যুদ্ধের ফাঁকা আওয়াজ? কেন পাক সেনাকে নিয়ে ক্ষুব্ধ সে দেশের জনগণই?

India Pakistan War: ভারতকে যুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার পিছনে পাক সেনাবাহিনীর কোনও গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে? যদি ভারত আগে আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানকে পরাজিত করে তাহলেও কি শেষমেষ পাকিস্তানের সেনারই লাভ?

কাশ্মীর উপত্যকার সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহ — বিশেষ করে পহেলগাঁও উপত্যকায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং তার পাল্টা ঝিলম নদীর উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্ককে ফের এক সংঘাতের কিনারায় এসে দাঁড় করিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মীর আইনত ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কিন্তু পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই দ্বিজাতি তত্ত্বের মতাদর্শের উপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে বারবার সন্ত্রাসের বীজ রোপণ করেছে। পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন — পাকিস্তানের মাটিতে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিরা এবারে আর রেহাই পাবে না। ভারতীয় সেনা তাদের চিহ্নিত করবে, খুঁজে বার করবে এবং ভারত প্রতিশোধ নেবে। এই বক্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আবারও তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান তাঁর পরিবারকে আমেরিকায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এমন এক কঠিন সময়ে যখন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ রাজনীতিতে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো অস্থিরতা, তখন প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কি সত্যিই যুদ্ধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে? ভারত এবং পাকিস্তান যদি যুদ্ধে নামে, যদি একে অপরের সরাসরি মুখোমুখি হয়, পাকিস্তান পারবে ভারতকে আদৌ পরাজিত করতে? পরিসংখ্যান এবং প্রযুক্তি কিন্তু বলছে, যুদ্ধ হলে তবে পাকিস্তান ভারতের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকবে। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ভারতের কাছে বর্তমানে রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ সবথেকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, যেখানে পাকিস্তান রয়েছে দ্বাদশ স্থানে।

বিমান নৌ এবং স্থল — তিন অক্ষেই ভারত এগিয়ে

২০২৩ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল প্রায় ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭.৮ বিলিয়ন ডলার যা ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ। এই ব্যবধানই বুঝিয়ে দেয় পাকিস্তানের তুলনায় ভারতে এই মুহূর্তে কতটা এগিয়ে রয়েছে। ভারত চাইলেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধ চালাতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করলে সপ্তাহের মধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়বে কারণ বাজেট একেবারেই নেই। পাশাপাশি, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট মূলত আইএমএফ এবং চিনের ঋণ এবং অনুদানের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যদি পাকিস্তান যুদ্ধ করেও, তাহলেও এই যুদ্ধের খরচ পাকিস্তানকে বহন করতেই হবে। পাকিস্তানের অর্থনীতি দেউলিয়া, তাদের বিমান খুব বেশি ক্ষমতা বিশিষ্ট নয়। অপরদিকে, ভারতের কাছে রয়েছে এমন কিছু যুদ্ধবিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র, যা পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে পরাজিত করতে পারবে। নৌ, স্থল এবং বিমান বাহিনী থেকে পরমাণু অস্ত্র— সব ক্ষেত্রেই ভারত পাকিস্তানের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।

১. ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র এবং রাফাল যুদ্ধবিমান

রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রটি সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সেনাবাহিনীর এক অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই একবার পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করেছে এই ক্ষেপণাস্ত্রটি, যদিও সেবার দুর্ঘটনাবশত এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ হয়ে গিয়েছিল। ৩০০ কিলোমিটারের বেশি রেঞ্জবিশিষ্ট এই বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ, স্থল এবং জলযান থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়। রাফাল যুদ্ধবিমান এবং স্ক্যাল্প মিসাইলও ভারতের ক্ষমতাকে বহু গুণ বৃদ্ধি করেছে।

আরও পড়ুন-পাক সেনার অন্দরে: ভারতের মুখোমুখি হওয়ার সামর্থ্য আদৌ আছে?

২. সু-৩০ এমকেআই এবং তেজস

ভারতের Su-30 MKI ব্রহ্মস উৎক্ষেপণ করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। যেকোনও যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই বিমানটি এফ-১৬, এফ-১৫ কিংবা ইউরোফাইটারের মতো প্রতিপক্ষ বিমানকে পরাজিত করতে সক্ষম। অন্যদিকে, বর্তমানে ভারতের কাছে তেজস MK-1A লাইন আপের সাতটি বিমান রয়েছে, যেগুলি যেকোনও সময় পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমানকে ধ্বংস করে দিতে পারে এবং এই বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করতে সহায়তা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

৩. এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত S-400 ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষাকে রীতিমতো দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বে একাধিক লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত এবং ধ্বংস করতে সক্ষম এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাকিস্তানের চতুর্থ প্রজন্মের বিমান বহরকে প্রায় অকার্যকর করে তুলেছে।

৪. সেনা সংখ্যা এবং সামরিক বহরের ব্যবধান

এই মুহূর্তে ভারতের কাছে প্রায় ১৪ লক্ষ সক্রিয় সৈন্য এবং বিপুল রিজার্ভ ফোর্স রয়েছে, যা পাকিস্তানের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা থেকে অনেক বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ। এছাড়াও ভারতের কাছে ৪২০০ এর বেশি ট্যাংক, ৪৪৫০০-এর বেশি সাঁজোয়া যান রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের কাছে এই সংখ্যা যথাক্রমে ২৬০০ ও ১৭,৫০০।

৫. পারমাণবিক শক্তির বাস্তবচিত্র

পাকিস্তান প্রায়শই বিভিন্ন জায়গায় পারমাণবিক অস্ত্রের কথা বলে নানাভাবে ভারতকে হুমকি দেয়। কিন্তু যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানেরই ক্ষতি হবে। যদি পাকিস্তান মনে করে, শুধুমাত্র পারমাণবিক সক্ষমতা তাদের শক্তিশালী করবে, তাহলে তা ভুল। তার প্রধান কারণ, ভারতের কাছেও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। পাকিস্তানের থেকে বেশিই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।

আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের কাছে ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের কাছে রয়েছে ১৮০ টি। এছাড়াও, পাকিস্তানের সব থেকে উন্নত মানের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র শাহীন ৩-এর পাল্লা সর্বাধিক ২৭৫০ কিলোমিটার, যেখানে ভারতের অগ্নি ৫ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রটির সর্বাধিক পাল্লা ৫,৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ভারতের এই ব্যালেস্টিক মিসাইলের ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, পাকিস্তান কিছু বুঝে ওঠার আগেই অগ্নি পাক ভূখণ্ডে প্রবেশ করে যাবে।

কৌশলগতভাবে, পাকিস্তান সবসময়ই পারমাণবিক অস্ত্র প্রথম ব্যবহার করার হুমকি দেয়, কারণ এই অস্ত্র ছাড়া তাদের কাছে বিশেষ কোনও কিছু নেই। সেনা ক্ষমতার দিক থেকেও ভারতের থেকে অনেকটা পিছিয়ে পাকিস্তান। ভারত শান্তিকামী দেশ। পরমাণু শক্তি অর্জনের পর থেকেই ভারত 'নো ফার্স্ট ইউজ' নীতি মেনে চলে। এই নীতি চালু করেছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ভারত কখনই প্রথমে পারমাণবিক হামলা করবে না। যদি পাকিস্তান ভারতের উপর প্রথম হামলা করে, তাহলে ভারতও জবাব দিতে পারে। ভারত প্রথম অস্ত্র ব্যবহার না করলেও, ভারতের কাছে পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে।

৬. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেদিক থেকেও ভারত পাকিস্তানের থেকে অনেকটা এগিয়ে। ভারতের বন্ধু আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইজরায়েল এবং জাপানের মতো শক্তিশালী দেশগুলি। অন্যদিকে, পাকিস্তানের বন্ধু বলতে কেবল চিন। তবে, চিন যে পাকিস্তানের কতখানি বন্ধু, তা এখনও পরিষ্কার নয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে, চিন কোনও দেশেরই সরাসরি বন্ধু হতে চায় না, চিন সেই দেশকে শুধুমাত্র বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করে এবং নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে চায়।

এমনিতেই, পাকিস্তান কিছুদিন আগেই FATF-এর 'গ্রে লিস্ট' থেকে বেরিয়েছে। চিনের কারণে কোনওভাবে পাকিস্তান নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, না হলে বহু আগেই পাকিস্তান সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়ে যেত। তাই এই অবস্থায় পাকিস্তান যুদ্ধ করতে গেলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও একঘরে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

প্রশ্ন ওঠে, এত সমস্যা থাকার পরেও পাকিস্তান কেন পহেলগাঁওয়ে এই হামলা চালাল? ভারতকে যুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার পিছনে পাক সেনাবাহিনীর কোনও গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে? যদি ভারত আগে আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানকে পরাজিত করে তাহলেও কি শেষমেষ পাকিস্তানের সেনারই লাভ?

আরও পড়ুন-পহেলগাঁও সামলাতে সরাসরি ট্রাম্পের সাহায্য প্রার্থনা কেন পাকিস্তানের?

যুদ্ধ পরিস্থিতি ও পাক সেনার অবস্থান

পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদের মধ্যে পাক সেনাবাহিনীকে নিয়ে বহুদিন ধরে ক্ষোভ রয়েছে। তার মধ্যেই আবার আফগানিস্তানে তালিবান শাসন শুরু হওয়ার পর তারা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে, যেটা পাকিস্তানের জন্য সুবিধার নয়। আফগানিস্তানের প্রভাব পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে একটু বেশি। সেখানে টিটিপি লাগাতার হামলা চালিয়ে প্রতিদিন পাক সেনাবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করছে। অন্যদিকে, বালুচিস্তান সমস্যা নিয়ে রীতিমতো জর্জরিত পাকিস্তান। একইসঙ্গে আবার, পাকিস্তানের সেনার বাজেট বরাদ্দ নিয়েও অখুশি সেদেশের সাধারণ মানুষ। সেই কারণেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানের আর্থসামাজিক অবস্থা এতটা খারাপ হওয়া সত্ত্বেও, কেন সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে? এর পিছনেও কি রয়েছে পাকিস্তানের সেনার রাজনীতি? ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার এবং পাকিস্তানের সাধারণ জনতার দৃষ্টি ঘোরানোর শেষ চেষ্টার প্রতিফলন?

অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও সেনা কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল জীবন

পাকিস্তানের সাধারণ জনজীবন অনাহার, মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত। ২০২৩ সালের মে মাসে এই দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৩৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে, পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি ২৯.২ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে আর মাত্র ৫৪ দিনের জন্য। অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানরা এখনও রয়েছেন রাজার হালে। পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা ভারতের থেকেই কিছুটা আলাদা। পাকিস্তানে প্রশাসনিক ক্ষমতার থেকেও সামরিক ক্ষমতা বেশি কার্যকরী। পাকিস্তানের সামরিক প্রধান যেকোনও সময় চাইলেই পাকিস্তানের প্রশাসনিক প্রধানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন, সরকার পাল্টে দিতে পারেন। ফলে, পাকিস্তানে নির্বাচিত কোনও সরকার পাকিস্তানের সেনার বিরুদ্ধে যেতে চায় না।

কিন্তু সেনা চালাতে গেলে টাকার দরকার। বাজেটে যা বরাদ্দ তাতে সেনাবাহিনী টিকিয়ে রাখাও কঠিন। তাই টাকা রোজগারের জন্য এই দেশের সেনাবাহিনী শুধু প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, ব্যবসায়িক সংস্থা হিসেবেও কাজ করে। সাধারণ ব্যবসায়িক সংস্থা নয়, এই ব্যবসায়িক সংস্থার আয় মোটামুটি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। তবে, এই টাকা সেনার কাজে লাগে না, সরাসরি চলে যায় সেনাপ্রধানদের গুপ্ত অ্যাকাউন্টে। পাকিস্তান সেনা সারা দেশে তৈরি করেছে ফৌজি ফাউন্ডেশন, বাহারিয়া ফাউন্ডেশন, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মতো বিভিন্ন সংস্থা। নাম দেখে জনকল্যাণমুখী এবং সেনাকল্যাণমুখী সংস্থা মনে হলেও এগুলি একেবারেই জনগণ কিংবা সাধারণ সেনাকর্মীদের জন্য কাজ করে না।

এই সবক'টি সংস্থাই এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সার থেকে সিমেন্ট, ব্যাংকিং থেকে রিয়েল এস্টেট, এমনকী দুগ্ধজাত দ্রব্য প্রস্তুতের ব্যবসাতেও এই সংস্থাগুলি নিজেদের জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। এই সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ সরাসরি রয়েছে পাকিস্তানি সেনার হাতে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে জানানো হয়, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মীদের সাহায্যের জন্য এই সংস্থা চালু করা হয়েছে এবং এখান থেকে যে টাকা আসে সেটা পুরোটাই অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা এই টাকার কিছুই পান না। এই কোম্পানিগুলির মূল লভ্যাংশের সিংহভাগই গ্রহণ করেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পাকিস্তানের ফৌজি ফাউন্ডেশনের ফৌজি ফার্টিলাইজার কোম্পানির সাবসিডিয়ারি আকসারি ব্যাংক বর্তমানে পাকিস্তানের সবথেকে বড় ব্যাংকগুলির মধ্যে একটি। তাই, সরাসরি বেতন কম হলেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আয় বেশ ভালো করেন।

পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের আয়ের এই বৈপরীত্য জনমানসে ক্ষোভ তৈরি করেছে, যা সামরিক বাহিনীর কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক ভাঙনে যখন সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত, তখন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং ব্যবসায়িক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সরকারি যেকোনও কাজের টেন্ডার সরাসরি এই সংস্থাগুলির হাতে যায়। ফলে, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ব্যবসা করতে পারেন না। সুতরাং, যদি এমন এক সময়ে দেশের মানুষের মধ্যে যুদ্ধের ভয় তৈরি করা যায়, তাহলে সেনাকে আবারও জাতির রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা প্রশ্নগুলিকেও সহজেই দমন করা যাবে।

আধিপত্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা

পাকিস্তানের ইতিহাসের সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা নতুন নয়। ১৯৯৯ সালে যখন ভারতের বিরুদ্ধে কার্গিল যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান, সেই সময় পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিকে না জানিয়েই সেনাবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেন। প্রেক্ষাপট যাই হোক, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সবসময় নিজেকে জাতির ত্রাতা, ধর্মের রক্ষক এবং ভারত-বিরোধী সংগ্রামে অগ্রণী হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, রাজনৈতিক পালাবদল এবং ইমরান খানের উত্থান সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যগত আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে সরাসরি।

এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জনসমর্থন আবার আদায় করতে হলে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন এক নতুন জাতীয় আবেগ — যা আবারও সেনাবাহিনীর গুরুত্বকে তুলে ধরবে। যুদ্ধ বা তার সম্ভাবনাই এই সুযোগ তৈরি করবে পাকিস্তানের সেনার জন্য। 

যুব সমাজের বিচ্ছিন্নতা এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি নড়বড়ে

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল একটি ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে। হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে মুসলিমরা দাবি করেছিলেন নিজেদের দেশ। আজ থেকে প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে যখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, সেই সময় ভারত তথা হিন্দু বিরোধী বিভিন্ন আখ্যান ছড়িয়ে দেওয়াও খুব সহজ ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে গিয়ে যখন ভারত এবং পাকিস্তানের মানুষজন একসঙ্গে কাজ করছে, তখন স্পষ্ট হচ্ছে যে এতদিন তাদের ভারত নিয়ে যা বুঝিয়ে আসা হয়েছে তা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। ফলে তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় মিথ্যা প্রচারণার জালে বন্দি নয়। সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বাজেট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিংবা ভারতের সঙ্গে চিরন্তন বৈরিতার ধারণাকে তারা আর নিঃশর্তে মেনে নিতে চাইছে না।

এই হামলার পর পাকিস্তানের গণমাধ্যম পুরো ঘটনাকে যখন মিথ্যা ও সাজানো বলে দাবি করছে, প্রচার করা হচ্ছে এটি ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত প্রচারণা— তখন তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় এই আক্রমণের বিরোধিতা করছে। এর আগেও ২০১৯ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের টুইটারে ট্রেন্ড হয়েছিল #SayNoToWar। ২০২৪ সালে যখন বৈষ্ণোদেবী হামলা হয় তখন পাকিস্তানের জোরে বোলার হাসান আলি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন, "All Eyes On Vaishno Devi Attack"। ফলে, পাকিস্তানের সাধারণ তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ যে আর এই বৈরিতা নিয়ে চিন্তিত নয় সেটা অনেকটাই পরিষ্কার।

আরও পড়ুন-১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যে কৌশলে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করেছিল ভারত

দ্বিজাতি তত্ত্ব ও হিন্দু-মুসলিম বিভেদ

পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের নজর ঘোরানো এবং পুরনো হিন্দু মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন পাকিস্তান সেনা জেনারেল আসিফ মুনির। সম্প্রতি ভাইরাল একটি সোশ্যাল মিডিয়া বিবৃতিতে তিনি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে আর্জি রেখেছেন, যাতে তারা নিজেদের "হিন্দুদের থেকে আলাদা" মনে করেন। মুনির পাকিস্তানের সাধারণ অভিভাবকের কাছে আর্জি রেখেছেন যেন তারা নিজেদের সন্তানদেরকেও বোঝান যাতে তারা হিন্দুদের সঙ্গে বেশি সখ্য না রাখে, একসঙ্গে কাজ না করে। আবারও সেই বিভেদমূলক দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ প্রয়োগ এবং তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে।

পাকিস্তানের কাশ্মীর কার্ড ও চিরশত্রু তত্ত্ব

ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যে সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কাশ্মীর কার্ড। এই অঞ্চলের সাধারণ মুসলিমদের এতদিন ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করত পাকিস্তান। ২০১৯ সালে ভারতের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর পাকিস্তানের সবথেকে বড় কূটনীতিক অস্ত্র কাশ্মীর ইস্যু অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক স্তরে এই ইস্যু আর আলোচনার কেন্দ্রে নেই। কাশ্মীরে পর্যটন ব্যবসা বেড়েছে। এই অবস্থায় মরশুমের শুরুতেই কাশ্মীরে এই হামলা কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবসায় এক বড় ধাক্কা ছিল। এবারে এই হামলার পর কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ এই হামলার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন, যা এর আগে বিশেষ একটা দেখা যায়নি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দেশে এবং এদেশের কাশ্মীরে "ভারত মুসলিমদের চিরশত্রু" তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জন্মলগ্ন থেকেই মরিয়া। বালুচিস্তানের বিক্ষোভ, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় টিটিপি আর্মির আক্রমণ, সিন্ধুতে বিক্ষোভ এবং পঞ্জাবে ইমরান খানের সমর্থকদের বিক্ষোভকে সামলাতে পুরোপুরি ব্যর্থ এই সেনাবাহিনী। ১৯৪৭ সালের কাশ্মীর দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা লাহোরের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয় এবং পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করে। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধেও ভারত পাকিস্তানকে পরাজিত করে। পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তান তাদের সৈন্যদের লাশ পর্যন্ত নিতে অস্বীকার করেছিল।

তাই পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সামরিক দিক থেকে পেরে উঠবে না সম্ভবত। পাক সেনাপ্রধানরাও তা জানেন। রাই হয়তো পাকিস্তান আমেরিকার মধ্যস্থতাও আশা করছে ভারতের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার হুমকি, সিমলা চুক্তি খণ্ডনের হুমকি শুধুই ফাঁকা হাওয়া? না কি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনে পাক সেনার জায়গা নতুন করে তৈরি করার একটা পূর্বপরিকল্পিত প্রচেষ্টা?

More Articles