মানুষের স্পর্শে মিলিত হয় দুই বাংলা।
জানা যায়, মুঘল সাম্রাজ্যে শুরু হয় এই পুজো এবং বিসর্জনের শুরু হয় তখন থেকেই। জমিদার হরিনারায়ণ ঘোষ, তাঁর নিজের বাড়িতে পুজো শুরু করেন ৩০০ বছর আগে। অবিভক্ত বাংলায় এই পুজো ছিল অনেকাংশেই সর্বজনীন। নদী পেরিয়ে মিলে উপস্থিত হতেন সকলেই। অবিভক্ত বাংলার ছত্রে ছত্রে বিরচিত হতো এই পুজো এবং ভাসান।
আরও পড়ুন: দশমীর সঙ্গে কেন জুড়ে রয়েছে ‘বিজয়া’? বিজয়া দশমীর অজানা সব কাহিনি…
জমিদারবাড়ির পুজোর প্রথা অন্যদের থেকে ভিন্ন। জানা যায়, অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা শুধু নয়, মায়ের ভোগের ক্ষেত্রে আজও থাকে মৌলিকত্ব। এখানে রান্না করে ভোগ নিবেদন করা হয় না দেবীকে। দুর্গার জন্য থাকে গোটা এবং কাঁচা সবজির ব্যবস্থা। নবমীর দিন মহিষ বলি দেওয়া হত এই পুজোয়। যা বন্ধ হয়েছে পরে। দূর-দূরান্ত থেকে সেই বলি দেখতে দুই বাংলার মানুষ আসতেন। সেই জাঁকজমক এখন প্রায় লুপ্ত। সীমান্তে বেড়েছে বিধিনিষেধ। তাই আর আসতে পারেন না অনেকেই। এখন নবমীর দিন এই মহিষের বদলে জমিদারবাড়িতে বলি দেওয়া হয় চালকুমড়ার।
যদিও পুরনো রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাপের একচালার প্রতিমা তৈরি হয় এখনও। ডাকের সাজে সাজানো হয় দুর্গামূর্তি। দু’পাশে থাকে হাতপাখার বাতাস দেওয়ার ব্যবস্থা। পুবের বাড়ি অর্থাৎ ঘোষ বাড়ির প্রতিমার চক্ষুদান হয় মহালয়ায়। এদিকে এই বাড়ির পুজোয় সন্ধিপুজোর আগে এক প্রসাদী ডালা দিয়ে পুজো দেওয়া হয় কুলেশ্বরী কালী বাড়িতে।
শুধু আচার নয়, এই পুজোয় রয়েছে ইতিহাসের খোঁজও। বলা হয়, এই পুজোতে নাকি আসতেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শরৎ বসুরা এই পুজোয় উপস্থিত হতেন বলে জানা যায়।
কথিত আছে, টাকির জমিদারের লাঠি আর গোবরডাঙার জমিদারের হাতি ছিল বিখ্যাত। একবার নাকি টাকির জমিদার মতিলাল ঘোষ ৭ ডাকাত পিটিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
আজও জমিদারবাড়ির দুর্গা ভাসানের সঙ্গেই শুরু হয় অন্যান্য বাড়ির ভাসান। আর এখানেই টাকির সমগ্র ভাসান ইতিহাসে মুখ্য ভূমিকা পালন করে পূবের বাড়ি। সমগ্র মিলনক্ষেত্র এবং দুই পাড়ের মানুষের জন্য এই ৩০০ বছরের ইতিহাস আবর্তিত হয়ে আসছে ঘোষবাড়ির সূত্রেই।
টাকির জমিদারবাড়ির পলেস্তরা খসা, ভগ্নপ্রায় দুর্গা দালানের মায়ের বিসর্জনেই সূচিত হয়ে আসছে সবটা। ঘোষদের বাড়ির প্রতিমা নৌকায় ওঠার পরে একে একে নদীবক্ষে উপস্থিত হন মুখার্জিবাড়ি, রায়চৌধুরী-সহ একাধিক বাড়ির প্রতিমা। একটু বেলা গড়াতেই শোভাযাত্রা সমেত সিতুবাবুর ঘাটে পৌঁছয় বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা। যা ৫০ বছর আগে থেকে চলে আসছে। এর আগে শুধুমাত্র বাড়ির পুজোর আধিক্য ছিল টাকিতে।
এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে বিসর্জন। ইছামতির দুই পাড়ে দুই বাংলার মানুষের ঢল নামে এদিন। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের কোলাহল আর নদীবক্ষে নৌকার চলমানতায় সাঙ্গ হয় বিসর্জনের পালা।
এবারের টাকি
২০১৯ সালের আবহ ফের ফিরেছিল ২০২২-এ এসে। কারণ, করোনা আবহে জাঁকজমক বন্ধ ছিল গত বছরেও। শুধুমাত্র উদ্যোক্তাদের হাতে গোনা কয়েকজন এবং বাড়ির পুজোর ক্ষেত্রে গুটিকয়েক সদস্যের উপস্থিতিতে হয় বিসর্জন। খুব একটা ভিড় জমার ক্ষেত্রেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। এবারের পরিস্থিতি ছিল একেবারে আলাদা। জমায়েতের ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না এদিন। টাকি রেল স্টেশন থেকেই যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল একাধিক ক্ষেত্রে। জায়গায় পুলিশ পিকেট। এর সঙ্গেই ছিল কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ান সারা বছর এই এলাকায় মোতায়েন থাকলেও বিসর্জনের দিন টাকি সরকারি মহাবিদ্যালয়, টাকি গ্রামীণ হাসপাতাল এলাকাতেও কড়া পাহারায় ছিল বিএসএফ। ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে নজরদারি। এবং ইছামতীতে স্পিড বোট, লঞ্চে করে নজরদারি ছিল চোখে পড়ার মতো। ছিল পর্যাপ্ত ডুবুরির ব্যবস্থাও। সাধারণ দর্শনার্থীদের গত বছর নৌকায় চড়ে বিসর্জন দেখার সুযোগ না থাকলেও এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। মাথাপিছু বোট অনুযায়ী ভাড়া ছিল ৫০০ অথবা ১০০০ অথবা সমগ্র বোট ভাড়া ৯০০০ টাকা। টিকিট কেটে নৌকা চড়ে ভাসান দেখতে পেরেছেন সকলেই। কিন্তু সীমান্ত খুলে দেওয়ার যে রেওয়াজ বন্ধ করে দেওয়া হয় বহুদিন আগেই, তা বজায় ছিল এই বছরেও। অর্থাৎ নদীবক্ষের মাঝ বরাবর ভ্রমণের অনুমতি থাকলেও বাংলাদেশের দিকে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখে বিএসএফ এবং বিডিআর। শুধু নৌকা করেই ভাসান দর্শন নয়, নদীর দুই পাড়ে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
টাকির বিসর্জনে উন্মাদনা
কেউ এসেছেন সুদূর উত্তর কলকাতা থেকে, কেউ হুগলি জেলার ডানকুনি থেকে। টাকির বিসর্জনে মেতে উঠতে হাওড়ার বাউড়িয়া, বাগনান থেকেও এসেছেন কেউ কেউ। আশপাশের শুধু নয়, বারাসাত, বসিরহাট আর কলকাতা, মিলেমিশে একাকার হয় বিসর্জনের টাকি। কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়ে মুখরিত হয় ইছামতির দুই পাড়। উত্তর কলকাতার হেদুয়া থেকে এসেছিলেন সুব্রত দাস। ইনস্ক্রিপ্ট-কে তিনি জানান, "ভীষণ ভালো একটা অভিজ্ঞতা হল। নৌকায় বসে চারদিকে জল আর নৌকার মাঝে মায়ের মূর্তি। দুই বাংলার মিলনক্ষেত্র মনে হচ্ছিল। বারাসত থেকে এসেছিলেন অমিত মল্লিক। তাঁর কথায়, "আগেও এসেছি। গত দু'বছর আসতে পারিনি। এর বিশেষত্ব বলে বোঝানোর নয়, তবে এক দিনের জন্য জল সীমান্ত খোলার ব্যবস্থা আবার চালু হলে খুব ভালো।'' রাজেশ্বরী লাহিড়ী এসেছেন গড়িয়া থেকে। তাঁর কথায়, "আমার মায়ের পরিবারের অনেকেই বাংলাদেশের। আমার যাওয়া হয়নি কোনও দিন। কিন্তু টাকির ভাসান খানিকটা নস্টালজিক করে দিল।"
জোরদার নিরাপত্তা আর করোনা হটিয়ে এবার নতুনভাবে মেতেছে টাকি। কী বলছেন পুলিশ আধিকারিকরা? বসিরহাট পুলিশ জেলার এক আধিকারিক বলেন, "এই অঞ্চলের অর্থাৎ বিসর্জন ক্ষেত্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিএসএফের হাতে অনেকটাই। আমাদের হাতে ঠিক যতটা বা যা যা করণীয়, সব করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বিন্দুমাত্র অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।''
নৌকার মাঝি রতন রুইদাস। তাঁর কথায়, "সারাদিন মায়ের ভাসান আর মানুষ টানি জলে। একটু দূরেই তিন নদীর মিলন স্থলেও যায়। নৌকা চালায়। সব ভালো, তবে কিছু দর্শনার্থীদের নিয়ে ভয় হয়। অযথা ঝুঁকে থাকা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ!''
সব মিলিয়ে আবার ভালো আছে টাকি। ফের ইতিহাস, আভিজাত্য আর দুই বাংলার মিলন মেলায় ভালো আছে বিসর্জন, সুখে আছে উৎসবও। এই একাত্ম শুধু হিন্দুর নয়, এখানে টোটো চালক রহিম আলির সঙ্গেই মিশে যায় নৌকার মাঝি রতন। এখানেই আইস্ক্রিম বিক্রেতা জহিরুলের সঙ্গে মেতে ওঠে আমজাদ, দীপঙ্কররা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে টাকির দশমী শুধু মাতৃ-বিজয়া নয়, এই বিসর্জন দুই দেশের। টাকি, অযাচিত বিচ্ছেদের আবহেই যেন ফের বলে ওঠে, আমরা সবাই এক, আমাদের এই ভাসান রাজত্বে।