রাজনীতিতে ভরসা নেই যুবসমাজের, বিস্ফোরক তথ্য উঠে এল সমীক্ষায়
Indian Politics: সমীক্ষায় এও জানা গিয়েছে, ছেলেদের তুলনায় বেশি সংখ্যক মেয়ে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে।
মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হয় না। একথা বলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর লোকসভা এবং রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন সম্পন্ন হচ্ছে। এদিকে ভারত জুড়ে রাজনৈতিক হিংসা, প্রতিহিংসা-সহ অশুভ সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আর প্রবীণ রাজনৈতিক নেতারা জড়িয়ে পড়ছেন বিপুল পরিমাণ টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির পাশাপাশি যৌন কেলেঙ্কারিতেও। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্যে প্রতি পাঁচ বছর পরে নির্বাচন হয় ঠিকই। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি বহুক্ষেত্রেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করতে লাগাতারভাবে ব্যর্থ। যেমন, খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কালো টাকা দেশে ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতিও নিছকই কথার কথা থেকে গিয়েছে এপর্যন্ত।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন পরম্পরা। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের বেশিরভাগই প্রবীণ। এঁদের গড় বয়স ৬৫ বছরের ওপর। সেই হিসেবে বলা যেতে পারে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে অর্থাৎ ভারতীয় রাজনীতিতে ‘বৃদ্ধতন্ত্র’ বহাল। নতুন প্রজন্ম প্রত্যক্ষ রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহী। কেন এই পরিস্থিতি?
সমীক্ষা চালিয়ে জানা গিয়েছে, দেশের রাজনীতি ক্রমবর্ধমান দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এ কারণে তরুণ প্রজন্ম সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে অনিচ্ছুক। এদিকে দেশ পরিচালনার ভার তরুণ প্রজন্মের হাতে না তুলে দিলে, তরুণদের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেম জাগ্রত না করা গেলে বলাবাহুল্য, তা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে অশুভ। দেশপ্রেমই রাজনীতির বুনিয়াদ। এদিকে বর্তমানে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা নারীঘটিত কেচ্ছা, বিপুল অঙ্কের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির গান্ধী-মুক্ত ভারতের কৌশল না কি মোদি আমলেই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন নেতাজি!
২০৪৭ সালে এই দেশের মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ নাগরিকের বয়স হবে ২০ বছরের কম। গত কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ একথা জানিয়ে আরও বলেছিলেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নাগরিকই শহরাঞ্চলে বসবাস করবেন। অতএব শহরগুলিতে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা উত্তরোত্তর হারে বাড়বে। আর রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন এমন নাগরিকের সংখ্যাও বাড়তে চলেছে আকস্মিক কোনও পরিবর্তন না ঘটলে।
একদিকে তরুণ প্রজন্ম সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিতে অনিচ্ছুক, অন্যদিকে গোটা ভারত জুড়েই রাজনৈতিক পরিসরে দুর্বৃত্তায়ন চলেছে। সাংসদ থেকে শুরু করে বড়-ছোট-মেজো স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ ঘোরতর দুর্নীতিগ্রস্ত, সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে এসব আজ সাধারণ নাগরিকদের অজানা নয়। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট ও হির্শম্যান তাঁর লেখা বই, ‘এক্সিট, ওয়েজ অ্যান্ড লয়ালটি’তে লিখেছেন, তরুণ প্রজন্ম যে সমাজব্যবস্থায় বসবাস করেন সেই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন।
সম্প্রতি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে একটি সমীক্ষায়। স্বেচ্ছাসেবীরা ১১ বছরের নাবালক-নাবালিকা থেকে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত তরুণ-তরুণীদের উপর সমীক্ষা চালিয়েছেন। এদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যকেরই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভালো লাগে। যেমন, ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের ভিতর মোটে ১৯ শতাংশই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আস্থাশীল। বাকিদের মত উলটো।
একই সমীক্ষা চালানো হয়েছে ২১ বছর থেকে ২৪ বছরের তরুণ-তরুণীদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। তাতে ৪৭ শতাংশই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দ করলেও বাকিদের মত উলটো। রাজনীতিকদের প্রতি স্পষ্টভাবে অনীহা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরও জানা গিয়েছে। সমীক্ষা চালানো হয়েছে দেশের যে শহরগুলিতে সেই তালিকায় রয়েছে মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং হায়দরাবাদ। প্রসঙ্গত, দেশের মোট ২৪টি শহরে সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে। রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের প্রতি তরুণ প্রজন্মর সিংহভাগের হতাশা, আস্থাহীনতা স্বাধীন ভারতের পক্ষে যে অশুভ সঙ্কেত একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সংক্রান্ত যে সমীক্ষাগুলি চালানো হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলিতে নাম লেখাতে তরুণ প্রজন্মের ইচ্ছা ও আগ্রহের অভাব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
আরও পড়ুন-“কারও থেকে এক নয়া পয়সা নেব না,” দুর্দিনে সততা প্রমাণে মরিয়া শোভনদেব
তবে কি ভারতের তরুণ প্রজন্ম সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন নন? ব্যাপারটা আবার সেরকমও নয়। এই সম্পর্কিত এক সমীক্ষার ফলাফলে জানা গিয়েছে, কৈশোরকাল থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অধিকাংশই রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খবরাখবর রাখতে শুরু করেছে। এর পরিণামে রাজনীতিকদের একাংশের কার্যকলাপ তাঁদের কাছে গর্হিত বা নিন্দনীয় কাজ। যেমন, ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজের মতো করে খতিয়ে দেখে রাজনীতি সম্পর্কেই বীতশ্রদ্ধ। আর ২১ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশ এদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন। বাকিরা বিপরীত মতাবলম্বী। সমীক্ষায় এও জানা গিয়েছে, ছেলেদের তুলনায় বেশি সংখ্যক মেয়ে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে।
আরেকটি তথ্যও আকর্ষণীয় উঠে এসেছে সমীক্ষায়। স্কুল কলেজে পড়াকালীন যে পড়ুয়ারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে লড়াই করেছেন ভবিষ্যতে তাঁরাই রাজনীতি করতে আগ্রহী। বাকি যাঁরা স্কুল কলেজে পড়াকালীন প্রত্যক্ষভাবে কোনও ছাত্র সংগঠন করেননি তাঁরা কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে নাম লেখাতে অনাগ্রহী। বর্তমানে দেশের হাল সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের অভিমত নিয়েছেন সমীক্ষকরা। ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে রাজনীতিকদের ভাবনাচিন্তা করা উচিত। স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করাও রাজনীতিকদের জরুরি কর্তব্য বলে মনে করেন ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা। পরিবেশরক্ষার কাজেও রাজনীতিকদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন ৬৯ শতাংশ উত্তরদাতা। এছাড়া ৬৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা মনে করছেন তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলির দিকে নজর দেওয়া উচিত রাজনীতিকদের। প্রসঙ্গত, এই উত্তরদাতারা সকলেই তরুণ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন রোধ করতে দুনিয়ার ছাত্রসমাজই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে। এদিকে যাঁরাই রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন হচ্ছেন ছাত্র-যুবদের দাবিদাওয়া তাঁদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে। এই প্রবণতা অচিরে বিনষ্ট না হলে সেটা সমাজের পক্ষে অমঙ্গলজনকই। ভারতের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৩৯ কোটি। সারা পৃথিবীর নিরিখে ভারতেই সবচেয়ে বেশি যুব সম্প্রদায়ের বসবাস। কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্যানুসারে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরই বয়স ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এছাড়া ৮০ কোটির বেশি ভারতীয়ের বয়স ৩৫ বছরের কম। দেশের ভবিষ্যতের হাল যাঁদের হাতে তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই রাজনীতি বিমুখ হওয়ার ফল ভুগতে হবে আগামীদিনের ভারতকে, এই আশঙ্কা নিতান্ত অমূলক নয়।