ভেজালের ভিড়ে হাপিস খাঁটি খেজুর গুড়! অবহেলা না কি প্রতিযোগিতার চাপ?

Nalen Gur: প্রতিযোগিতার বাজারে দাম কম রাখতেই কি ভেজাল মেশে গুড়ে?

প্রকৃতিতে এখন উত্তুরে হিমেল বাতাস। চারদিকে ছুঁয়েছে শীতের আমেজ। বাংলায় শীত অবশ্য একা আসে না কোনোদিনই, সঙ্গে করে নিয়ে আসে নানান অনুষঙ্গকে। শীতের মরসুম মানেই বাঙালি বাড়িতে সাজো সাজো রব। বিয়ে, ঘুরতে যাওয়া নিদেনপক্ষে পিকনিক, বছরের এ কটা দিন যেন চেটেপুটে উপভোগ করাটাই দস্তুর। আর এসবের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে পেটপুজো। শীতের খাবার নিয়ে আলোচনা শুরু হলে, একটা লম্বা ইস্তেহার হবে নিশ্চিত। যদিও সে ইস্তেহারের শুরুতেই জায়গা করে নেবে নলেন গুড়। শীতকালের জন্য বাঙালির সারা বছর হাপিত্যেশ করে থাকার একটা বড় কারণ এই নলেন গুড়। সোনালি রঙের পাতলা গুড়, আহা তার যা স্বাদ, তেমনি সুমধুর গন্ধ! মন হারাতে বাধ্য। মন হারাক ক্ষতি নেই, তবে জ্ঞান হারালে মুশকিল। তাই জেনে নেওয়া দরকার যা কিনছি তা খাঁটি গুড় তো?

রাস্তার একপাশে পরপর সাজানো কয়েকখানা ঝুড়ি। আর তার মধ্যে খবরের কাগজের মোড়কে ঠাসা পাটালি। তা থেকে আসছে মন মাতানো গন্ধ। পথচলতি মানুষের চোখ না পড়ে উপায় কি! কাছে গেলেই অবাক হতে হয়। কোনওটার গায়ে লেখা ৮০ টাকা প্রতি কেজি, কোনওটা ১০০, কোনওটা আবার ২০০ টাকা কেজি। বাজারে আলু অথবা চাল কিনতে গিয়ে হামেশাই এমন বিভিন্ন দামের একই জিনিস নজরে পড়ে ঠিকই, কিন্তু পাটালির ক্ষেত্রে এমন হওয়ার তো কথা নয়। তবে রহস্যটা কী?

পঞ্চাশ কেজি খেজুর রসে মাত্র পাঁচ কেজি গুড় হয়। তার দাম কম করে হাজার টাকা হওয়া উচিত। অর্থাৎ কেজি প্রতি দু’শো টাকা। কিন্তু অতো দাম হাঁকলে কিনতে চান না অনেকেই। তাই প্রতিযোগিতার বাজারে দাম কম রাখতেই হয়। ব্যাস, তখনই তাতে ভেজাল মেশে। আর কারচুপির দরজাটা যখন একবার খুলে যায় তাকে আর বাধ দেয় কার সাধ্যি!

আরও পড়ুন : নলেনের স্বাদ নোনতা! শেষ পাতে গুড়ের বদলে কেমিক্যাল খাবে বাঙালি?

আজ বলে নয়, কবি তো কবেই বলে গিয়েছেন, “ভেজাল ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায় / ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়...”। অর্থাৎ এমন একটা সময়ের মধ্যে দিনে দিনে ঢুকে পড়েছি আমরা যেখানে লাভের ফিকির খুঁজতে গিয়ে পা আটকে গিয়েছে অচিরেই। বেরোবার পথ একপ্রকার ভুলতে বসেছি। এ এক অদ্ভুত নেশা। ব্যবসায়ীরা খানিক অর্থ লাভের আশায় অথবা ক্রেতারা খানিক সাশ্রয়ের আশায় ক্রমাগত শান দিচ্ছি ভেজাল অস্ত্রেই।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে কখন যে হেঁশেলেও জাঁকিয়ে বসেছে ভেজাল, তা আর আলাদা করে লক্ষ্য করিনি কেউই। পাটালিও তাই দেদার বিকোচ্ছে ভেজাল রূপেই। আর বাঙালি ভাবছে, যাক টাকা তো বাঁচল, এই ঢের! কিন্তু এ দায় কার? এই যে একটা গোটা প্রজন্ম অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে তা নিয়ে সরকারের বক্তব্যই বা কি? নাকি “এমনটা তো হয়েই থাকে!” বলে দায় ঝেড়ে ফেলাটাই অন্যতম কাজ? গুড় ব্যবসায়ীদের কথায় জানা যায়, এ ব্যবসার খরচ ঢের। প্রথমে লিজে নিতে হয় খেজুর গাছ। তারপর সেই রস ফোটাতে শ্রমিকের বেতন আছে। আছে প্রচুর জ্বালানি খরচও। আবার গুড় তৈরি করে তা বাজারে পাঠানোর খরচও কিছু কম নয়। ফলে লাভ খুঁজতে ভেজালকেই একমাত্র পথ করে নিতে হয় তাদের। তবে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং অনুদান থাকলে যে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলাতে পারে এমনটাও মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

জানা যায়, খাঁটি গুড়ে পাটালি হয় না। তাতে অন্তত একটু হলেও খাবার সোডা মেশাতেই হয়। তবে সহজ উপায় হল চিনি মেশানো। বাজারে তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায় মিহি চিনি। পঞ্চাশ কেজি খেজুর রসে ছ’কেজি পর্যন্ত চিনি মেশানো হয়। তাতে ১১-১২ কেজি গুড় মেলে। সেই গুড় আশি অথবা একশো কুড়ি টাকা দরে বিক্রি করে বিক্রেতারা। কিন্তু এতে হয় অন্য বিপদ, চিনির ঠেলায় গুড়ের গন্ধ তলানিতে, তাই ডাক পড়ে কৃত্রিম এসেন্সের। ব্যাস এখানেই ঘটে যায় বিপত্তি। মেশানো হয় নলেন গুড়ের সুবাসিত গন্ধ-সমৃদ্ধ প্রোপিলিং গ্লাইকল নামে কৃত্রিম রাসায়নিক। এছাড়াও ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে না পড়া পর্যন্ত নলেন গুড় বাজারে আসে না। অথচ দোকানে সারা বছরই মিলছে পাটালি। চাহিদাও থাকছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে ভেজাল গুড়ের কারবার। বাজার ছেয়ে গিয়েছে হাইড্রোজ, ফটকিরি, ক্যালশিয়াম-বাই-কার্বনেট ইত্যাদি সহযোগে তৈরি পাটালিতে।

আরও পড়ুন : খেজুর গাছে ঝুলে আছে ফাঁকা হাঁড়ি, কোথায় গেলেন বাংলার শিউলিরা?

এই পরিস্থিতিতে কীভাবে আসল নলেন গুড় চিনবেন জেনে নিন…

গন্ধ শুঁকে নয়, পাটালি চিনতে হবে হাতে নিয়ে পরখ করেই। খেঁজুর গুড়ের পাটালি কিছুদিন বাড়িতে রেখে দিলে তার গায়ে যদি সাদা সাদা দাগ দেখা যায়, বুঝতে হবে নিশ্চিত চিনি মেশানো রয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য খেজুর গুড়ের পাটালি মুখে দিয়ে আসল নকলের ফারাক সহজেই ধরতে পারেন। আর যারা পারেন না, তারা আঙুল দিয়ে হালকা চাপ দিয়ে দেখে নিতে পারেন। গুঁড়ো হয়ে গেলেই বুঝবেন জিনিস খাঁটি। এছাড়াও কেনার আগে একটু ভেঙে মুখে দিয়েও পরখ করা যায়। স্বাদ নোনতা হলে বুঝতে হবে এতে ফটকিরি মেশানো আছে। তৎক্ষণাৎ বাতিল সে পাটালি। আর সবশেষে যে কথাটা না বললেই নয় তা হল, নভেম্বর মাসের শেষ থেকে মার্চ মাসের গোড়া পর্যন্ত ভালো নলেন গুড় বাজারে আসে। তাই এই সময়ের আগে বা পরে গুড় বা পাটালি না কেনাই ভালো।

More Articles