হাতে হাতে ঘোরে ওপো-ভিভো, মোবাইল সংস্থার হাত ধরেই চিনা ষড়যন্ত্র
সম্প্রতি ভিভোর অফিসগুলিতে তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। গোটা দেশের প্রায় ৪৮টি অফিসে তারা তল্লাশি চালায় এবং তারা দাবি করে যে ভিভো কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যে প্রায় ৬২,৪৭৬ কোটি টাকা দেশ থেকে সরিয়েছে।
যুদ্ধ চলছে এক। ছায়াযুদ্ধ। সীমান্তে রয়েছে চাপা উত্তেজনা। ড্রাগনের আগ্রাসনকে রুখে দেওয়ার যুদ্ধ। সামরিকভাবে যা সম্ভব নয়, তাকে সম্ভব করার চেষ্টা চলছে অর্থনৈতিকভাবে। ভারত সরকারের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি গত কয়েক মাসে দেশজুড়ে চিনা মোবাইল ফোন সংস্থাগুলির অফিসে তল্লাশি চালিয়েছে এবং অভিযোগ এনেছে যে, ভিভো, ওপো, শাওমির মতো এই সংস্থাগুলি বিপুল পরিমাণ অর্থকর ফাঁকি দিয়েছে এবং সেই লক্ষ্য পূরণ করতে তারা সেইসব অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতিই যেমন ভিভোর অফিসগুলিতে তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। গোটা দেশের প্রায় ৪৮টি অফিসে তারা তল্লাশি চালায় এবং তারা দাবি করে যে ভিভো কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যে প্রায় ৬২,৪৭৬ কোটি টাকা দেশ থেকে সরিয়েছে। যা তাদের মোট ব্যবসার অঙ্কের প্রায় অর্ধেক। এই বেআইনি আর্থিক লেনদেনের পিছনে কয়েকজন চিনের নাগরিক এবং সেই সঙ্গে বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংস্থাও রয়েছে বলে ইডি সূত্রে জানা যাচ্ছে। কোন সময়ে ওই টাকা সরানো হয়েছে, সে-ব্যাপারে জানা না গেলেও ইডি জানিয়েছে, ওই আর্থিক লেনদেনের জন্যে তিন চিনা নাগরিক-সহ চার ব্যক্তি ২৩টি সংস্থা তৈরি করেছিলেন। ওই সংস্থাগুলির মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে বিদেশে।
এই ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু আজ থেকে নয়। বিগত ২-৩ বছর ধরেই চিনের মোবাইল সংস্থাগুলিকে এই ভাবে নজরবন্দি করেছে সরকার। শাওমি, ওপো- বাদ যায়নি কেউই। ইডি এই সবক'টি সংস্থার অফিসে হানা দিয়েছে, এবং কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ এনেছে। সেইসব ঘটনার বিস্তারিত তথ্য আপনারাও পেয়েছেন। এখানে বোঝার বিষয়টা হলো, এই তৎপরতার পিছনের কারণটা। কেন ভারত সরকার চিনের প্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে হামলা চালাচ্ছে?
আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার সংকটে বন্ধু ভারত, কীভাবে দেউলিয়া প্রতিবেশীকে সাহায্য করছে মোদি সরকার?
ভারত এবং চিনের বিরোধ কোনও নতুন বিষয় নয়। ঐতিহাসিকভাবেই এই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কে কখনও উষ্ণতা আসেনি। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের ক্ষত মিলিয়ে যাওয়াতো তো দূর, সীমান্তে সংঘর্ষ আরও তীব্র হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে চিনের পরিকাঠামো নির্মাণ করা এবং তারপর গালওয়ানে ২০২০ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। স্বাভাবিকভাবেই সাউথ ব্লকের ওপর কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে প্রত্যাঘাতের চাপ তৈরি হয়। কিন্তু ভারত কোনওদিক দিয়েই চিনের সমকক্ষ নয়, সেই সঙ্গে দেশের বাজারেও চিনের দ্রব্যরই আধিপত্য। চিনের এই আধিপত্য আজ বিশ্বজুড়ে। সমগ্র পৃথিবীর কারখানা বলা হয় চিনকে।
চিনের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ধীরে ধীরে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কাহিনি আমরা কম বেশি সবাই জানি। কিন্তু চিন তাতে থেমে থাকতে চায় না। বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে চায় তারা। শুধু সামরিকভাবে নয়, অর্থনৈতিকভাবেও, এবং সেই সঙ্গে যোগ হয়, তাদের গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। একটু পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ২০২০ সালে পৃথিবীর জিডিপি ছিল ১২৫.৬৫ ট্রিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে শুধু চিনের অবদানই ছিল ২৩.০১ ট্রিলিয়ন ডলার, বা ১৮.৩ শতাংশ। এর সঙ্গে এটার উল্লেখও প্রয়োজন যে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, যে হারে চিনের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে, তাতে তারা আগামী এক দশকে আমেরিকাকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
চিনের এই পৃথিবী জয় করার এই লক্ষ্যে অর্থনীতি সামরিক নীতির এক দূর্ধষ মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। সেই নীতির এক অন্যতম অস্ত্র হল The Belt and Road Initiative। ২০১৩ সালে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা। ৭০টি দেশে ভারী বিনিয়োগ করে সেইসব দেশের পরিকাঠামো উন্নয়ন করা। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি খুব আকর্ষক হতে পারে, কিন্তু বিষয়টি অতটা সহজ নয়।
চিন এই পরিকাঠামো নির্মাণ এবং উন্নয়ন করার কাজে বেছে নিচ্ছে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলিকে। তাদের দেশে পরিকাঠামো নির্মাণ করার প্রয়োজন কিন্তু অর্থের অভাব রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই চিনের বিপুল পরিমাণ ঋণের প্রস্তাব তাদের পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তারা সেই ঋণ গ্রহণ করছে, পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ হচ্ছে, কিন্তু ঋণের অর্থ তারা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলস্বরূপ সেই পরিকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ তো চিনের কাছে চলে যাচ্ছেই, সেই সঙ্গে তাদের বিদেশনীতির ওপরেও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। সেই সঙ্গে জায়গা প্রশস্ত হচ্ছে সেই দেশগুলিতে চিনের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার বন্দরের কথা। যা ৯৯ বছরের জন্য লিজে নিয়ে নিয়েছে চিন।
লক্ষনীয় বিষয় হলো, এই দেশগুলির মধ্যে অনেক দেশই ভৌগোলিকভাবে চিনের শত্রু দেশগুলির কাছাকাছি অবস্থিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বরাবরের ঘাঁটি দক্ষিণ আমেরিকাতেও এখন চিনা মোবাইল প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির রমরমা। আর্জেন্টিনা, চিলি, ইকুয়েডর, ব্রাজিল- এইসব দেশে গেলে আপনি অ্যাপেলের শোরুম না পেলেও শাওমি, ভিভো-র শোরুম পাবেনই। তবে প্রযুক্তি-ক্ষেত্রে এই আধিপত্য হিমবাহের চূড়ামাত্র। ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রেও প্রতিদ্বন্দীকে পিছনে ফেলতে চলেছে তারা।
একইভাবে আফ্রিকার বহু দেশকে পরিকাঠামো নির্মাণ করার জন্যে কোটি কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চিন। তাইওয়ান নিয়েও এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। কিছুদিন আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে আমেরিকা যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত।
পরিস্থিতি অরুণাচল সীমান্তেও বেশ গম্ভীর। দু'দিন আগেই ভারতের আকাশসীমার গা ঘেঁষে চিনের যুদ্ধবিমান বেরিয়ে গেছে। তাইওয়ানের ধাঁচেই বার বার আকাশসীমার নিকট চলে আসছে বা উল্লঙ্ঘন করছে চিন। আগামী বছর কাশ্মীরে G20 বৈঠক আয়োজন করা নিয়ে ইতিমধ্যেই আপত্তি জানিয়েছে চিন। ভারতকে শ্রীলঙ্কা, বা আফ্রিকার মতো কুখ্যাত 'Debt Trap'-এ চিন কোনওদিন ফেলতে না পারলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বেগ দিচ্ছে, এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের শত চেষ্টা সত্ত্বেও বিদেশনীতির ব্যর্থতা ঢাকা পড়ছে না। Line of Actual Control বা LAC পেরিয়ে চিন গ্রাম বানিয়ে ফেলছে, ব্রিজ বানিয়ে ফেলছে, সামরিক পরিকাঠামো বানিয়ে ফেলছে। সম্প্রতি চিন প্যাংগং লেকের কাছে এক শক্তিশালী সেতু বানিয়েছে, যা ট্যাঙ্ক বহন করতেও সক্ষম।
সেই সঙ্গে ভারতকে চিন্তায় রাখছে পাকিস্তান এবং চিনের এতটা কাছে আসা। ভারতীয় উপমহাদেশে চিনের Belt and Road Initiative-এর অন্যতম সঙ্গী পাকিস্তান। চিন থেকে কোটি কোটি ডলার ঢুকেছে পাকিস্তানের রাজকোষে।
বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। প্রায় সব চিনা প্রযুক্তি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তারা তথ্য চুরি করে নিজেদের দেশের প্রধান সার্ভারে পাঠাচ্ছে। সেই কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালে ভারত সরকার টিকটক, পাবজি-সহ ৩০০-র ও বেশি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। সেই একই সময় থেকেই শুরু হয়েছে শাওমি, ওপো, ওয়ান প্লাস, ভিভো-র মতো মোবাইল সংস্থাগুলিতে ইডির হানা। কর ফাঁকি দিয়ে নিজের দেশে অর্থ পাঠানোর অভিযোগে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বৈদ্যুতিন সামগ্রী, হাজার হাজার কোটি টাকা, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বহু অফিস। দেশে চিনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম আরও অনেক বেশি কড়া করা হয়েছে। চিনের Green Wall Motor এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা বাতিল করেছে এবং নিজেদের সব কর্মীকে ছাঁটাই করে দিয়েছে।
চিনের তরফ থেকে ভিভো কাণ্ডের প্রতিক্রিয়া আসতেও সময় লাগেনি। ভারতে তাদের দূতাবাস থেকে নিন্দা করা হয়েছে এই হানার। ভিভোর তরফ থেকেও দাবি করা হচ্ছে, তারা নির্দোষ।
কিন্তু একটা বিষয় খুব স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যেভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে সাহায্য করার নামে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে এবং বিশ্ব-অর্থনীতিতে ডলারের এবং মার্কিন সেনার যে আধিপত্য বিস্তার হয়েছে, সেই মডেলকেই চিন একবিংশ শতকে পৃথিবী জয় করার জন্য বেছে নিয়েছে। অবশ্য তাতে তাদের অনেক মৌলিক ভাবনাও রয়েছে।
বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই ছায়াযুদ্ধ চিন্তার ভাঁজ ফেলছে সবার কপালে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বদলে দিয়েছে সব সমীকরণ। এই পরিস্থিতিতে ইডির এই নিয়মিত হানা পরিস্থিতি কোনদিকে নিয়ে যায়, এখন সেটাই দেখার।