জিডিপির পর্দাফাঁস! মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে মোদি জামানার অর্থনীতি?

IMF Exposes India’s GDP Myth: আইএমএফ আরও দেখিয়েছে যে উৎপাদন ও খরচের হিসাব দু'টো আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে করা হচ্ছে বলে হিসাবে সামঞ্জস্য থাকছে না।

ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে উদীয়মান অর্থনীতি হিসাবে উঠে আসছে বিশ্বগুরু নরেন্দ্র মোদির সফল নেতৃত্বে— গোদি মিডিয়ার এই ধারাবাহিক মিথ্যা প্রচারের পর্দাফাঁস করে দিল আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ)। এই সংস্থা তাদের 'Article Iv consultation report of India' প্রতিবেদনে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে শুধু সন্দেহ প্রকাশ করেনি, জিডিপির হিসাবকেও এক অর্থে বাতিল করে দিয়েছে। এই তথ্যের গুণগত মানকে 'C' দেওয়ার অর্থ আইএমএফ-এর ভাষায় "The data provided (by India) to the fund have some shortcomings that some what hamper surveillance"। এই শংসাপত্রের অর্থ ভারতের সরকারি তথ্য গুণগত মানে এতটাই নিম্ন যে তার উপর কোনো চূড়ান্ত হিসাব করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা দরকার যে অর্থনীতির আরেকটি সূচক গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (GVA) এর তথ্যেও আইএমএফ আমাদের সি দিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি হিসাবের ক্ষেত্রে ক্রেতা মূল্য সূচক (consumer price index) এর তথ্যে আমাদের মান 'B' সেটাও সন্তোষজনক নয়।

বাংলায় একটা কথা আছে

'গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না'।

আরও পড়ুন

আইএমএফ ঋণের অপব্যবহার: ঋণ নয়, রাষ্ট্রের ছদ্মবেশী যুদ্ধ তহবিল

আইএমএফ-এর এই মূল্যায়ণের পর যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা করতে নেমে পড়েছে তখন এই প্রবাদ বাক্যটির কথা আবার মনে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তিলমাত্র খবরাখবর রাখেন, তারা জানেন জিডিপির এই অস্বচ্ছতা, পরিসংখ্যানের এই গন্ডগোল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছেন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রফেসর অরুণ কুমার ও প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন। অরুণ কুমারের বক্তব্য ছিল ভারত সরকার যে জিডিপির কথা বলছে, ভারতের প্রকৃত জিডিপি তার ৪৮% মাত্র। একাধিক তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে তারা দেখিয়েছিলেন যতই সরকার অনুগত অর্থনীতিবিদেরা ভারতকে ৩.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতির দেশ বলুক না কেন, আদতে এই অর্থনীতির পরিমাণ ২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি নয়। ভারতে জিডিপি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের সবচেয়ে বড় ফাঁকি হলো জিডিপির ৪৮% হলো কৃষি-সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের কল্পিত হিসেব যাকে তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই।

অরুন কুমার সঠিক ভাবে দেখিয়েছিলেন ২০১৬ সালের নোটবন্দি, তারপর জিএসটি, ২০১৮ সালের নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানির দুর্নীতি ও সংকট এবং ২০২০ সালের অতিমারি তৃণমূল স্তরে অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাই জিডিপির সরকারি গল্পগুলি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই অস্বচ্ছতার কারণ হিসাবে প্রনব সেন দেখিয়েছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে কোনো ত্রৈমাসিক ডেটা নেই, তাই গোটা হিসাবটা বহুলাংশে হয়ে উঠেছে বহুলাংশে অনুমানকেন্দ্রিক। যেমন কৃষি পণ্যের প্রকৃত মূল্য কমেছে অথচ কৃষিতে বৃদ্ধির হার রয়ে যাচ্ছে ৩.৫%-৩.৬%। আমরা যদি আইএমএফের পর্যবেক্ষণকে খুঁটিয়ে দেখি তবে প্রথমেই চোখে পড়বে ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসাবে ধরার সমালোচনা যা এদেশের বহু অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন করে আসছেন। ২০১৫ সালে যখন প্রথম ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসাবে ঘোষণা করে নতুন ভাবে জিডিপির হিসাব করা হলো তখন কিন্তু পূর্ববর্তী হিসাবকে মাথায় রাখা হয়নি। একই সঙ্গে বিমুদ্রাকরণের সময় জানানো হয়েছিল ১৮ লাখের মধ্যে ৩ লাখ শেল কোম্পানি ও রেজিস্ট্রিকৃত কোম্পানিগুলির ৩০% কে তাদের ঠিকানায় পাওয়া যাচ্ছে না। অরুণ কুমার সে সময় দাবি করেছিলেন এই বৃহৎ কালো টাকার অর্থনীতিকে বাইরে রেখে জিডিপির হিসাব করতে। কিন্তু সে সময় তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। একই সঙ্গে মোদি সরকার বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফলকে প্রকাশিত হতে না দিয়ে একধরনের তথ্য সন্ত্রাস করেছিল যা জিডিপিতে প্রতিফলিত হয়নি। এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ২০১৯ সালে কর্মসংস্থানের হিসাব যাতে দেখা গিয়েছিল গত ৪৫ বছরে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব মোদি জমানায়। ২০১৭-১৮ সালে কনজিউমার সার্ভেতে প্রাপ্ত ডেটা প্রকাশ করা হয়নি। তথ্যের সঠিকতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণনা যা ২০২১ সালে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত তা শুরু হয়নি।

আরও পড়ুন

যে ১১টি শর্তে পাকিস্তানকে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিল আইএমএফ

নতুন জিডিপির হিসাব শুরু হওয়ার সময়েই প্রধানমন্ত্রীর এক প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বলেন যে জিডিপির হার অন্তত ২.৫% বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। আইএমএফ আরও দেখিয়েছে যে উৎপাদন ও খরচের হিসাব দু'টো আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে করা হচ্ছে বলে হিসাবে সামঞ্জস্য থাকছে না। এই নতুন হিসাব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নীতি আয়োগের উপর, যা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে না। গত ১০ বছরে ধনী-নির্ধনের ফারাক যেমন বেড়েছে তেমনি বদলেছে মানুষের খরচ করার ধরন। ফলে পুরনো পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে না। এই গোটা বিষয়টা মোদি সরকারের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানকে সন্দেহজনক করে তুলেছে। আইএমএফের এই পর্যবেক্ষণ ২০২৫-২৬ ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপির হঠাৎ ৮.২% বৃদ্ধির গল্পকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার অনুমান ছিল বৃদ্ধি হবে ৭%। সবার এ কথা জানা যে এই ত্রৈমাসিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) ২২ সেপ্টেম্বর থেকে জিএসটির নতুন হার চালু হয়। স্বাভাবিক ভাবেই অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম কুড়ি দিন বাজার ছিল চাহিদা শূন্য কারণ সবাই নতুন হারের অপেক্ষা করছিল। একই সঙ্গে এই সময় পর্বে এফডিআই নেট ঋণাত্মক। বহু প্রজেক্ট টাকার অভাবে স্থগিত। তাই কোনো ভাবেই এই বহু বিজ্ঞাপিত নতুন হিসাবকে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

এই লেখা যখন লেখা হচ্ছে তখন ইনডেক্স অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশনের পক্ষ থেকে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে গত ১৪ মাসের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের বৃদ্ধি সবচেয়ে কম, ০.৪%। একই সঙ্গে এক ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে নব্বই টাকা। পরিসংখ্যানে কারচুপি করে অর্থনীতির এই হতশ্রী অবস্থা সাময়িকভাবে মানুষের কাছে আড়াল করা গেলেও, দীর্ঘমেয়াদি ভাবে এই অবস্থা লুকিয়ে রাখা যাবে না। সঠিক পরিসংখ্যান শুধু স্বচ্ছতার জন্য জরুরি নয়, দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনার জন্য জরুরি। মোদি সরকার এই সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল।

More Articles