সিনেমার ভাঙাগড়া ও এক ছবিওয়ালার মন

Rituparno Ghosh: তাঁর অভিনয়ের ইচ্ছেই যদি প্রধান হত, তিনি চাইলেই নিজের জন্য একটি চরিত্র নির্মাণ করে নিতে পারতেন নিজের ছবিতে। তিনি তা করেননি। তাহলে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর ক্ষেত্রে এমন কী ঘটল যে অভিনয় করতে রাজি হলেন ঋতুপর...

ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ছবির সংখ্যা ২০। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, প্রায় প্রত্যেক অভিনেতাই এ-কথা এক বাক্যে স্বীকার করে নেন যে, ঋতুপর্ণ নিজে অভিনয় করে এমনভাবে পার্ট বুঝিয়ে দিতেন, যে তাঁরা সহজেই ধরে ফেলতেন চরিত্রটির অভিনয়-সুর। এখানে একটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ‘অভিনয়’ কথাটির অভ্যন্তরীণ জগৎকে অধিকার করে আছে তিনটি পৃথক দৃষ্টিকোণ। এক, অভিনেতা নিজে। দুই, পরিচালক। তিন, সেই অভিনয়ের সমজদার-সম দর্শক।

ঋতুপর্ণ ঘোষ অভিনয়ের অন্তর্গত রহস্যকে কীভাবে দেখতেন? ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ‘রোববার’ পত্রিকায় লিখছেন:

আমাদের জীবন যেমন অনিশ্চিত, আমাদের প্রতিটা দিন চলে যেমন এক অপরিকল্পিত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে, যেখানে যে কোনও মুহূর্তে আমাদের চেনা প্রতিকৃতির সবটুকু বদলে গিয়ে নিমেষে আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অন্য এক ‘আমি’, যে-আমিকে আমি কখনও দেখিনি, বা দেখলেও সেভাবে আপ্যায়ন করিনি নিজের মধ্যে; অভিনয়ের ক্ষেত্রে তো তা হওয়ার নয়।

আরও পড়ুন: ঋতুপর্ণের ‘আবহমান’: শিল্পীর মুহূর্ত, শিল্পের সত্য

সেখানে একটা কাহিনি-স্রোত আছে, যার নিশ্চয়তা বা অনিশ্চয়তা প্রায় পুরোটাই আগে থেকে জানা। যেখানে একজন চরিত্র অনুপুঙ্খ জানেন তাঁর সংলাপ, প্রতি সংলাপ, প্রবেশ-প্রস্থান— সব। ফলে, অনেক সময়ই চরিত্ররা এমন একটা বিশেষ জানার জায়গা থেকে অভিনয় করেন, যাতে প্রায় তাঁদের মনে হয়— দৈবজ্ঞ। তাঁর নিজের সংলাপখণ্ড, তার প্রত্যুত্তরে কী বলতে পারেন সহ-অভিনেতা সবই তাঁর জানা— পুরোটাই বলে দিয়েছে চিত্রনাট্য। নানা রিহার্সাল শিখিয়ে দিয়েছে তাঁকে নিশ্চিত করে। এখানে অনিশ্চয়তা মানে একটু থমকে-থমকে বলা হয়তো, বা সংলাপের গতিটাকে সামান্য আলগা করে নেওয়া।

কিন্তু সেই ‘থমকে-থমকে বলা’ তো সঠিক-অর্থে অজানার গহ্বর থেকে উঠে আসা কথা নয়। আমরা দেখতে পাই, এক অজানা কথা বলছে আরেক অজানার সঙ্গে। কিন্তু পরিচিত ও অভ্যস্থ অভিনয় আমাদের ক্লান্তিময় সেই দৈবজ্ঞ সংলাপের দরজাতেই দাঁড়াতে বাধ্য করে। ঋতুপর্ণ লিখছেন:

কিন্তু যতটাই প্রাঞ্জল করে দিক না চিত্রনাট্য-বর্ণনা, কিংবা পরিচালকের নির্দেশ— অভিনেতা যে কী সংলাপ বলবেন বা কীভাবে শুনবেন প্রতি অভিনেতার প্রত্যুত্তর, সে-ও তো এই দু-ঘণ্টার কালখণ্ডের মধ্যেই ঘটা অনিশ্চিত জীবনেরই গল্প। ছবি শেষের দিকে যত এগোবে, তত ধীরে ধীরে কাটবে অনিশ্চিতি, কিংবা সারা ছবি জুড়ে রয়েই যাবে কোনও অলীক কুয়াশার আস্তরণের মতো।

তাহলে উপায়? এ-কথা সত্য, যে, অভিনেতা জানেন তিনি তাঁর সামনের চরিত্রটির প্রত্যুত্তরে এক্ষুনি ঠিক কী বলতে চলেছেন। এমনকী, তাঁর কথার উত্তরে কী সংলাপ অপেক্ষা করে আছে, তা-ও তাঁর ভালোভাবেই জানা। এমত অবস্থায় কীভাবে সেই অভিনেতা নিজের অভিনয়ের মধ্যে ফুটিয়ে তুলবেন অজানার স্বর? ঋতুপর্ণ ঘোষের বক্তব্য:

সেখানে প্রতিটি অভিনেতার প্রতিটি বাক্য বা সহ-অভিনেতার প্রতি-বাক্য, পুরোটাই নিজেদের মধ্যে বহু চর্চিত হয়েও পর্দার জন্য তো সেই প্রথমবারের মতোই অনিশ্চিত। সেই মুহূর্তে অভিনেতাকে বোধহয় ক্ষণেকের জন্য ভুলে যেতে হবে, চিত্রনাট্য অর্জিত ভবিষ্যৎদ্রষ্টার জ্ঞান, বা পরিচালক নির্দেশিত প্রতিটি অভিব্যক্তির অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম-শক্তি। মনে যদিও-বা রাখতে হয়, তাকে এমনভাবে মিশিয়ে দিতে হবে অনাঘ্রাত অনিশ্চয়তার সঙ্গে, যেন পর্দায় মনে হয়, অভিনেতা জীবনে প্রথম এই সংলাপটি বললেন, বা শুনলেন।

এবার আমরা ফিরে তাকাব এই লেখাটির রচনা-সময়ের দিকে। ২০১০ সাল, অর্থাৎ ততদিনে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-র শুটিং শেষ হয়ে গেছে। এবং এর মানে এই যে, নিজের ভেতরে ততক্ষণে নিজের অভিনয়-অভিজ্ঞতার রূপটি কেমন, ঋতুপর্ণ তা দেখতে পেয়ে গেছেন। এ-লেখার সূচনায় বলেছিলাম, অভিনয় শব্দটিকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা। সেখানে, প্রথম দু'টি দৃষ্টিভূমি ছিল পরিচালকের এবং অভিনেতার। ঋতুপর্ণ ঘোষ, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর আগে পর্যন্ত কেবল পরিচালকের দৃষ্টি থেকেই অভিনয়কে দেখতেন। এই প্রথম, প্রত্যক্ষ অভিনয়-অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনের ভেতর প্রবশ করল। সেই অভিজ্ঞতা কেমন? ঋতুপর্ণ লিখছেন:

নিজে পরিচালক বলে অনেক সময় বোঝা যায় না। যেমন বিধাতাপুরুষ, যিনি নির্মাণ করে রাখেন আমাদের জীবনের সমস্ত গতিপথ, তিনিও হয়তো মাঝে মাঝে বিস্মৃত হন যে, কেন তাঁর নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করতে গিয়েও আমাদের এত সংকুচিত অনিশ্চয়তা বোধ? পরিচালক হিসেবে আমারও মনে হত— কেন? এই তো বলে দিলাম, দেখিয়ে দিলাম। তারপরেও কেন? অভিনয় করতে গিয়ে এতদিন পর তার উত্তরটা পেলাম। আসলে, নিজেকে যে শিল্পের সফল অংশীদার মনে করতে শিখেছি এতদিন, তার কতখানি যে আমার অজানা— তাকে আবিষ্কার করার মধ্যেও এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে।

এই সূত্রে আমি যোগ করতে চাইব প্রাসঙ্গিক এক সাক্ষাৎকারের অংশ, যেখানে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর শুটিং ফ্লোরে অভিনয় চলাকালীন নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছেন ঋতুপর্ণ:

এতদিন কী হয়েছে, আই হ্যাভ অ্যাক্টেড থ্রু মাই অ্যাক্টরস। ফলে কী হয়েছে, আমি যে-অভিনয়টা চেয়েছি অভিনেতাদের কাছ থেকে, যখন আমি বুঝতে পেরেছি এঁরা ঠিক সেই অভিনয়টা হয়তো আমাকে দিতে পারছেন না, তখন তাঁদের মতো করে অভিনয়টা বদলে দিয়েছি। তাঁরা যেটা পারবেন সহজেই সেরম করে দিয়েছি। আমার কাছে এই চ্যালেঞ্জটাই ছিল যেগুলো আমি আমার অভিনেতাদের দিয়ে করাতে পারিনি সেগুলো কি আমি নিজে করতে পারব? এটা আমার নিজের বোঝারও দরকার ছিল। অনেকগুলো জিনিস তো আমি করেছি এবং বিরক্ত হয়েছি। আমার একটা মনে আছে, ছবিতে যেখানে ওই জার্নালিস্টের সঙ্গে ঝগড়াটা হয়। এবং সেখানে আমার ক্লোজআপ। (হাত দিয়ে নিজের মাথা থেকে কাঁধ অব্দি দেখিয়ে) অত টাইট ক্লোজ তো, আমি কথা বলছি। (নিজের খুবই কাছাকাছি দূরত্ব বোঝানোর হাতটা নিজের মুখের সামনে তুলে দেখাচ্ছেন) এইখানে ক্যামেরা। আর, আমাদের যে এডিটর মৈনাক, ও মাইকটা ধরে আছে। মাইকটা ফ্রেমের মধ্যে রয়েছে। যাতে আমি ইন্টারভিউটা দিচ্ছি। আর, রাইমাকে আমি বলেছিলাম: ‘তোকে আমি একদম অ্যাক্টিং বলে দেব না। তুই এখানে বসে-বসে দেখবি, আমি যখন অ্যাক্টিং করছি।’ ও একটা মোড়া নিয়ে (আবারও হাত দিয়ে দেখাচ্ছেন, ঠিক পাশেই যেন) এইখানে বসে আছে। তার মধ্যে সৌমিক তারস্বরে চিৎকার করছে: ‘ডানদিকে, ডানদিকে, আঃ মাইকটা সরে যাচ্ছে, সর…।’ আর, আমি অকাতরে পার্ট বলে যাচ্ছি। একটা পয়েন্টে আমার মনে হল আমি কাট বলব কি বলব না। আমি রাইমার হাঁটুটা দেখলাম। আমার চোখে পড়ল। এবং আমার মনে হল, আমি কতবার এই মেয়েটাকে শট-এর মধ্যে ডিরেকশন দিয়েছি, ও কিন্তু কোনোদিন না বলেনি। কোনোদিন কমপ্লেন করেনি। করে গেছে। আমার কোনো অধিকার নেই কাট বলবার। আই হ্যাভ টু কন্টিনিউ।

এর বাইরেও, বাইরের দিক থেকে, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এ অভিনয়ের জন্য ঋতুপর্ণ কতগুলি নতুন জিনিস করবার চেষ্টা করেছিলেন। যেমন, গৌতম ভট্টাচার্যকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন:

আমি যখন ছবির শুটিং করতে গেলাম প্রথম, কৌশিক বলল: ‘হয়ে গেছে ঋতুদা, ওকে।’ আমি দেখেছি আমার এতগুলো ছবি-জুড়ে সব অভিনেতারা তক্ষুনি ছুটে শট-টা দ্যাখেন। আমি দেখতাম না। আমি বসে থাকতাম। কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়) বলত: ‘তুমি দেখবে না?’ আমি বলতাম: ‘না। তুই তো ওকে বলে দিয়েছিস।’
এবং প্রথম আমি শিখলাম যে একটা কস্টিউম, সেটা কিন্তু কন্টিনিউটি। এটা আমি পার্টিতে আসিনি বা পরে বেড়াতে আসিনি। আমি একটা অয়েলক্লথ-এর এপ্রোন তৈরি করেছিলাম। খেতে গেলে ওটা পরে নিতাম। আমি অনেকগুলো ইন্সটেনসেস করতে চেয়েছিলাম যেটা আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কখনো সচেতনভাবে ফলো করেননি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এ অভিনয় করছেন ততদিনে তিনি পরিচালক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর অভিনয়ের ইচ্ছেই যদি প্রধান হত, তিনি চাইলেই নিজের জন্য একটি চরিত্র নির্মাণ করে নিতে পারতেন নিজের ছবিতে। তিনি তা করেননি। তাহলে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর ক্ষেত্রে এমন কী ঘটল যে অভিনয় করতে রাজি হলেন ঋতুপর্ণ? ২০১০ সালের ১৯ ডিসেম্বর, ‘রোববার’-এর আরেকটি লেখায় ঋতুপর্ণ লিখছেন:

অনেক ভেবেছিলাম যে, কেন রাজি হলাম হঠাৎই? চ্যালেঞ্জিং? দু'টো চরিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে? না কি, নারীসুলভ দুই পুরুষের চরিত্র আমি অনায়াসে অভিনয় দিয়ে করে দেব এই ভাবনা থেকে? না, বহুদিনের কোনও সুপ্ত অভিনয়ের আত্মপ্রকাশের প্রলোভনে? পরে ভেবে দেখেছি, কোনওটাই না।
তেমন হলে, নিজেকে অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজের ছবিতেই একটা চরিত্র-রচনা মোটেই কঠিন ছিল না আমার জন্য। দৃপ্ত পৌরুষের থেকে নারীসুলভ কমনীয়তা আমার সত্যিকারের জীবনে সহজে আসে বলে কখনও পৌরুষকে অভিনয় দিয়ে প্রকাশ করতে পারব না— এটাও কথা নয়। ‘অন্তরমহল’-এর জ্যাকি শ্রফের অভিনয়টা প্রায় পুরোটাই আমার দেখিয়ে দেওয়া— এমনকী শেষ দৃশ্যের দরজা ভেঙে গুলি করতে গিয়ে থমকে যাওয়াটাও।

তাহলে আসল কারণটা কী? ঋতুপর্ণ জানাচ্ছেন:

আসল কারণটা বোধহয়, যে প্রান্তিক চরিত্র দু'টি আমি করতে চলেছি, সেটা আমার নিজের হাতে নিজের জন্য তৈরি না-হয়ে অন্য কোনও পরিচালকের আমন্ত্রণে এল, এটার একটা শৈল্পিক এবং মানবিক মর্যাদা আছে— সেই মুহূর্তে সেটাই আমাকে আপ্লুত করেছিল।

আরও পড়ুন: ভিন্ন যৌনতার সহজাত একত্রবাস: ঋতুপর্ণের ‘বাড়িওয়ালি’

‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’— এই তিনটি ছবিতেই অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণ এবং এই তিনটি ছবিরই কেন্দ্রীয় চরিত্রটির অবস্থান, প্রান্তিক। প্রকৃতপক্ষে, এই তিনটি ছবির মধ্যে সমকামের বিষয়-ঐক্য ছাড়াও, ভিন্ন যৌনতার প্রতি কতগুলি আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় যা কেবল চরিত্রের সংলাপে বদ্ধ হয়ে থাকেনি, ঋতুপর্ণ তাকে নিজের অভিনয়ের মাধ্যমে উন্মোচিত করেছেন। সেই অভিনয়ের মধ্যে কি কোথাও কোথাও মিশে গিয়েছে তাঁর পরিচালক সত্তাও? আমাদের উত্তর হবে, হ্যাঁ।

‘নির্জন সিনে-মন’ পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনয়চিন্তাকে সামনে রেখে তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি ও তাদের সংকেতের স্তরগুলিকে আমরা বোঝার চেষ্টা করব। জানি, সবটা হয়তো ধরতে পারব না কোনওদিনই। তবু চেষ্টার মনটুকু জারি থাকবেই!

More Articles