ভারত বনাম ইন্ডিয়া: প্রথম নয়, আগেও যেভাবে পাল্টে ফেলা হয়েছে এই সব রাজ্যের নাম
India vs Bharat row: রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু নাকি জি-২০ সমাবেশে আগত অতিথিদের আমন্ত্রণপত্রে নিজের পরিচয় দিয়েছেন 'প্রেসিডেন্ট অব ভারত' হিসেবে। মজার ব্যাপার, এক কালে নাকি দেশের নাম বদলে 'ভারত' করার দাবি নাকচ করে দিয়েছিলে...
এবার ভারতে বসেছে জি-২০ সম্মেলনের আসর। সেই সমাবেশে অতিথিদের আমন্ত্রণপত্রে প্রথা ভেঙে রাষ্ট্রপতি নিজের পরিচয় দিয়েছেন 'প্রেসিডেন্ট অব ভারত' হিসেবে। ছাপার অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে সেই শব্দবন্ধ। এতদিন ধরে 'প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া' দেখে-শুনে অভ্যস্ত আমজনতার চোখে তা বিঁধেছে ভালোই। আর এই সুযোগটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল বিজেপি। ভোটমুখী হাওয়ায় বিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'-র কাছ থেকে প্রতাপ ছিনিয়ে নেওয়া এমন সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করেনি তারা। এবার কাগজে কলমে দেশের নাম বদল করতে উঠেপড়ে লেগেছে কেন্দ্রীয় সরকার।শেকসপিয়র বলেছিলেন 'নামে কী-ই বা আসে যায়'। কিন্তু ক্ষমতায় আসা ইস্তক একের পর এক জায়গার নাম বদলে বিজেপি সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে নামে বিস্তর আসে যায়। কখনও ইলাহাবাদ হয়ে গিয়েছে প্রয়াগরাজ, তো কখনও মুঘলসরাই হয়ে হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর জংশন স্টেশন। এমন তো হামেশাই হচ্ছে। ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল। আর এমন 'হযবরল'-র আড়ালেই চলছে ক্ষমতায়নের খেলা। আর এ কথা কে না জানে, জোর যার মুলুকও তার। আর সেই ক্ষমতার জোরেই এবার আস্ত মুলুকটারই নাম বদলে ফেলতে চাইছে মোদি সরকার। কাগজে-কলমে এ দেশ 'ইন্ডিয়া' বলেই পরিচিত, অন্তত ইংরেজি ভাষায় তো বটেই। তবে এবার খাতা থেকে 'ইন্ডিয়া শব্দটাই ছেঁটে ফেলতে চাইছেন হিন্দুরাষ্ট্রের কারিগরেরা। ভারতীয় জনতা পার্টি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা চায়, মোদির দেশ পরিচিত হোক শুধুমাত্র 'ভারত' নামেই।
আগামী ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সংসদের বিশেষ অধিবেশনে এই সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করতে চাইছে বিজেপি সরকার। আপাতত সেই বিষয়টি নিয়েই উত্তাল দেশ। বিক্ষিপ্ত ভাবে রাজ্যের নাম পরিবর্তন, না হয় মানা গেল! তাই বলে রাতারাতি বদলে যাবে দেশের নাম! তাও আবার হয় নাকি! তা রাজা চাইলে কী না হয়। রাতারাতি দেশে তৈরি হয়ে যায় বল্লভ ভাই পটেলের দৈত্যাকার মূর্তি। 'রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে'। তাই স্ট্যাচু অব লিবার্টির চেয়েও উঁচু স্ট্যাচু অব ইউনিটি। রাজা চাইলে রাতারাতি বল্লভ ভাই পটেলের নাম মুছে গুজরাটের মোতেরা স্টেডিয়াম হয়ে যায় নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। তা সে দেশে রাজার ইচ্ছেতে দেশের 'সামান্য' নামটুকু বদল হবে না, তা আবার হয় নাকি!
আরও পড়ুন: ‘ইন্ডিয়া’ বদলে ‘ভারত’! কেন দেশের নাম বদলাতে মরিয়া বিজেপি?
তার মধ্যে আবার বিজেপি সরকারকে গদি থেকে টলাতে জোট বেঁধেছে বিরোধীরা। সেই জোটের নামই আবার ইন্ডিয়া। এই পরিস্থিতিতে দেশের নাম নিয়ে যে একটু খুঁতখুঁতানি হবেই ভারতীয় জনতা পার্টির অন্দরে, তা আর আশ্চর্য কী! তাই কি রাতারাতি নামবদলের চেষ্টা। নিন্দুকেরা তেমনটাই বলছেন। তবে ইতিহাস বলছে, ভারতই প্রথম নয়। এর আগেও এমন নাম বদলের এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে একাধিক দেশকে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার সীমান্তের টার্কি দেশটি, যাকে আমরা 'তুরস্ক' নামেই বেশি চিনি। নাম বদলের অপেক্ষায় রয়েছে সেই দেশটিও। এবার থেকে 'তুরকিয়ে' নামেই পরিচিত হতে চায় তারা। ২০২২ সালেই এই মর্মে আবেদন করে রেখেছে তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে। ইতিমধ্যেই নাম পাল্টে ফেলেছে হল্যান্ডও। এখন তারা পরিচিত 'নেদারল্যান্ডস' নামে। বিশ্বের কাছে নেতিবাচক দিক সরিয়ে নিজেদের নতুন ভাবে তুলে ধরতেই এমন পদক্ষেপ বলে দাবি করেছিল ডাচ সরকার।
নাম বদলেছে চেক রিপাবলিকও। সরকারি ভাবে এখন তারা চেকিয়া হিসেবেই পরিচিত। চলতি বছরের গোড়াতেই সেই নামে সিলমোহর পড়েছে। এত বড় নাম নিয়ে নাকি বেশ বিপাকে পড়তে হত তাদের। তাই এমন বদলে সায়। একসময়ে যে দেশ বর্মা নামে পরিচিত ছিল, তা নাম পাল্টে হয়েছিল মায়ানমার। বর্মিদের রমরমা কমাতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে দেশের সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার। বা ধরুন, ভারতের দক্ষিণের ছোট্ট দেশ শ্রীলঙ্কা। ব্রিটিশরা সে দেশের নাম রেখেছিস সিলোন। তবে ইংরেজ জমানা শেষ হতেই তাদের চিহ্নটুকু মুছে ফেলে দেশটি। বদলে দেওয়া হয় দেশের নামটিও। ২০১১ সাল থেকেই নিয়ম করে কাগজে-কলমে ওই নামটি ব্যবহার নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে সে দেশের সরকার। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় দেশ কম্বোডিয়া। কমিউনিস্ট জমানায় সে দেশে পরিচিত ছিল কাম্পুচিয়া নামে। এককালে যা ছিল পারস্য, তা নাম বদলে হয়েছে ইরান, আফ্রিকার দক্ষিণের দেশ কিংডম অফ সোয়াজ়িল্যান্ড নাম পাল্টে হয় কিংডম অব এসোয়াতিনি। রাজা তৃতীয় এসোয়াতিনি এসে দেশের নাম পাল্টে করে দেন নিজের নামে।
ঠিক যেমনটা করতে চেয়েছেন মোদি, ঠিক যেমনটা করতে চায় বিজেপি। নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার এমন সহজ, হাতে গরম পথ আর কী-ই বা আছে বলুন তো! সামনের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিকে গদি থেকে সরাতে উঠে পড়ে লেগেছে বিরোধী জোট। খুঁজে খুঁজে নিজেদের নামখানাও খাসা রেখেছে তারা। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স ওরফে 'ইন্ডিয়া'। বিজেপির বিরুদ্ধে গোটা দেশ, ইন্ডিয়া তথা ভারতের মুখ হয়ে ওঠার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা রয়ে গিয়েছে সেই নামের মধ্যেই কোথাও। আর সেটাই বিঁধছে বিজেপিকে। অগত্যা সুর বন্ধ না করতে পারলে নষ্ট করে দেওয়া যাক গোটা বাঁশিটাই। ফলে তড়িঘড়ি নাম বদলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল বিজেপি সরকার।

তবে শুধু বিদেশ-বিভুঁইতেই নয়, এ দেশেও বহু রাজ্যেরই নাম বদলের সাক্ষী ইতিহাস বই। আর সে সবই যে শুধুমাত্র বিজেপি জমানায় হয়েছে, তা-ও নয়। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে প্রথমবার নাম বদলেছিল উত্তরপ্রদেশ। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ইউনাইটেড প্রভিন্স অব আগরা অ্যান্ড অউধ নামে পরিচিত ছিল উত্তর ভারতের এই রাজ্যটি। ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি সেই নাম বদলে হল উত্তরপ্রদেশ, এবং ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হল রামপুর, বেনারস ও তেহরি গারওয়াল- এই অংশগুলি। তারপর ধরুন, এখন যেটা হায়দরাবাদ, সেটা এর আগে ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়ার অংশ। পরে ১৯৪৮ সাল নাগাদ তাকে অন্ধ্রের সঙ্গে ঢুকিয়ে নাম দেওয়া হয় হায়দরাবাদ। মধ্যপ্রদেশের এককালে নাম ছিল মধ্যভারত। ১৯৫৬ সাল নাগাদ তার মধ্যে বিন্ধ্য প্রদেশ ও ভোপালকে মিশিয়ে নতুন নাম রাখা হল মধ্যপ্রদেশ।
ব্রিটিশ আমলে যা ছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, স্বাধীনতার পর তা বদলে হল শুধুই মাদ্রাজ রাজ্য। যা তৈরি হয়েছিল তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কেরালার কিছুটা অংশ নিয়ে। ১৯৫৩ সালে মাদ্রাজ ভাঙল। তেলুগুভাষীদের নিয়ে গড়ে উঠল অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলভাষীদের নিয়ে তৈরি হল মাদ্রাজ। ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন আইনের জোরে ফের ভাঙল মাদ্রাজ। তৈরি হল কেরল, মহীশূর ও মাদ্রাজ রাজ্য। ১৯৬৮ সালে শেষমেশ মাদ্রাজ রাজ্যের নয়া নাম হল তামিলনাড়ু। এদিকে মহীশূর ১৯৫৬ সালে পেল নতুন নাম। লোকে তাকে চিনল কর্ণাটক নামে।
আজকের দেবভূমি উত্তরাখণ্ড এককালে পরিচিত ছিল উত্তরাঞ্চল হিসেবে। ২০০৬ সালে নাম পাল্টে রাজ্যটির নাম রাখা হয় উত্তরাখণ্ড। আজকের ওড়িশা আগে পরিচিত ছিল উড়িষ্যা নামে। তবে স্থানীয় ভাষার নামে রাজ্যের নাম রাখার দাবি ছিন অনেকদিনের। আর সেই দাবিকে মান্যতা দিয়েই ২০১০ সালে উড়িষ্যা হল ওড়িশা। নাম নিয়ে দ্বন্দ্ব-সমাস কম নেই এ রাজ্যেও। পশ্চিম বাংলা না পশ্চিম বঙ্গ, নাকি শুধুই বঙ্গ- এমন নানাবিধ প্রস্তাব নিয়ে একাধিক বার কেন্দ্র সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্যটি। তবে বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের দরজা থেকে কালো মুখে ফিরে আসতে হয়েছে। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের নাম 'বাংলা' করার আর্জি নিয়ে রাজ্যসভায় যায় রাজ্য সরকার। এখনও সেই প্রস্তাব ঝুলছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী ফের নতুন করে বাংলার নাম বদলের ব্যাপারটি নিয়ে সরব হয়েছেন। তবে আদৌ তা ঘটবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের হাতে। কেরলও ইতিমধ্যে কেন্দ্র সরকারের কাছে নাম পরিবর্তনের আর্জি জমা করেছে। 'কেরলম' হিসেবেই নিজের রাজ্যকে চেনাতে চায় তারা।
আরও পড়ুন: এক দেশ এক নির্বাচনের পক্ষেই সওয়াল প্রশান্ত কিশোরের! মোদি ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন পিকে?
এর পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গার নাম বদলের গল্প তো রয়েইছে। বম্বে হয়েছে মুম্বই, ক্যালকাটা হয়েছে কলকাতা। হালে তো সেই নামবদলের ঘনঘটা চড়েছে আরও একধাপ। প্রাচীন শহর ইলাহাবাদ হয়েছে প্রয়াগরাজ, গুরগাঁও এখন পরিচিত গুরুগ্রাম হিসেবে। আর এই তালিকা লম্বা। তবে এখন আলোচনার শীর্ষে দেশের নাম পরিবর্তন। মজার ব্যাপার হল, এক কালে নাকি দেশের নাম বদলে 'ভারত' করার দাবি নাকচ করে দিয়েছিলেন মোদি স্বয়ং। এমনই আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নিরঞ্জন ভটওয়াল নামে মহারাষ্ট্রের এক ব্যক্তি। 'ইন্ডিয়া' নামটি খারিজ করে 'ভারত' নামেই সিলমোহর দাবি করে একটি জনস্বার্থ মামলা করেন তিনি। তবে তাঁর সেই দাবি খারিজ হয়ে গিয়েছিল। সেটা অবশ্য ২০১৫ সালের কথা। তখন পরিস্থিতি ছিল আলাদা। 'ইন্ডিয়া' নামক কোনও বিরোধী জোটশক্তি তখন মোদিসাম্রাজ্যের সামনে এসে দাঁড়ায়নি। ফলে তখনের সঙ্গে এখনের তুলনা করলে চলবে কেন! এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় একটি ছবির সংলাপ। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্যটার কথা মনে পড়ছে নিশ্চয়ই, যেখানে ফেলুদা আর মগনলাল প্রথমবার মুখোমুখি। 'দুর্ধর্ষ দুশমন' মগনলালের প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা স্মিত হাসি হেসে বলেছিলেন, 'আমারই তো মাইন্ড, চেঞ্জ করতে বাধাটা কোথায়!' বিজেপিও বোধহয় মনে মনে সেই কথাটাই বলতে চাইছে নিন্দুকদের।

Whatsapp
