জীবনটাকে একটা অ্যাডভেঞ্চার বলেই গ্রহণ করছি: জেল থেকে লিখেছিলেন নেতাজি

Letters of Netaji Subhas Chandra Bose: "সন্ন্যাস মানিনা – তাই দুঃখকে অস্বীকার করবার আমার অধিকার নাই।" জেল থেকে মা-কে যে চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি

রেঙ্গুন সেন্ট্রাল জেল ।

 ২০।১২।২৬

শ্রীচরণেষু 

মা, অনেকদিন পরে আপনার চিঠি পেয়ে শান্তি পেলাম ৷ আমি ১৩ই সেপ্টেম্বরে আপনাকে পত্র দিয়েছি—তার পর ১৭ই নভেম্বরে আবার দিয়েছি। শেষ পত্র বোধ হয় এতদিনে আপনি পেয়েছেন ৷ আপনার ৩রা ডিসেম্বরের পত্র আজ পেলাম। আজ ৫।৬ দিন হ'ল আমি ম্যাণ্ডেলে থেকে এখানে এসেছি — স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য । বোধ হয় ২।৩ দিনের মধ্যে আবার ম্যাণ্ডেলে ফিরে যাব।

আমি প্রায়ই চিঠি লিখবার চেষ্টা করে কলম নিয়ে বসি—কিন্তু কলম চলে না; তাই অগত্যা কিছু দূর লিখে লেখা বন্ধ করি। আমাকে চিঠি লিখে আমার কারাক্লেশ দুর্ব্বিসহ করবার কোনও আশঙ্কা নাই। এখানে আমার কষ্ট নাই—এ কথা বললে সত্য বলা হবে না। কিন্তু কষ্ট যা আছে—পত্র না লিখলে তা কি কমবে?—এবং পত্র লিখলে তা কি বাড়বে? পত্র পড়ে যে কষ্ট হয়না—তা নয়। কিন্তু শুধু কি কষ্টই পাই? আর এই সব সুখ-দুঃখময় স্মৃতি, যার মধ্যে ব্যথার অংশ এখন বেশী হয়ে পড়েছে— তা ছেড়ে আমি বাঁচব কি করে? সন্ন্যাসের মার্গ যখন নিই নাই—তখন বাহিরের স্মৃতি – দুঃখদায়ক হলেও—কি করে ভুলব? শত যন্ত্রণা পেলেও সে সব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।

আপনি নির্জ্জন বাস করতে চান—কিন্তু নির্জ্জন বাসেই কি শাস্তি পাবেন? কে বলতে পারে? প্রাণটা যদি আরও ছোট হইত—তা হলে হয়তো বা পেতেন? আপনার শরীরের সংবাদ ২।৩ দিন হইল আমি প্রথমে সংবাদপত্রে পাই—তখন ইচ্ছা হল একবার টেলিগ্রাম করে খবর লই । তারপর ভাবলাম যে ২।১ দিনের মধ্যে যখন এখান থেকে চলে যাচ্ছি তখন ম্যাণ্ডেলে ফিরে খবর পাবার চেষ্টা করব। তারপর আপনার চিঠি আমার হাতে এল।

বন্দী অবস্থায় আর কতদিন থাকতে হবে তা শুধু ভগবান জানেন। তবে যতদিন থাকতে হউক না কেন—আমাকে যে সহ্য করবার ক্ষমতা দিয়েছেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট। এক এক সময়ে শুধু এক এক সময়ে কেন, প্রায়ই মনে হয় আমি এখন বাহিরে যাবার জন্য কায়মনে প্রস্তুত নই। যে উদ্দেশ্যে ভগবান আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তা এখনও সফল হয় নাই এবং আমার কারাবাসকালীন শিক্ষা এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে। স্থিরভাবে যখনই ভেবে দেখি তখনই মনে হয় যে আমার পক্ষে এখন কারাবাসই প্রশস্ত। তবে প্রাণ সব সময়ে মানতে চায় না। শুধু আপন জন নয়, আজ বাঙ্গলাদেশ, সমগ্র ভারতবর্ষ আমার কাছে যেন অশেষ মাধুরী মাখা উজ্জ্বল স্বপ্ন। বাস্তব দূরে সরে রয়েছে—আমি এই স্বপ্নকে আকড়ে ধরে রয়েছি। এই স্বপ্নের পেছনে যে বাস্তব সত্য তার জন্য মধ্যে মধ্যে প্রাণ আকুল হয়ে উঠে । আমার মত কঠিন হৃদয় লোকের পক্ষে এই সাময়িক উদ্বেল ভাব চেপে রাখা সম্ভবপর—কিন্তু পূর্ব্বেই বলেছি যে সন্ন্যাস মানিনা – তাই দুঃখকে অস্বীকার করবার আমার অধিকার নাই । 

যে সব পুরাণ স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে আসে এবং আমার এই সুদীর্ঘ অবসর কাটাবার সম্বলস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলির মধ্যে ব্যথার অংশ যে বেশী তা মনে হয় না। তার মধ্যে সুখের ও শান্তির উপাদানই বেশী—তবে বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করলেই ব্যথার উদ্রেক হয়। সে ব্যথার মধ্যেও যে কোন সুখ নাই এ কথা আমি বলতে পারিনা।

আমার একজন বন্ধু কিছুকাল পূৰ্ব্বে আমাকে লিখেছিলেন — দেশবাসীর মিলিত অশ্রুরাশির মধ্যে নিজের অশ্রু মিশিয়ে আমরা ব্যথার গুরুভাব লাঘব করছি কিন্তু সে সান্ত্বনা ভগবান আপনাদের দেন নাই। এ কথা সত্য। নীরবে ও নির্জ্জনে অশ্রুমালা রচনা করা খুব কষ্টদায়ক; কিন্তু এ বিপদের সময়েও যে আমরা কোনও কাজে লাগলাম না, এ ভাবনা কম কষ্টদায়ক নয়।

নিজেকে কৰ্ম্ম কোলাহল হতে দূরে রাখলেই যে “নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ লইয়া কাহাকেও ব্যস্ত করা” হইবে না এ কথা মনে করবার কোনও কারণ নাই—বরং উল্টাটাই ঘটিতে পারে। আপনি লিখেছেন—জানিনা তোমাদের সাথে এ জীবনে দেখা হইবে কি না। আমি মোটেই নিরাশ নই যদিও আমি সকল ব্যথার জন্য সর্ব্বদা প্রস্তুত আছি। আমার মনে হয় যে দেশমাতৃকার কল্যাণের জন্য যদি আমাকে সারাজীবন কারাগারে যাপন করতে হয় আমি তাতে মোটেই পশ্চাৎপদ হব না।

আমি আমার জীবনটাকে একটা adventure বলেই গ্রহণ করছি—জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা ভগবানের হাতে। আমার দুঃখ শুধু এই যে এখানে থাকতে যতটা উন্নতি সাধন করা উচিত ছিল তা করতে পারি নাই ; তথাপি আমার কারাবাস ব্যর্থ হয় নাই। আপনি সত্যই বলেছেন—তোমাদের নির্য্যাতিত জীবনের প্রতিঘাত ভগবান নিজেই বহন করিতেছেন....একদিন এ দিনের শেষ আছেই। এ কথা আমরাও বিশ্বাস করি। আপনার ভাষায় “একদিন সফলতার গৌরবে জীবন গৌরবান্বিত” হইবেই। আপনার সান্ত্বনামাখা অমূল্য কথাগুলি আমাদের অন্তরের বাণী এবং সর্বাবস্থায় আমাদের পরম অবলম্বন স্বরূপ। আমার শুধু আরও একটু মনে হয়—সারাজীবন কাটাতে হলেও আমাদের জীবন ব্যর্থ হবে না—কারণ জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি তো অন্তরের বিকাশ, বাহিরের ক্রিয়াকলাপ নয়। আপনার স্নেহাশীর্ব্বাদ আমাদের সর্ব্বদা বর্মের ন্যায় রক্ষা করুক—এই প্রার্থনা করি—এবং প্রার্থনা করি যেন সৰ্ব্বদা সত্যপথে চলিয়া আপনার ঐ অমূল্য স্নেহাশীর্ব্বাদের কতকটা যোগ্য হতে পারি।

তাঁর জীবনী লিখবার আকাঙ্ক্ষা আমার মনে আঁছে—কিন্তু ভরসা হয় না। যে ২।১ বার ২।১ লাইন লিখবার চেষ্টা করেছি তাতে আরও নির্ভরসা হয়ে পড়েছি। তবু মনে হয় যে তাঁর গভীর ও বৈচিত্র্যময় চরিত্রের যতটা আভাস আমি পেয়েছি—ততটা অনেকেই পান নাই। তাই আমার অভিজ্ঞতার ভাগ যে অপরকে দিতে ইচ্ছা হয় না—তা নয়। সত্যেন বাবু বলেন যে তিনি বলতেন যে শ্রীযুক্ত গিরিজাপ্রসন্ন রায় চৌধুরী মহাশয় তাঁর ঠিক ঠিক জীবনী লিখতে পারবেন। তবে আপনি যদি কিছু উপাদান দিতে পারেন—তবে অসমর্থ হলেও আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। এই কাজের জন্য যে সময়ের অভাব হবে না—একথা আমি বলতে পারি ৷ প্রকৃত অন্তরায় সময়ের অভাব নয়, সামর্থ্যের অভাব এবং অন্তর্দৃষ্টির অভাব। আর একটা কাজ আমার মনের সামনে রয়েছে—তাঁর কারাবাসের সময়ে তিনি যে সব notes লিখেছিলেন সেগুলি থেকে একটা পূর্ব্বাপর সম্বন্ধযুক্ত প্রবন্ধ বা পুস্তিকা প্রণয়ন করা।

কয়েকদিন হ'ল মেজদাদার পত্রে আপনার স্বাস্থ্যের সংবাদ পেয়ে চিন্তিত রয়েছি। আপনার নিজের মনের অবস্থা যাহা হউক না কেন—চিকিৎসা সম্বন্ধে অপর সকলের, এবং ডাক্তারদের কথায় আপনার আপত্তি তোলা উচিত নয়। আপনার স্বাস্থ্যের জন্য আপনি গ্রাহ্য করেন না—এবং আপনার মনের কথা যে আমরা একেবারে বুঝি না—তা নয়। তবুও আমাদের সকলের—এবং সমগ্র দেশবাসীর নিকট আপনার স্বাস্থ্যের মূল্য যে কতবেশী তাহা বোধ হয় আপনি জানেন না।

প্রায় ৭ দিন হ'ল রেঙ্গুন থেকে ফিরেছি—এখন এখানেই থাকব। আমাদের সকলের ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানবেন। আমার শরীরের জন্য কোনও চিন্তার কারণ নাই—একথা রেঙ্গুনের ডাক্তার বলেছেন। এখন তবে আসি মা।

 
ইতি 
আপনাদের সেবক 
শ্রীসুভাষ

More Articles