পঞ্চাশ বছর বয়সে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় পাশ, এই সাফাইকর্মীর গল্প অনুপ্রেরণা!
পথ একদম সহজ ছিল না। তা সত্ত্বেও কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন একনাগাড়ে। সকালে করেছেন সাফাইয়ের কাজ তো আবার বিকেলে পৌঁছে গিয়েছেন স্কুল।
মানুষের জীবনে সাফল্যের কাহিনি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়, তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে তার সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর নেপথ্যে অক্লান্ত পরিশ্রমের চিত্র একই থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা খবরের কাগজে আমাদের সামনে এরকম বিভিন্ন মানুষের সাফল্যের কাহিনি উঠে আসে, যা আমাদের নতুন স্বপ্নে এবং এক নতুন উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হতে সহায়তা করে। যেমন মাশান্না রামাপ্পা, পঞ্চাশ বছর বয়সেও যিনি হার মানেননি এবং এগিয়ে চলেছেন জীবনযুদ্ধে।
কথায় আছে, শিক্ষা গ্রহণের প্রতি অসামান্য মানসিক জেদ এবং প্রবল ইচ্ছা থাকলে চূড়ান্ত প্রতিকূলতা এড়িয়েও পাহাড়প্রমাণ উচ্চতা অতিক্রম করা যায়। নিজেকে শিক্ষিত করা প্রতিটি মানুষের অধিকার। পড়াশোনা করে শুধুমাত্র ভালো জায়গায় চাকরি পাওয়াই নয়, নিজেকে শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রধান মাধ্যম হলো শিক্ষা। তবে আমাদের দেশে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁদের প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয় পড়াশোনা। সাংসারিক অনটনের কারণে শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে ওঠে না তাঁদের! স্বপ্নপূরণের প্রবল ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক অনটনের কারণে ছোট বয়সেই বেরিয়ে পড়তে হয় রাস্তায় এবং রোজগারের কাছে হার মানে অধ্যয়নের জেদ। পরবর্তীকালেও সন্তানদের বড় করার স্বার্থে স্বপ্নকে এখনকার নিজের হাতেই করতে হয় খুন! তবে এর মাঝে এমন বহু মানুষের কাহিনি আমাদের সামনে উঠে আসে, যাদের সামনে কোনওরকম বাধাই বড় হয়ে দেখা দেয় না। সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে অংশগ্রহণ চলে তারা।
এমনই একজন হলেন মুম্বইয়ের বাসিন্দা মাশান্না রামাপ্পা। মুম্বইয়ের কুঞ্চিকভ এলাকার এই ব্যক্তি পঞ্চাশ বছর বয়সেও মানেননি হার। অবশেষে প্রবল মানসিক জেদের দ্বারাই করে ফেলেন স্বপ্নপূরণ। কী সেই স্বপ্ন?
আরও পড়ুন; এমবিএ করে চায়ের দোকান! এই ‘চা-ওয়ালা’ এখন দেশের অনুপ্রেরণা
পেশায় একজন সাফাইকর্মী রামাপ্পার জীবনকাহিনি একাধিক উত্থানপতনের সাক্ষী থেকেছে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অসামান্য আগ্রহ ছিল তাঁর। তবে সাংসারিক অনটনের মাঝে ধামাচাপা পড়ে যায় সেই স্বপ্ন। যেখানে ছোটবেলায় কোনওমতে একবেলা খাবার খেয়েই কাটত দিন, সেখানে দাঁড়িয়ে স্কুল যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় রামাপ্পার! এরপরই রোজগারের তাগিদে বেরিয়ে পড়তে হয় বাইরে। ছোট বয়স থেকেই সংসারের হাল ধরার পাশাপাশি রোজগারে মনোনিবেশ করেন তিনি। ফলে কর্মব্যস্ততার মাঝে আর বিদ্যালয় যাওয়া হয়ে ওঠে না পেশায় এই সাফাইকর্মীটির। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে, বিয়ে করে সংসার করা শুরু করলেও মনের মধ্যে থেকে যায় পড়াশোনা করার তাগিদ আর সেই কারণেই বর্তমানে পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে অবশেষে মাধ্যমিক পাশ করে জীবনের প্রথম স্বপ্নপূরণ করে ফেললেন মাশান্না রামাপ্পা।
বর্তমানে পঞ্চাশ বছর বয়সি এই সাফাইকর্মী স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই সংসার করেন। এমনকী, সন্তানরাও প্রত্যেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। অতীতে কেবল ছেলেমেয়েদের মধ্য দিয়েই নিজের ছোটবেলার মনবাসনা পূরণ করে চলেছিলেন তিনি। তবে কথায় আছে, যদি মনের মধ্যে কোনও লক্ষ্য অর্জন করার প্রবল বাসনা থাকে, তবে তা বয়স দেখে না; অবশেষে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করতে দেখে পুনরায় একবার শিক্ষাগ্রহণের তাগিদ জেগে ওঠে রামাপ্পার মনে। ফলে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে মুম্বইয়ের রাস্তায় রাস্তায় সাফাইকর্মীর কাজ করার পর রামাপ্পা অবশেষে শুরু করেই দেন লেখাপড়া।
এক্ষেত্রে পথ একদম সহজ ছিল না। তা সত্ত্বেও কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন একনাগাড়ে। সকালে করেছেন সাফাইয়ের কাজ তো আবার বিকেলে পৌঁছে গিয়েছেন স্কুল। উল্লেখ্য, তিন বছর পূর্বে একটি রাত্রিকালীন স্কুলে ভর্তি হয়ে যান রামাপ্পা। সেখানে অবশ্য প্রথম ক্লাস থেকে তাঁকে ভর্তি হতে হয়নি, এক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণি থেকে তাঁর শিক্ষা গ্রহণের সূচনা হয়। তবে শুধুমাত্র স্কুলে পড়াশোনা করাই নয়, পরবর্তীকালে বাড়িতে ফিরেও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে পড়াশোনায় বসতেন তিনি।
মুম্বইয়ের সাফাইকর্মীর এহেন জীবনযুদ্ধ বর্তমানে প্রতিটি দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টাই নয়, স্বপ্নপূরণ করার এই জীবনযুদ্ধে রামাপ্পা পাশে পান তাঁর গোটা পরিবারকে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরাও বাড়িয়ে দেয় হাত। পড়াশোনায় সাহায্য করার পাশাপাশি ঘরে ছোটখাটো কাজেও সাহায্য করতে থাকে সকলে আর এর ওপর ভর দিয়েই এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ফলপ্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খুশি নেমে আসে গোটা এলাকায়। দশম শ্রেণির পরীক্ষা পাশ করাই শুধু নয়, সাফাইয়ের কাজের সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে ৫৭ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে রামাপ্পা জানান, 'ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি আমার তাগিদ ছিল। কিন্তু সংসারের হাল ধরার জন্য আমাকে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে ছেলেমেয়েদের দেখে আবারও মনের ভেতর ইচ্ছে জাগে আর তা পূরণ করার জন্যই সাফাইয়ের পাশাপাশি স্কুলে যাওয়াও শুরু করি। তবে একটা কথা বলতেই হবে যে, আমার এই সংগ্রামে পুরো পরিবারকে পাশে পাই আর সেই কারণেই এ-বছর দশম শ্রেণির গণ্ডি পার করতে পেরেছি। পরবর্তীকালেও পড়াশোনা করার ইচ্ছা রয়েছে। অবশ্য তার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলাও আমার দায়িত্ব।' সব মিলিয়ে বর্তমানে তাঁর এই সাফল্যে খুশি দেশবাসী।