হিন্দু কলেজ থেকে প্রেসিডেন্সি, ফিরে দেখা ভালোবাসা আর মেধাবৃত্তির আঁতুড়ঘরকে

ভালবাসা মন্দবাসার শহর কল্লোলিনী কলকাতা। ডিসেম্বরের শহরে প্রেমের উষ্ণতা গায়ে মেখে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ছুটে চলেন শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিম উত্তর থেকে দক্ষিণে। প্রেমের শহর ভালোবাসার শহর এই কল্লোলিনী তিলোত্তমা - দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসকে সঙ্গী করে। এখানে ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে। কলকাতা শহরে প্রতিনিয়ত রচিত হয় হাজারো ইতিহাস আর অজানা গল্প। একবার এর ভেতরে ডুব দিয়ে দেখলেই, খোঁজ মিলবে সাক্ষাৎ ঠাকুমার ঝুলির।

২০ জানুয়ারি, ২০২২ - আজকের দিনে এমন এক ইতিহাসের মুখোমুখি শহর কলকাতা, আরো ভালোভাবে বলতে গেলে ইতিহাসের সম্মুখীন ৮৬/১ কলেজ স্ট্রিট। এই ইতিহাস শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করার ইতিহাস, প্রতিস্পর্ধার ইতিহাস, নবজাগরণের ইতিহাস।' আঠারো বছর বয়স ' - কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখে গিয়েছিলেন -

"আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ / স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলার ঝুঁকি/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।"

আজ প্রেসিডেন্সির জন্মদিন। প্রিয়তমার বয়স এখন ২০৫। তবু যেন প্রথম আলাপের দিনটির মতোই আজও নবযৌবনের উদ্ধত প্রতীক সে, সর্বক্ষণ লিখে চলেছে দুরন্ত এক ইতিহাস - এই ইতিহাস স্পর্ধায় মাথা তোলার গল্প বলে, শাসককে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করার গল্প বলে। ঠিক আঠারো বছর বয়সের মতোই।

কবীর সুমনের বহুপরিচিত গানটার মতোই প্রেসিডেন্সি বহু কিছুর সাক্ষী। প্রথম প্রেম, প্রথম রাজনীতি, প্রথম স্লোগান, প্রথম সিগারেট অথবা প্রথম চুমু। ডিরোজিও থেকে সুভাষ অনেকেরই জীবনে বসন্তদিনের আনাগোনা এই প্রেসিডেন্সির হাত ধরেই। উত্তাল সত্তর দশকের ইতিবৃত্তও রচিত হয়েছে এই প্রেসিডেন্সির বুকে। লাল পতাকা আর বিপ্লবের স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকা প্রেমিককে হারিয়ে না জানি কতবার শোকাতুরা হয়েছে প্রিয়তমা। আজ ইতিহাসের পাতা উলটে ফিরে যাওয়া যাক প্রেসিডেন্সির অতীত দিনগুলোর কাছে।

সালটা ১৮১৭। নবজাগরণের হাওয়া তখন ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে গোটা বাংলায়। যদিও তখনও পর্যন্ত বাংলার উচ্চবিত্ত কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেই হাওয়া। ইংরেজ কর্মচারীরা ভারতে আসছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য, তাদের উপরই অর্পিত হচ্ছে দেশের শাসনভার। এমন সময় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি গরানহাটার গোরাচাঁদ বসাকের বাসভবন ভাড়া নিয়ে পথচলা শুরু করলো একটি স্কুল। যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন - রাধাকান্ত দেব, ডেভিড হেয়ার, এডওয়ার্ড হাইড, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ। সেই শুরু জয়যাত্রার, মাত্র কুড়িজন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা, আজ তা কালক্রমে পরিণত হয়েছে বটবৃক্ষে। তবে শুধু হিন্দু কলেজের ইতিহাস নয়,  হিন্দু কলেজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক মনীষীর জীবনের অনালোচিত একটি অধ্যায় স্মরণ করতেই হয় এই প্রতিষ্ঠানের জন্মদিনে।

আরও পড়ুন-সিঙ্গুরের ডাকাত কালী, ৫৫০ বছর পেরিয়ে আজও জেগে আছে ভয়াল এক ইতিহাস

১৮০৯ সাল। কলকাতার এন্টালী অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করলেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্নিপুরুষ ডিরোজিও। এই ডিরোজিওর শিক্ষক ছিলেন ডেভিড ড্রামড। ডিরোজিওকে যুক্তিবাদী চিন্তাধারার বীজমন্ত্র দিয়ে দীক্ষিত করলেন ডেভিড। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলেন ডিরোজিও।

এরপর আবার ফিরে যাওয়া যাক প্রেসিডেন্সির ইতিহাসে।১৮২৪ সালের ২৫  ফেব্রুয়ারি গোলদিঘির কাছে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো হিন্দু কলেজের । ততদিনে নাম ছড়িয়েছে বেশ কিছুটা। ১৮২৬ সালের ১ মে নতুন ভবনে শুরু হলো হিন্দু কলেজের ক্লাস। না, নবজাগরণের হাওয়া বোধহয় হিন্দু ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের পক্ষে তখন বেশ ক্ষতিকর ছিল। তাই হিন্দু ধর্মালম্বী ব্যতীত অন্য কোনও সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় হিন্দু কলেজে।

বাধা বেশিদিন টেকেনি। নবজাগরণের ঢেউ তখন  ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে। তার কাছে এই বাধা তো বালির প্রাচীর মাত্র।১৮২৮ সালে ডিরোজিওর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা হলো একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত তারা। ডিরোজিও এবং তার বেশ কয়েকজন ছাত্র তৎকালীন সময়ে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেন। হিন্দু ধর্মের মিথ্যাচার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, নারী স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিলেন তারা। ১৮৩৯ সাল নাগাদ বিলুপ্তি ঘটলো অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামক প্রতিষ্ঠানটির। তবে তার আগেই ঘটে গিয়েছে এক সাড়া জাগানো ঘটনা। হিন্দু ধর্মের মুখোশ খুলে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন ডিরোজিও-সহ তার ছাত্রদল। যারা ভূষিত হতেন নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল নামে। কিন্তু তখনকার দিনে এই হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করা গুরুতর অপরাধ। ফল ভুগতে হল ডিরোজিওকেও। হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব আনা হলো তার বিরুদ্ধে। প্রস্তাব পাশও হয়ে গেল ৬-১ ভোটে। বহিষ্কার করা হল এক যুবক অধ্যাপককে। যিনি প্রশ্ন করেছিলেন অন্ধত্বে ডুবে থাকা সমাজনীতিকে, প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন যুক্তিবাদী মানসিকতার।

১৮৫৫ সালের ১৫ ই জুন - এক ঐতিহাসিক দিনের  সাক্ষী থাকলো হিন্দু কলেজ। তার বহু আগে থেকেই দাবি উঠেছিল হিন্দু কলেজে প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বধর্মের সমান অধিকারের।১৮৫৫ সালে নাম পরিবর্তিত হলো হিন্দু কলেজের, নাম বদলে হলো প্রেসিডেন্সি। না, ডিরোজিও দেখে যেতে পারেননি। অনেকটা আগেই মৃত্যু ঘটেছে তার। কিন্তু ওই যে বলে বিপ্লবীর মৃত্যু হয়, বিপ্লবের নয়। সেই মশাল আজও জ্বলছে।

আজ যখন সমগ্র দেশে ধর্মান্ধতার আগুন জ্বলে উঠছে ভয়ংকরভাবে, প্রেসিডেন্সি গর্জে উঠছে বারংবার। এমনকী লকডাউনের সময়েও বহু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র পথে নেমে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রেম, পলিটিক্স , পড়াশোনা এই তিনের মেলবন্ধনে বারংবার আঠারো নেমে আসে প্রেসিডেন্সির বুকে। প্রেসিডেন্সিয়ানরা চায় আগামী প্রজন্ম যেন বারংবার বলতে পারে - "প্রিয়তমা তোমার জন্য বুকের আগুন জমিয়ে রাখি...।" প্রেসিডেন্সির নবপ্রজন্ম যেন শুধু বৃষ্টিপাত নয়, দরকারে বজ্রপাত ভাগ করে নিতে পারে।

তথ্যসূত্র : -

১. ' হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত ' - রাজনারায়ণ বসু

২. ' হিন্দু তকমা ঘোচাতেই প্রেসিডেন্সি ' - গৌতম বসুমল্লিক।

৩. https://banglaamarpran567383012.wpcomstaging.com/untold-story-of-henry-louis-vivian-derozio/

More Articles