মগজাস্ত্র ক্ষুরধার, ফোনে ফোনে বানচাল করেন আক্রমণ! ভারতের প্রকৃত জেমস বন্ড অজিত ডোভাল
Ajit Doval: ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভারতের আইসি-৮১৪ হাইজ্যাক করে নেয় আইএসআইএস জঙ্গিরা। বিমানে উপস্থিত ১৭০ জন ভারতীয়কে সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পড়ল অজিত ডোভালের উপর।
অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করলে সেই যুদ্ধ বারবার লড়তে হয়, কিন্তু মগজাস্ত্র প্রয়োগ করলে শত্রুকে চিরতরে নির্মূল করে দেওয়া যায়। সিনেমার পর্দায় আমরা জেমস বন্ডকে দেখে বহুবার আমোদিত হয়েছি। ভারতেও একজন জেমস বন্ড আছেন। তিনি পর্দার নন, বাস্তবের জেমস বন্ড। তিনি বর্তমান ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত ডোভাল। ৭৭ বছরের ডোভালের উদ্যম দেখলে, তাঁর আসল বয়স ঠাহর করা মুশকিল। প্লেন হাইজ্যাক আটকানো হোক কিংবা সার্জিকাল স্ট্রাইক, কাশ্মীরের সমস্যা হোক বা দিল্লির দাঙ্গা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব গিয়ে পড়ে অজিত ডোভালের ওপর। ১৯৪৫ সালে উত্তরাখণ্ডে জন্ম হয় অজিত ডোভালের। তাঁর বাবা ছিলেন আর্মিতে। মিলিটারি পরিবার হওয়ায় ছোট থেকেই প্রচণ্ড অনুশাসনে বড় হয়েছেন অজিত। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৬৮ সালে কেরল ক্যাডারের আইপিএস অফিসার হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা অর্থাৎ সিবিআইতে জয়েন করেন ডোভাল। এই সময় তিনি এমকে নারায়ণনের (ভারতের তৃতীয় NSA এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল) সংস্পর্শে আসেন। সিবিআই জয়েন করার সঙ্গে সঙ্গেই ডোভালের সামনে আসে এক বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ।
ফিরে যাওয়া যাক সত্তরের গোড়ায়। ১৯৭২ সাল, উত্তর-পূর্ব ভারতে তখন ভয়ংকর ইনসার্জেন্সি চলছে। সেখানকার বিভিন্ন রাজ্য থেকে দাবি উঠছে তাদের আলাদা করে একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার। এই সময় মিজোরামে একপ্রকার সমান্তরাল সরকার চালাচ্ছেন লালডেঙ্গা। লালডেঙ্গার আতঙ্কে দিল্লি পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। এই সময় দিল্লির আইবি অফিসে মিটিং ডাকা হল। লালডেঙ্গার ডেরায় যাবে কে? এই প্রশ্নের জবাবে যখন সব বড় বড় অফিসাররা একে অপরের মুখ দেখছেন, তখন সটান দাঁড়িয়ে উঠে ডোভাল বললেন তিনি যাবেন। মিজোরামে গিয়ে অজিত ডোভাল প্রথমে লালডেঙ্গার বিশ্বস্ত সাতজন কমান্ডারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালেন। ধীরে ধীরে কমান্ডারদের বোঝাতে থাকলেন ভারতের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার কী কী সুবিধা। তিনি কমান্ডারদের আশ্বস্ত করেন যে, ভারত সরকার তাদের উপর থেকে সব ক্রিমিনাল চার্জ তুলে নেবে। শর্ত একটাই, তাদের ভারত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। ডোভাল ওই কমান্ডারদের জানান, ভারত সরকারের সঙ্গে জুড়ে গেলে মিজোরামে ভোট হবে। ফলত আর বেআইনিভাবে নয়, সম্পূর্ণ আইনি স্বীকৃতি নিয়েই লালডেঙ্গা নিজের সরকার চালাতে পারবেন মিজোরামে। ফলত ১৯৭২ সালের শেষভাগে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হয় মিজোরাম। সেখানে ইনসার্জেন্সি সম্পূর্ণরূপে শেষ হয় এবং ১৯৮৬ সালে সেখানে প্রথম বিধানসভা নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গড়ে এমএনএফ এবং মুখ্যমন্ত্রী হন লালডেঙ্গা।
আরও পড়ুন- রেসকোর্স থেকে জ্যোতিষ চেম্বার! কলকাতা পুলিশের রহস্যভেদ হার মানাবে ওয়েব সিরিজকেও!
মিজোরাম সামলালেও অজিত ডোভালের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় চ্যালেঞ্জ। এবার ডোভালের মোকাবিলা হওয়ার ছিল আমেরিকার সঙ্গে। ’৭৩ সালে সিকিমের রাজা এক আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে এই মহিলা ছিলেন সিআইএ এজেন্ট। এই খবর সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসে আইবি। ক্রমশ লক্ষ্য করা যায় সিকিমের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন রানি-রূপী ওই সিআইএ এজেন্ট। দিল্লির ভয় ছিল আমেরিকাকে নিয়ে। যদি তারা সিকিম দখল করে নেয়, তাহলে পক্ষান্তরে ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে পারে চিন। মোট কথা, সিকিম কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। এবার অজিত ডোভালকে পাঠানো হলো সিকিম। অজিত ডোভাল গিয়ে সিকিমের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই দলের নেতাদের তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন, সিকিমকে বাঁচাতে হলে সিকিমকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ফলত সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং সিকিমের মহারাজার মধ্যে লেগে গেল বিবাদ। সেই সময় সিকিমের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। রাজা ফরমান জারি করলেন সিকিমের প্রধানমন্ত্রী-সহ সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের সব নেতাকে রাতারাতি কারাবন্দি করার। এই খবর অজিত ডোভালের কাছে যেতেই তিনি ফোন লাগলেন ইন্দিরা গান্ধীকে। রাতারাতি সেনা পৌঁছে গেল সিকিমে এবং বন্দি করা হল সিকিমের রাজাকে। সিকিমের প্রধানমন্ত্রী এবং অজিত ডোভালের উপস্থিতিতে ১৯৭৫ সালে পাকাপাকিভাবে ভারতের অংশ হলো সিকিম।
নিজের কর্মজীবনে বহুবার মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখেছেন অজিত ডোভাল। ১৯৭৭ সালে র এবং আইডির তরফে প্রায় ২০০ জন সিক্রেট এজেন্টকে পাকিস্তান পাঠানো হয় পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম সাবোটাজ করার জন্য। এদিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জিয়াউল হকের সঙ্গে মনের আনন্দে কথা বলতে বলতে সেই তথ্য ফাঁস করে দেন। রাতারাতি প্রায় সব সিক্রেট এজেন্টকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করে আইএসআই। কোনও মতে সেবার প্রাণ বাঁচিয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন অজিত ডোভাল। তবে ফিরতে ফিরতেও পাকিস্তানকে মোক্ষম ধাক্কা দিয়ে এসেছিলেন তিনি। মোসাডকে তিনি জানিয়ে দেন পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম না আটকালে সবচেয়ে বড় বিপদ ইজরায়েলের। নিউক্লিয়ার বোম বানিয়ে সবার আগে ইজরায়েলের ওপরেই ফেলবে পাকিস্তান। পাকিস্তান এই নিউক্লিয়ার বোম অত্যন্ত সংগোপনে তৈরি করছিল। কিন্তু এই তথ্য বিশ্বের দরবারে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাদের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম ১৫ বছর পিছিয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, কাশ্মীর থেকে কেরল, পঞ্জাব থেকে উত্তর পূর্ব- বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন ডোভাল।
বিপদের সময় কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হয় তা বারংবার শিখিয়েছেন অজিত ডোভাল। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভারতের আইসি-৮১৪ হাইজ্যাক করে নেয় আইএসআইএস জঙ্গিরা। নেপাল থেকে দিল্লি আসছিল ফ্লাইটটি কিন্তু সেটিকে কান্দাহার উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আইএসআইএসের তরফে দাবি করা হয় ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং ৩৫ জন বন্দিকে ছাড়তে হবে। কান্দাহারে সেই সময় তালিবানদের থেকেও সমর্থন পাচ্ছিল আইএসআইএস। মনে করা হয়, তাদের গোপনে টাকা জোগাত আইএসআই। বিমানে উপস্থিত ১৭০ জন ভারতীয়কে সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পড়ল অজিত ডোভালের উপর। ডোভাল এবার শুরু করলেন নিজের ‘মাইন্ড গেম’। সিআইএ, কেজিবি, এমআই-৫, মোসাড, ইন্টারপোল, পেন্টাগন- সব জায়গায় ফোন করে ফ্লাইটে উপস্থিত জঙ্গিদের সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করা শুরু করলেন তিনি। এই খবর আইএসআইয়ের কানে যেতেই তারা নড়ে বসে। তারা আশঙ্কা করে যখন তখন তাদের উপর আক্রমণ হতে পারে। আইএসআই জঙ্গিদের নির্দেশ দেয়, অজিত ডোভালকে ফোন করে পাল্টা চাপ দেওয়ার জন্য। অজিত সাফ জানিয়ে দেন এক পয়সাও তিনি দেবেন না, বড়জোর একজন জঙ্গিকে ছাড়তে পারেন তারা। উল্টোদিকে আইএসআই আইএসআইএসের উপর চাপ বাড়াতে থাকে। শেষমেষ ঠিক হয় ৩ জন জঙ্গিকে ছাড়বে ভারত। অবশেষে ৩ জন জঙ্গিকে ছেড়ে ১৭০ জন ভারতীয়কে সুস্থভাবে ভারতে নিয়ে আসেন ডোভাল।
আরও পড়ুন- কলকাতা ভোলেনি বন্দরের ‘গ্যাংযুদ্ধ’! সেকালের হত্যাকাণ্ডের সমাধানে ঘুম উড়েছিল পুলিশের
শোনা যায়, ২০০৫ সালে দাউদকে হত্যার পুরো পরিকল্পনা করেছিল র এবং আইবি। তৎকালীন আইবি চিফ অজিত ডোভালের পরামর্শে নেপাল থেকে আনানো হয় ছোটা রাজনের দুই শার্প-শুটারকে। প্ল্যান ছিল, দুবাইয়ে নিজের মেয়ের বিয়েতে দাউদ যোগ দিতে গেলে সেখানেই তাকে নিকেশ করা হবে। প্ল্যানটি কার্যকরী হওয়ার আগেই মাঝখানে চলে আসে মুম্বই পুলিশ। মনে করা হয়, মুম্বাই পুলিশের উচ্চস্তরে অনেকে দাউদের থেকে মাসোহারা পেতেন। উপরন্তু ততদিনে রিটায়ার হয়ে গিয়েছেন অজিত ডোভাল। যদি মুম্বই পুলিশ হস্তক্ষেপ না করতো তাহলে এতদিনে দাউদের নামের আগে ‘লেট’ বসেই যেত। অবসর গ্রহণের পরেও তিনি দেশের উন্নতিকল্পে কাজ করে গেছেন। ২০০৯ এবং ২০১১ সালে কালো টাকা এবং কর ফাঁকি নিয়ে প্রকাশিত তাঁর রিপোর্ট শোরগোল ফেলে দেয় দেশ জুড়ে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সওয়াল করেছেন ডোভাল। সেই থেকেই বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে অজিত ডোভালকে দেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। চাইলে পুলিশ সার্ভিসে থেকে অনেক আরামের জীবন কাটাতে পারতেন অজিত ডোভাল। কিন্তু তিনি তা করেননি। দেশের স্বার্থে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে গুপ্তচরের কাজ করেছেন, সামলেছেন কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিও। শুধুমাত্র মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করাই নয়, শত্রুকে চাপে ফেলে কাজ করিয়ে নেওয়াতে আজও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।