কৌশলে বড়সড় বদল বিজেপির, তাতেই কি পদ্ম ফুটল মহারাষ্ট্রে?
Maharashtra Election Results: গত লোকসভা ভোটেও যা চোখে পড়েনি, এবারে এই তিন রাজ্যে যা দেখা গেছে। এবারে মহারাষ্ট্রে এবং ঝাড়খন্ডে, একেবারে নীচের তলায়, বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারকে পৌঁছে দিতে আরএসএস তাদের সম্পূর্ণ সংগঠনকে নামিয়ে...
হরিয়ানার পরে এবার মহারাষ্ট্র, বিজেপির আবার চমকে দেওয়া জয়। অতি বড় সেফোলজিস্টও বোধহয় এমনটা আশা করেননি। যদিও ঝাড়খণ্ডে বিজেপি জিততে পারেনি, কিন্তু এই তিনটি রাজ্যের নির্বাচন যাঁরা সামনে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, গত লোকসভা ভোটের পরাজয়ের পরে বিজেপি একটা কৌশলগত পরিবর্তন করেছে। আগের সমস্ত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে লড়ে, আশানুরূপ ফল না পাওয়ায়, এবার বিজেপি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ওপর এবং স্থানীয় ইস্যুকে সামনে রেখেই লড়াই করেছে। বিভেদের রাজনীতি তো ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরএসএসের সাংগঠনিক শক্তি এবং মহিলাদের জন্য প্রকল্প। এই সমীকরণকে সামনে রেখেই আজকে বিজেপির এই সাফল্য। ঝাড়খণ্ডেও একই কৌশল নিয়েছিল বিজেপি এবং তার সঙ্গে যুক্ত করেছিল অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত বিষয়টি, কিন্ত সেখানে তাঁদের এই কৌশল কার্যকরী হয়নি। সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যেও তারা তাদের এই বিভাজনের ভাবনাকে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিল,কিন্তু সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর স্ত্রী, কল্পনা সোরেনের অনমনীয়, হার না মানা মনোভাব শেষপর্যন্ত ঝাড়খন্ডে পদ্মফুল ফোটা আটকাতে পেরেছে।
ঝাড়খণ্ডে পদ্ম না ফুটলেও মহারাষ্ট্রে বিজেপি যে যে কারণে এই অভাবনীয় ফল করল, তার পর্যালোচনা করতে বসলে, প্রথমেই যা চোখে পড়বে, তা হল আরএসএসের নিজস্ব যে সংগঠন তার সাহায্য নেওয়া। গত লোকসভা ভোটেও যা চোখে পড়েনি, এবারে এই তিন রাজ্যে যা দেখা গেছে। এবারে মহারাষ্ট্রে এবং ঝাড়খন্ডে, একেবারে নীচের তলায়, বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারকে পৌঁছে দিতে আরএসএস তাদের সম্পূর্ণ সংগঠনকে নামিয়ে দিয়েছিল। মহারাষ্ট্রে, বিরোধীরা যখন বলার চেষ্টা করেছে, সংবিধান বিপন্ন হচ্ছে, আদানি আম্বানির মতো গুজরাটি শিল্পপতিরা ছোট ব্যবসার ক্ষতি করছে, তখন আরএসএস একেবারে নীচের তলায় উল্টোটা বোঝানোর চেষ্টা করে গেছে। বলে গেছে, উদ্ধব নয়, শিবসেনার আসল উত্তরসূরী একনাথ শিন্ডে। পরিবারবাদ নয়, একজন সাধারণ অটোচালকই পারবেন বালাসাহেব ঠাকরের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। উদ্ধব ঠাকরের হাতে হিন্দুরা নিরাপদ নয়। সেই জন্যেই তারা স্লোগান তুলে এনেছে, ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ বা ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’। অর্থাৎ সমস্ত মারাঠাবাসীকে এক হতে হবে এবং তবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই আরও তীব্র করা যাবে।
আরও পড়ুন: এক হ্যায় তো সেফ হ্যায় মন্ত্রেই ম্যাজিক? কীভাবে মহারাষ্ট্র দখল করল বিজেপি?
একদিকে যখন রাহুল গান্ধী সংবিধানের কথা বলেছেন, জাতিগত জনগণনার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, তখন বিজেপি-আরএসএস তাদের সমস্ত স্লোগানকে একেবারে সহজবোধ্য করে, নীচের তলায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিরোধীরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, যে এই নির্বাচনটা জাতীয় স্তরের নির্বাচন নয়, এটা একটি আঞ্চলিক স্তরের এবং একটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন এবং এখানে আঞ্চলিক রাগ এবং ক্ষোভকে ভোটে নিয়ে যেতে হয়। তা করতে গেলে নীচের তলায় সংগঠনের প্রয়োজন এবং আঞ্চলিক বিষয়কে ধরে প্রচার চালানোটা একজন আঞ্চলিক নেতাই করতে পারেন। কর্ণাটকে যেমন ছিলেন ডি কে শিবকুমার এবং সিদ্দারামাইয়া, মহারাষ্ট্রে কি তেমন কোনও নেতা ছিলেন? উদ্ধব ঠাকরে কিংবা শরদ পাওয়ার ছিলেন বটে, কিন্তু বিজেপিকে পরাজিত করার জন্য তাঁরা যতটা আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রয়োজন ছিল, ততটা ছিলেন না। এই নির্বাচনের পরে আবারও শুধু নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং জে পি নাড্ডার নেতৃত্বই প্রতিষ্ঠা পেল না, তার সঙ্গে আরএসএস এবং বিজেপির মধ্যে যে দূরত্ব ছিল, তা মিটল অনেকটাই। সোমবার থেকে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে। বিরোধীরা হয়তো ভেবেছিলেন, সেখানে আদানি এবং মণিপুর ইস্যু নিয়ে সরকারপক্ষকে চেপে ধরবেন, কিন্তু মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল তাঁদের সেই আশায় কিছুটা হলেও জল ঢাললো বলেই মনে হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন, মহারাষ্ট্রে শেষ মূহুর্তে মহিলাদের জন্য যে ‘ মাঝি লাডলি বেহেনা’ প্রকল্প আনা হয়েছিল একনাথ শিন্ডের পক্ষ থেকে, তাতেই এই সাফল্য, কিন্তু তার পিছনেও আরএসএসের মহিলা বাহিনীর যথেষ্ট প্রভাব আছে শোনা যাচ্ছে। তাদের দুর্গা বাহিনী নাকি ঘরে ঘরে ঢুকে এই প্রকল্পের প্রচার করেছে বলে শোনা গিয়েছে। যদি খেয়াল করা যায়, এতদিন অবধি বিধানসভা হোক বা লোকসভা, যে কোনও নির্বাচনে তাঁদের একমাত্র মুখ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, তার সঙ্গে সঙ্গত দিতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বাংলার ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তো এই দু’জন প্রায় রোজ এসেছিলেন প্রচার করতে। তথ্য বলছে, এবারের মহারাষ্ট্র নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি সর্বসাকুল্যে ২৮৮টি আসনের জন্য মোট ১২টি সভা করেছেন আর ৮১ আসনের ঝাড়খন্ডে উনি ৬টি সভা করেছেন। কিছুদিন আগে যে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেল, সেখানেও তিনি মাত্র ৪টি সভা করেছিলেন। অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে, লোকসভা নির্বাচনেরপর থেকে আরএসএস নরেন্দ্র মোদীর ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে এবং নতুন নেতৃত্ব তুলে আনার চেষ্টা করছেন এবং তাতে তাঁরা সফলও হচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফডনবীস এবং ঝাড়খণ্ডে বাবুলাল মারান্ডিকে সামনে রেখে লড়াই করার মধ্যে দিয়ে তারা এই বার্তাই দিতে চাইছে যে আমাদের তূণে শুধু নরেন্দ্র মোদি নয়, আরো অনেক তির আছে। অসমে উপনির্বাচন থাকা সত্ত্বেও, সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন ঝাড়খণ্ডে। সঙ্গে ছিলেন শিবারাজ সিং চৌহান,যিনি তার মধ্যপ্রদেশ জেতার অভিজ্ঞতা দিয়ে ঝাড়খণ্ডে পড়ে থেকে কাজ করে গেছেন। যদিও পারেননি, কিন্তু তারা যে নিজেদের মতো করে তাঁদের কৌশল বদল করেছেন, তা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে।
আসল কথা হল, বিজেপির কৌশলগুলো বিরোধীরা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। আর তা এবার মহারাষ্ট্রে এবং ঝাড়খন্ডের নির্বাচনে বেশ বোঝা গেছে। যেখানে যেরকম কৌশল নেওয়ার কথা, সেখানে সেইরকম কৌশল নেওয়া যে আজকের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা খুব দ্রুত বুঝতে হবে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে। ঝাড়খণ্ডেও পুরো ‘ইন্ডিয়া’ জোট একসঙ্গে লড়াই করেছে, তা অতিবড় সমর্থকও বলবে না। বাম দলগুলোও এক হয়ে লড়াই করতে পারেনি। না হলে, জেএমএম এবং সিপিআইএমএলের বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইতে, ধানওয়ার কেন্দ্রে বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ী হতেন না। মহারাষ্ট্রেও শরদ পাওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে এবং কংগ্রেসের জোটকে কখনও কখনও বেসুরো লেগেছে। যেখানে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি লোকসভা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, তাঁদের আর আরএসএসের প্রয়োজন নেই। সেখান থেকে সরে এসে আরএসএস-বিজেপি বর্তমানে ঠিক করে নিয়েছে, আগামিদিনে সাংঠনিকভাবে প্রচারের ক্ষেত্রে কোনও একক ব্যক্তির উপর নির্ভরতা আর নয়। সেখানে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট সাংগঠনিক এবং ব্যক্তি-নির্ভরতা, দু'ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। বিজেপি এবং আরএসএস আগামিদিনে জনগণনা করাতে চলেছে, তারপরেই তারা মহিলা বিল আনার প্রক্রিয়া নেবে এবং তা দিয়ে প্রচার করবে, যে প্রচার তাদের বিরুদ্ধে করা হয়, তারা মহিলা বিরোধী। কিন্তু আদতে তা তারা মোটেও নয়। তারা দুর্গাবাহিনীকে ময়দানে নামিয়ে এটাই প্রমাণ করতে চাইবে যে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার জন্যেই মহিলা বিল পাশ হচ্ছে, তার জন্যেই বিভিন্ন রাজ্যে মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে।
আরও পড়ুন:কোন মন্ত্রে ওয়ানাড়ে রাহুল গান্ধির চেয়েও বেশি ভোটে জয় প্রিয়াঙ্কা গান্ধির?
আগামিদিনে বিরোধীরা যদি সঠিক দিশা না দেখাতে পারে, সাংগঠনিকভাবে দ্বিগুণ শক্তিশালী বিজেপিকে পরাজিত করা কঠিন হয়ে যাবে। জনগণনার পরে যখন দেখা যাবে, দেশের কর্মক্ষম যুবকদের সংখ্যা বাড়ছে এবং দেশের আসল সমস্যা বেকারত্ব, এবং তা কখনওই অনুপ্রবেশ নয় এবং এই পুরো বিষয়টা নিয়ে প্রচার না করতে পারে,তাহলে সমূহ বিপদ। কিন্তু বিরোধীরা কি পারবে, তাদের এই ন্যারেটিভকে সামনে নিয়ে এসে প্রচার করতে? আদানির দুর্নীতি অবশ্যই একটা ইস্যু, কিন্তু তা কীভাবে সাধারণ মানুষের যাপনের সঙ্গে জড়িত, তা যদি সহজ করে বোঝানো না যায়, তাহলে সকাল থেকে বিকেল অবধি, ‘আদানি চোর’, আদানি ২৫০ বিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছে বলে আমেরিকান আদালতের তথ্য নিয়ে চিৎকার করেও লাভ হবে না, কারণ শেষ বিচারে একজন সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না, ২৫০ বিলিয়ন ডলার মানে ভারতীয় মুদ্রায় কত টাকা এবং সেই কারণে তার ব্যক্তিগত কী ক্ষতি হচ্ছে। এই কথাগুলো সামাজিক মাধ্যমে কিঞ্চিৎ কিছু আকর্ষণ তৈরি করতে পারে সাময়িক, অন্যথা খুব বেশী লাভ হবে না। ওদিকে আরএসএস তলায় তলায় প্রচার করবে, আদানি একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী বলে, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা ইচ্ছে করে তাঁকে বদনাম করছে আর গৌতম আদানি পিছনে ভারতীয় পতাকা লাগিয়ে বলবে সে নির্দোষ, আর সাধারণ মানুষ সেটাই বিশ্বাস করতেই থাকবে। আর এভাবে তবে কি শেষপর্যন্ত জিতে যাবে আরএসএসের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক লাইনই, সেই প্রশ্নই উস্কে দিয়েছে দুই রাজ্যের এই ভোটের ফলাফল।