এই বিভক্ত দেশের ধমনীর আসল ছন্দ বুঝতেন জাকির হুসেন
Zakir Hussain Death: নিজেকে আজীবন 'ছাত্র' বলতেই ভালোবাসতেন শিল্পী। বলতেন, "সঙ্গীত এক অসীম সমুদ্র, আমি তো কেবল এক নম্র নাবিক।”
একটি নিশ্চিত মৃত্যুর আগে, বহু অনিশ্চিত মৃত্যু ভিড় করে আসে। সেসব গুজব, ভুয়ো সংবাদ, সত্যের অপলাপের জমায়েত কাটিয়ে শেষতম সত্য আসে, মৃত্যুর মতোই শীতল। শীতের ছন্দ কাটে। আকাশকে আরও খানিক নিঃসঙ্গ করে একটি উজ্জ্বল তারাখসা দেখে বিশ্ব। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম সেরা কিংবদন্তী ওস্তাদ জাকির হুসেন চলে যান হঠাৎ করে। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে অল্প কিছুদিনের অসুস্থতার পরেই পৃথিবীর সমস্ত তবলাদের নিঃসঙ্গ করে চলে গেলেন জাকির। আসলে নেহাতই পণ্ডিত, ওস্তাদ, কিংবদন্তী, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপাল— এসব বিশেষণে জাকির হুসেনকে ধরা যায় না। তাঁকে ধরে রাখার মতো আকাশ পরিময়ই নয়। শান্তি এবং মানবতার লক্ষ্যে তবলা যেখানে নেহাত বাদ্যযন্ত্র হয়েই থাকে না, হয়ে ওঠে ভালোবাসার পয়গাম, সেই পথের স্রষ্টা জাকির হুসেন।
সেই স্রষ্টা চলে গেলেন। বয়স ৭৩। জাকির হুসেন রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী আন্তোনিয়া মিনেকোলা এবং তাঁদের কন্যা - আনিসা কুরেশি এবং ইসাবেলা কুরেশিকে। ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস থেকে তৈরি হওয়া নানা জটিলতার ধকল সামলাতে পারেনি দেহ। দেহ চলে গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে এক শক্তি। যে শক্তিতে বাঁধা পড়ে থাকবেন সেই সমস্ত মানুষ, যারা হতো রাগসঙ্গীতের মাহাত্ম্য বোঝেনও না। যারা হয়তো, গানের সঙ্গতে তবলা ছাড়া বিশেষ কোনওদিন শোনেনওনি এই যন্ত্র। তারা জানবেন, এই ইদানীং বিভক্ত ভারতে একজন জাকির হুসেন ছিলেন, যিনি ভারতের ধমনীর ছন্দ বুঝতেন।
আরও পড়ুন- সুখে দুঃখে ছিলেন টলিপাড়ার ‘আপনজন’, শমিত ভঞ্জকে মনে রাখেনি বাঙালি
ছয় দশকের কর্মজীবনে, হুসেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ইংরেজ গিটারিস্ট জন ম্যাকলাফলিন, বেহালাবাদক এল শঙ্কর এবং পারকাশনবাদক টিএইচ 'ভিক্কু' বিনয়ক্রমের সঙ্গে তাঁর ১৯৭৩ সালের কাজটিই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং জ্যাজকে নিয়ে এসেছিল এক পংক্তিতে। এমন অভাবনীয় ফিউশন এর আগে পৃথিবী দেখেছে হাতেগোনাই।
১৯৫১ সালের ৯ মার্চ জন্ম জাকির হুসেনের। পিতা আরেক কিংবদন্তি তবলা ওস্তাদ আল্লা রাখা। সাত বছর বয়স থেকে তবলায় হাতেখড়ি। দীর্ঘ ছয় দশকের কর্মজীবনে পণ্ডিত রবি শঙ্কর, আলি আকবর খান এবং শিবকুমার শর্মা সহ ভারতের প্রায় সমস্ত কিংবদন্তীদের সঙ্গেই কাজ করেছিলেন জাকির হুসেন। ইয়ো-ইয়ো মা, চার্লস লয়েড, বেলা ফ্লেক, এডগার মেয়ার, মিকি হার্ট এবং জর্জ হ্যারিসনের মতো পশ্চিমি সঙ্গীতজ্ঞদের সঙ্গে জাকির হুসেনের যুগান্তকারী কাজ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক শ্রোতাদের কাছে নিয়ে যায় আরও। ক্রমেই বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক দূত হয়ে ওঠেন জাকির হুসেন। এই দীর্ঘ কর্মজীবনে চারখানা গ্র্যামি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন তিনি। এই বছরের গোড়াতেই ৬৬তম পুরস্কার অনুষ্ঠানে তিনটি গ্র্যামি জেতেন তিনি। ১৯৮৮ সালে পদ্মশ্রী, ২০০২ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০২৩ সালে পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপ তো আছেই।
আরও পড়ুন- ‘গানের ওপারে’: বিশ্বসঙ্গীত এবং কিছু ট্র্যাজিক ইতিহাস
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে, জাকির হুসেন তবলার ভূমিকাকেই বদলে দিয়েছিলেন। আমজনতার কাছে গানের সঙ্গতে হারমোনিয়াম আর তবলার জুটির বিকল্প নেই। গান থাকলে তবেই তবলা। জাকির হুসেনের তবলা এক নিজস্ব চরিত্র। আঙুলের তালে যে পৃথিবী দুলে উঠতে পারে, গভীরতর আবেগকে যে উথলে দিতে পারে তবলা, প্রমাণ করেছিলেন জাকির হুসেনই। অথচ নিজেকে আজীবন 'ছাত্র' বলতেই ভালোবাসতেন শিল্পী। বলতেন, "সঙ্গীত এক অসীম সমুদ্র, আমি তো কেবল এক নম্র নাবিক।” রাগসঙ্গীত 'না-বোঝা' মানুষের দুর্বোধ্য বলে সরিয়ে রাখেনি শিল্পীকে। ওস্তাদকে দূর থেকে শুনে কত উথালপাথাল স্তব্ধ হয়ে গেছে কতজনের!
সান ফ্রান্সিসকোর আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিক-এ পড়িয়েছেন জাকির হুসেন। বিশ্বব্যাপী কর্মশালা করে নিজের কাজ, নিজের সমুদ্রসমান জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। জাকির হুসেন নেই, তবু তাঁর ছন্দ বেঁচে আছে। ছন্দের সৌন্দর্যকে, ঐতিহ্যের শক্তি এবং সঙ্গীতের সীমাহীন সম্ভাবনাকে জীবন দিয়ে উদযাপন করে গেলেন জাকির হুসেন। শিল্প কোনও সীমানা জানে না। এই ঘৃণাকাতর ভারতবর্ষে এমন দামাল ছন্দই তো বেঁধে রেখেছিল, বেঁধে রাখবেও নিবিড়ে। সেই অজস্র হিংসা, দ্বেষের মধ্যে জেগে উঠে একদিন এক আলোর শিশু হাততালি দেবেই। হয়তো সেদিন, শেষমেশ তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পুষতেও পারেন জাকির হুসেন। হয়তো, একদিন...