১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যে কৌশলে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করেছিল ভারত

India Pakistan War: পহেলগাঁও হামলার প্রেক্ষাপটে ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে কীভাবে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল, প্রায় ৫৫ বছর আগের সেই ইতিহাস আবারও আলোচনায় আসা দরকার।

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে নামে ভারত। ১৩ দিনের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রায় ৯৩০০০ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে। সেই যুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় হয় ভারতের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম আত্মসমর্পণ। এমনকী আত্মসমর্পণের দিন ঢাকার আশপাশে ভারতের মাত্র ৩ হাজার সৈন্য ছিল। সেই ৩ হাজার সৈন্য নিয়েই বাংলাদেশের ঢাকায় ভারত পাকিস্তানের ২৬ হাজার সেনাকে বাধ্য করেছিল আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু কীভাবে? কী কৌশলে ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিল ভারত?

পহেলগাঁও হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের প্রত্যাঘাত প্রত্যাশিত। ইতিমধ্যেই কূটনৈতিক স্তরে পাঁচটি বড় পদক্ষেপ করেছে ভারত। আট্টারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করা থেকে পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল, সামরিক উপদেষ্টাদের ফেরানো, সিন্ধু চুক্তিও বাতিল করেছে ভারত। এরই সঙ্গে ভারত সামরিক অভিযানও চালাবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিন বাহিনীকেই পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। মহড়াও শুরু করে দিয়েছে তিন বাহিনী। অন্যদিকে, পাকিস্তানও এর পাল্টা হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। তারা বলছে, হয় সিন্ধু নদ দিয়ে জল বইবে, নয় রক্ত। ভারতের কূটনৈতিক প্রত্যাঘাতের পাল্টা পাকিস্তানও আটটি বড় পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে। যার মধ্যে সিমলা চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইতিহাস কী বলে? আদৌ সামরিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ভারতকে কোণঠাসা করা সম্ভব? কী বলছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস?

অতীতেও ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে পাকিস্তানকে। তারপরও বারবার ভারতকে আঘাত করেছে পাকিস্তান। মুম্বই হামলা থেকে পুলওয়ামা, সাম্প্রতিক পহেলগাঁও হামলা। ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে কীভাবে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল, প্রায় ৫৫ বছর আগের সেই প্রেক্ষাপট আবারও তাই আলোচনায় আসা দরকার।

আরও পড়ুন-অতীতের ভুল শুধরেই বামপন্থার বিকাশ হবে বাংলাদেশে : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

এই যুদ্ধের বীজ বপন হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান তৈরির মাধ্যমে। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভারতের দুই প্রান্তে বিভক্ত ছিল পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে ছিল ১,৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড।

ধর্ম এক হলেও দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগতাবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মূলত বাংলাভাষীরা, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল উর্দু প্রধান। এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক নীতি এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে স্পষ্ট বৈষম্য ছিল। বলতে গেলে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে ছিল।

এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষা বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে, পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে শুরু হয় বাংলা ভাষা আন্দোলন। যাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ১৯৫২ সালে বিক্ষোভে মৃত্যু হয় অনেকের।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের পিছনে ছিল অর্থনৈতিক কারণও। পূর্ব পাকিস্তান পাট রপ্তানি করে ভালো আয় করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বিনিয়োগ পাচ্ছিল না এবং উন্নয়নের দিকেও পিছিয়ে ছিল। যা পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনকী সামরিক ও বেসামরিক চাকরিতেও বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব কম ছিল। একপ্রকার পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা কোণঠাসা ছিল পূর্ব পাকিস্তান।

১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে এই মোড় ঘুরে যায়। শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সামগ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে, যার ফলে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়।

আরও পড়ুন-ভাষা আর ধর্মের জাল থেকে কোনওদিন মুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ?

এরপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। আইন অমান্যের ডাক দেন শেখ মুজিব এবং ৭ মার্চ স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দমন করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। এই নৃশংস অভিযানে আওয়ামী লীগ নেতা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র এবং বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে বাংলাদেশে গণহত্যার সূচনা হয়। এই সংঘাতের সময় প্রায় ৩ থেকে ৩০ লক্ষ বাঙালি নিহত হয় এবং ২ থেকে ৪ লাখ নারী ধর্ষিতা হন।

সেই সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে চলে আসেন। ফলে ভারতের সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেন, ৭২টি দেশের কাছে এই সংকট মোকাবিলার আবেদন জানান। তবে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একগুঁয়েমি এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ব্যর্থতার কারণে ভারত গোপনে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়।

এছাড়া, শরণার্থী সংকট সমাধানে ভারতের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানকে দুর্বল করে দিয়ে ভবিষ্যতে দুই ফ্রন্টের যুদ্ধের হুমকিও দূর করেছিল ভারত। এই যুদ্ধে ভারতকে সমর্থন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে পাকিস্তানকে সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তান অপারেশন চেঙ্গিজ খানের মাধ্যমে উত্তর ভারতে আটটি ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়। এর ফলে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয় মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গী করে। এই যুদ্ধে ঢাকা দখলের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল, যাতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে। প্রায় ২৫০,০০০ সৈন্য এবং বিমানবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বহুমুখী আক্রমণ চালায় ভারত।

ব্লিটজক্রিগ কৌশল

পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে ভারত সাঁজোয়া যান ও কামান ব্যবহার করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল যশোর এবং কুমিল্লার মতো ভারী সুরক্ষিত 'দুর্গ'-গুলিকে বিচ্ছিন্ন করা।

বিমানবাহিনীর অবদান

ভারতীয় বিমান বাহিনী (IAF) এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ আকাশ অধিকার করে নেয়। তেজগাঁও, কুর্মিটোলা এবং অন্যান্য বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রনকে অবিরাম বিমান হামলার মাধ্যমে গ্রাউন্ডেড করা হয়। IAF পাকিস্তানি বিমান ক্ষেত্র, সরবরাহ ডিপো এবং সৈন্যদের লক্ষ্য করে ২০০০ টিরও বেশি অভিযান পরিচালনা করে ভারত।

নৌ অবরোধ

বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ INS বিক্রান্তের নেতৃত্বে ভারতীয় নৌবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানি বন্দর অবরোধ করে, সরবরাহ লাইন এবং পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর পূর্ব শাখাকে হারিয়ে সি হক বিমান চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং কক্সবাজারে আঘাত হানে।

মুক্তিবাহিনীর সহায়তা

মুক্তিবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে, নাশকতা পরিচালনা করে এবং গেরিলা আক্রমণে লিপ্ত হয়, পাকিস্তানি সরবরাহ এবং মনোবলকে ব্যাহত করে। তাদের স্থানীয় জ্ঞান ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূখণ্ডে কার্যকরভাবে চলাচল করতে সাহায্য করেছিল।

১৩ দিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রণক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল। ১৯৭১-এর ২৮ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর জাট রেজিমেন্ট (২ জ্যাট) সহ ভারতীয় বাহিনী একটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নকে পরাজিত করে এবং ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের তৈরি করে।

এরপর ২০-২১ নভেম্বর ভারতীয় সেনা এবং মুক্তিবাহিনী জোট বেঁধে বয়রা প্রধান অঞ্চল দখল করে এবং পশ্চিমের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা দুর্বল করে দেয়।

যশোর মুক্তি (৬-৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১)

৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যশোর পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত প্রথম জেলা হয়ে ওঠে। যা ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের মনোবল বৃদ্ধি করে।

সিলেটের যুদ্ধ (৭-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১)

ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলে, যার ফলে সিলেট ও মৌলভীবাজার মুক্ত হয়।

আরও পড়ুন-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী: শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা

মিশন ঢাকা (৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১)

ভারতীয় বাহিনীর সৈন্য বিমানে করে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ভেদ করে, মেঘনা নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়।

এরপর ভারতীয় সেনা এবং মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ১৪ ডিসেম্বর টঙ্গী এবং ১৬ ডিসেম্বর সাভারে পৌঁছায়। ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর চাপে পিছু হটতে হয় পাকিস্তানি বাহিনীকে। তারা তাদের দুর্গ ঢাকাকে রক্ষা করতে অক্ষম হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী শহরটি ঘিরে ফেলে। একদিকে ভারতীয় বিমানবাহিনী আকাশে আধিপত্য বিস্তার করে, অন্যদিকে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রপথ অবরুদ্ধ করে। ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪:৩১ মিনিটে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজি ঢাকার রমনা রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার উপস্থিত ছিলেন।

সেইদিন প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, যার মধ্যে ৭৯,৬৭৬ জন উর্দিধারী সেনা এবং বাকি বেসামরিক নাগরিক ছিলেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম সামরিক আত্মসমর্পণ ছিল। এই আত্মসমর্পণের ফলে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়, যার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের এই বিজয়কে সামরিক কৌশল এবং ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার বিজয় হিসেবেও উদযাপন করা হয়।

সুতরাং পাকিস্তান এখন যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিলেও ইতিহাস বলছে সামরিক শক্তিতে, কূটকৌশলে সমস্ত দিক থেকেই ভারত এগিয়ে ছিল। ফলে আজ কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

More Articles