নিজেকে সবসময় অযোগ্য মনে করছেন? জানেন, কোন রোগে আক্রান্ত আপনি

Imposter Syndrome: ভারতের এমন বহু পেশাদার কর্মরত মানুষ আছেন, যাঁরা বেতন-সহ ছুটির সুযোগ নিতে লজ্জা বোধ করেন, কারণ তাঁদের মনের মধ্যে এক অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে।

রাঘব দেওপুরা পেশায় একজন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্মী। কঠোর পরিশ্রমী। তাঁর সহকর্মীদের কথায়, তিনি কখনওই দেরি করে অফিসে আসেন না। সময়মতো সমস্ত কাজ শেষ করেন এবং খুবই কম ছুটি নেন। অন্যদিকে, রাঘবের কথায়, সহকর্মীদের একথা মোটেও ঠিক নয়। তাঁর মতে, নিজের কাজের প্রতি তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। কিন্তু যখনই ছুটি নেওয়ার কথা ওঠে, তাঁর মনে হয় যে, তিনি কাজ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। আর এই অপরাধবোধ তাঁকে ভেতর ভেতর এতই কুরে খায় যে, শেষ অবধি ছুটি নিয়েই উঠতে পারেন না।

কি, ব্যাপারটা খুবই চেনা ঠেকছে! রাঘব বা আপনি একা নন, গবেষণা বলছে, ভারতের এমন বহু পেশাদার কর্মরত মানুষ আছেন, যাঁরা বেতন-সহ ছুটির সুযোগ নিতে লজ্জা বোধ করেন, কারণ তাঁদের মনের মধ্যে এক অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে। স্টাফিং ফার্ম রানস্ট্যাড ইন্ডিয়ার মতে, ভারতীয় কর্মচারীদের ৩৫ থেকে ৪০% মানুষ ছুটি নেন না এবং প্রায় ২৫% কর্মচারী মনে করেন যে, কাজ থেকে ছুটি নিতে ভয় পান। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা তেমন অদ্ভুত না ঠেকলেও এর পিছনে অন্য কারণ রয়েছে, মত মনোবিজ্ঞানীদের। মনস্তত্ত্ব-বিজ্ঞানের ভাষায়, ভারতীয়দের এই প্রবণতাকে ইমপোস্টার সিনড্রোম নামে অভিহিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা হবে ডিজিটাল! কেন আজ ভেঙে পড়ছে তিলে তিলে গড়া বাইজুস সাম্রাজ্য

ইমপোস্টার সিনড্রোম কী?
ইমপোস্টার সিনড্রোম হলো এমন এক মানসিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ নিজের যোগ্যতা বা অর্জনকে সন্দেহের চোখে দেখে। পাশাপাশি নিজেকে অযোগ্য বলেও মনে করেন। মনে মনে ভয় পায় যে, অন্যরা হয়তো তাঁর অযোগ্যতা জেনে যাবে। ক্রমশ তাঁর মনে হতে থাকে যে, নিছকই ভাগ্যগুণে সে জীবনে সবকিছু অর্জন করেছে। ১৯৭৮ সালে প্রথম ইমপোস্টার সিনড্রোম নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষণায় উঠে আসে যে, মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। কিন্তু পরবর্তীকালে গবেষণা করে জানা যায় যে, শুধু নারী নয়, পুরুষদের মধ্যেও ইমপোস্টার সিনড্রোম দেখা যায়।

'দ্য সিক্রেট থটস অব সাকসেসফুল উইমেন' বইয়ের লেখক ও একজন ইমপোস্টার সিনড্রোম-গবেষক ভ্যালোরি ইয়ং আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছেন।

১. পারফেকশনিস্ট
পারফেকশনিস্ট মানুষজন তাঁদের কাজকর্ম সবেতেই নিখুঁত হতে চেষ্টা করেন। ফলে ৯৯% সাফল্য এলেও তাঁরা নিজেকে ব্যর্থ বলেই মনে করেন। পাশাপাশি নিজেদের দোষারোপ করে নিজের কর্মদক্ষতা সম্পর্কেই সন্দিহান বোধ করেন। ১০০% পারফেকশন না থাকলে তাঁরা সাফল্যকে সাফল্য বলে মানতে নারাজ।

২. সহজাত প্রতিভাবান
সহজাত প্রতিভাবান মানুষের মধ্যে অনেকেই ধারণা জন্মায় যে, তাঁরা একবারের চেষ্টাতেই কাজটা করে ফেলবেন। কোনও কাজের জন্যই তাঁদের বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। কিন্তু কোনও কাজ তাঁরা যদি করতে না পারেন, বা অন্য কথায় আয়ত্ত করতে সময় লাগে তখন তাঁরা লজ্জা বোধ করেন। এটিও ইমপোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য।

৩. সুপারম্যান/ সুপারওম্যান
এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই সফল দেখতে বদ্ধপরিকর। আশপাশের মানুষদের থেকে তাঁরা সবসময়ই একধাপ বেশি পরিশ্রম করতে চান, কারণ তাঁদের প্রমাণ করতেই হবে যে, তাঁরা অযোগ্য নন। ফলে কাজের জন্য সর্বদা তাঁরা নিজেদের ওপর চাপ তৈরি করতে থাকেন।

৪. একাকী মননের ব্যক্তিত্ব
'আমার কারও সাহায্যের দরকার নেই, আমি সব নিজেই পারব', এমন চিন্তা থাকা ভালো। তবে এমন ভাবনা সবসময় ঠিক নয়। যদি কেউ সর্বদাই অন্যের সাহায্য নিতে প্রত্যাখ্যান করেন এই ভেবে যে, সাহায্য চাইলেই তাঁরা তাঁকে অযোগ্য বা ব্যর্থ মনে করতে পারে, তাহলে তিনি ইমপোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত।

৫. বিশেষজ্ঞ
বিশেষজ্ঞরা কোনও কাজে হাত দেওয়ার আগে সেই বিষয় সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নেন। তাঁরা মনে করেন, নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁকে সব তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। কর্মক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিরা সাধারণত কোনও প্রশ্ন করেন না। এদের ভেতরে ভয় কাজ করে, তাঁরা ভাবেন, যদি এই প্রশ্ন তাঁকে সকলের সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয় বা অন্যরা যদি তাঁকে বোকা ভাবে।

 

ইমপোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত বিখ্যাতরা
শুধু আমি-আপনি বা ভারতীয় কর্মচারীরা নন, বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ নিজের জীবনে এই মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এমনকী, এই তালিকায় বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মিশেল ওবামা, দু'-বারের অস্কারজয়ী অভিনেতা টম হ‍্যাংকস ইমপোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন। গবেষণায় জানা গেছে, ৭০% মানুষ জীবনে কোনও না কোনও সময় ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভোগেন।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন একবার তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন যে, তাঁকে নিয়ে যে প্রশংসা করা হয়, তা তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তাঁর কথায়, "আমার কর্মজীবন নিয়ে অতিরঞ্জিত ধারণা আমাকে অসুস্থ করে তোলে। নিজেকে একজন প্রতারক ভাবতে বাধ্য হই আমি।"

আমেরিকার প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা স্বীকার করছেন যে, ইমপোস্টার সিনড্রোম তাঁকে রীতিমতো বিকল করে দিয়েছে। নিজের ধ্যানজ্ঞান এবং আত্মবিশ্বাস আক্রান্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, "আমার এখনও কিছুটা ইমপোস্টার সিনড্রোম রয়েছে। এটা কখনওই চলে যায়নি এবং মনে হয়, বিশ্ব যদি আমাকে আরও গুরুত্ব সহকারে নিত, তাহলে জানি না আমার কী হতো!"

কীভাবে ইমপোস্টার সিনড্রোম কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?
যদি মনে হয়, আপনিও এই সমস্যায় ভুগছেন, তাহলে বেশ কিছু কথা মাথায় রেখে চলুন।

. নিজেকে কখনওই একা মনে করবেন না। বন্ধু ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কথা বলুন। দেখবেন, আপনার মতো বহু মানুষই এক সমস্যায় ভুগছে।

২. বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মক্ষেত্রে যেসব সহকর্মী বেতন-সহ ছুটির জন্য আপনাকে টিপ্পনী দিয়ে কথা শোনাচ্ছে, তাঁকে সরাসরি এড়িয়ে চলুন। এতে অপরাধবোধ খানিক কম হবে।

৩. আরও একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি, কর্মজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই ছুটি নেওয়া কোনও পাপ কাজ নয়। বরং ছুটি কাটিয়ে ফুরফুরে মেজাজে কাজে ফিরুন, দেখবেন, অনেক বেশি ভালো মানের কাজ করতে পারছেন।

. সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে শিখুন, কারণ সাফল্যের সিঁড়িই হলো ব্যর্থতা।

৫. পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আলাদা আলাদা ক্ষমতাসম্পন্ন। তাই অন্যের কাজের সঙ্গে নিজের তুলনা না করে নিজের অতীতের কাজের সঙ্গে এখনের কাজের তুলনা করুন। ফারাকটা নিজেই বুঝতে পারবেন।

More Articles