অরাজনৈতিক মরুভূমিতে বিদ্রোহের মরুদ্যান! কানাইলাল দত্তকে কেন ভুলবে না বাঙালি?

Kanailal Dutta: কানাইলাল বন্দুক চালানো আর বক্সিং শিখেছিলেন ডুপ্লে কলেজের অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়ের থেকে। লাঠিখেলার প্র্যাকটিস চালু করেছিলেন কানাইলাল যা পরের দিকে গুপ্তসমিতির মার্শাল টেকনিক হয়ে উঠেছিল।

বিংশ শতাব্দীর নতুন হাওয়ায় কলকাতা তখন রবিঠাকুরের ‘চোখের বালি’ এনজয় করছে। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে নীলদর্পণ— জায়গা নিতে শুরু করেছে প্রায় ভুলে যাওয়া ইতিহাসের পাতায়। মেকলে সাহেবের ‘এক উপনিবেশ, এক ভাষা, এক সিলেবাস’ মুড়ি-মুড়কির মতো তৈরি করে ফেলেছে ওপরে ওয়েস্টকোট, নীচে ধুতি আর ট্রাউজার নিয়ে দোটানায় থাকা কালো চামড়ার 'সাহেব'-দের। বিলুপ্তপ্রায় বনেদি বাবুদের জায়গা দখল নিচ্ছে মডার্ন 'বাঙালি বাবু'। তরুণ প্রজন্মকে রাজপথের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই ইংরেজরা যে ফুটবল চালু করেছিল সেই টোটকা কাজ করেছে মোহনবাগান-আরিয়ান-টাউন ক্লাবের মধ্যে ময়দানের রেষারেষি আর ক্লাব পলিটিক্স কলোসিয়ামের ঘেরাটোপে। নতুন শতাব্দীর এই ‘ক্যালকেশিয়ান’ হাওয়ার কিছুটা পৌঁছে গেছে প্রায় তিরিশ মাইল দূরের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে। ফরাসডাঙার টাইম-ক্যাপসুল হিসেবে মোতিলাল রায় লিখেছেন

“সৌভাগ্যবশে, ঊর্দ্ধমুখী আকর্ষণের অভূতপূর্ব স্পর্শ আমাদের জীবনেও অনুভূত হইয়াছিল, কি একটা নতুনের সুরে জীবন যেন দিন দিন উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল, সকল কাজই সুন্দর ও শুদ্ধভাবে নিষ্পন্ন করিবার প্রবৃত্তি স্বভাবতই আমাদের যেন পাগল করিয়া তুলিত, পাড়ায় পাড়ায় হরিসঙ্কীর্তন, অসহায় প্রতিবেশীর সাহায্য, অতিথি সেবা, মৃতদেহ সৎকার প্রভৃতি সৎকর্মে উৎসাহের অবধি থাকিত না।”

চন্দননগরে তখন নিজস্ব 'বাবু কালচার' তৈরি হয়েছে। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিগান আর চিন্তামণির পাঁচালিগান সময়ের সঙ্গে মোনোলগ-ডায়লগ সমেত বিবর্তন নিয়েছে যাত্রাপালায়। শহরের বসতি এলাকায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন যাত্রার দল— পকেটে একটু পয়সা থাকলেই দেখতে যাওয়া যেত। এদের দেখাদেখি তরুণ প্রজন্ম তৈরি করছে অবৈতনিক নাট্য-সমিতি। ১৯০৩ সালে কানাইলাল দত্ত এমনই এক ‘সখের পায়রা’ নাট্য-সমিতির সদস্য ছিলেন। আজকের ভাষায় 'ইন্ট্রোভার্ট' স্বভাবের কানাইলাল দু-একটা ছোটখাটো রোল পেতেন আর বাকি সময়টা যাত্রার রিহার্সাল দেখেই কাটিয়ে দিতেন। কয়েক মাসের মধ্যেই মোতিলাল-কানাইলালদের এই নাট্যসমিতি ভেঙে গেল কারণ সদস্যরা রামকৃষ্ণ মিশনের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে 'দরিদ্রনারায়ণ সেবা'-র নতুন ট্রেন্ডে গা ভাসালো। কানাইলাল ততদিনে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে ‘এফ.এ’ পড়তে শুরু করেছেন। তাই পুরনো সঙ্গীদের ধর্মকর্মে মতি হয়েছে দেখেই হোক বা নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার জন্যই হোক, এই সময় কিছুদিন তাঁর দলের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। অবশ্য মোতিলাল রায়ের লেখা অনুযায়ী,

“বলিয়া রাখা ভাল, ধর্ম জিনিষটার ওপর কানাইলালের তদ্রুপ আস্থা ছিল না, সে তাহার নিজের সত্য ও চরিত্রবলের উপর ভর দিয়াই চলিত।”

আরও পড়ুন- চিতাভস্ম কিনতে শোরগোল পড়ে কলকাতায়! কানাইলালের ফাঁসি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছিল ইংরেজদের

এরপর এল ঐতিহাসিক ১৯০৫ সালের ৭ অগাস্ট। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ওয়ার্মআপ নেওয়ার কথা কানাঘুঁষো ছড়িয়ে পড়তেই কলকাতার টাউন হল থেকে বেরিয়ে পড়ল বিদ্রোহের শোভাযাত্রা। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ে একঝাঁক যুবক বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বিদেশি পণ্য বয়কটের স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে দিল— ইংরেজদের “হয় হাতে মারব, নয় ভাতে মারব!” কলকাতা থেকে হোমটাউন চন্দননগরে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের মিছিল ডাকলেন মোতিলাল রায়। চন্দননগরের বুকে এতদিনের অরাজনৈতিক মরুভূমিতে একটা বিদ্রোহের মরুদ্যান খুঁজে পাওয়া গেল। স্লোগান শুনে রাস্তার দু'ধারে ঘরবাড়ির জানালা খুলে গেল, কেউ কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে মিছিলে যোগ দিল। আর সেদিন,‌ বলতে গেলে বহুদিন পর, মিছিলের সামনে হাজির কানাইলাল দত্ত। এতদিনে কানাইলালের পুরনো সঙ্গীদের নাট্য-সমিতি ভেঙে বানানো 'সৎপথাবলম্বী সম্প্রদায়'-এর খোলনলচে পাল্টে গেছে। দরিদ্রনারায়ণ সেবার হুজুগ বিপ্লবের সুনামিতে ভেসে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় হরিসংকীর্তন ছেড়ে স্বদেশি গণসঙ্গীতের সুর চড়ছে। কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের স্বদেশি বাণী, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর আগুনঝরা বক্তৃতা বোড়াই চণ্ডীতলায় সৎ-সম্প্রদায়ের সভা তোলপাড় করে দিল। শুধু কিছু সুশীল সদস্যরা রাজনীতির গন্ধে চিরকালের মতো শুকিয়ে গেল। সমাজসেবা করে কিছু সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, শাসকের বুটের আঘাত রোখা যায় না। তাই শাসকের অত্যাচার নেমে এলে পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দেওয়াই একমাত্র রাস্তা।

সরিষাপাড়ায় আজকের যে ছোট পেট্রোল পাম্প, তার পেছনে তখন একটা বাঈজিবাড়ি ছিল। প্রত্যেক রাতে নিয়ম করে সেখানে জুটমিলের তিনজন শ্বেতাঙ্গ সাহেব আসত। তাদের বেলেল্লাপনা আর চেঁচামেচির জ্বালায় পাড়ার লোক ঘুমোতে পারত না। শুধু কেউ সাহস করে কিছু বলত না ওরা ‘সাহেব’ বলে। এক রাতে কানাইলাল সেখানে হাজির হলেন। বারণ করা সত্ত্বেও সাহেবরা সেই 'রোগা-প্যাংলা' ছেলেটির কথায় কান না দিয়ে উল্লাস চালিয়ে গেল। কানাইলালও নাছোড়বান্দা! হাত পেঁচিয়ে সপাটে ঘুষি চালালেন এক সাহেবের নাকের হাড়ে। বোসাঁ-র বোতল হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল, বাঈজিনাচের আসর থেমে গেল, মদ্যপ সাহেবরা বেগতিক দেখে পালিয়ে প্রাণে বাঁচল আর সেই রাত থেকে সরিষাপাড়ার ওই বাঈজিঘরে সাহেবদের আনাগোনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কানাইলাল বন্দুক চালানো আর বক্সিং শিখেছিলেন ডুপ্লে কলেজের অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়ের থেকে। সরিষাপাড়ায় নিজের মামাবাড়ির উঠোনে লাঠিখেলার প্র্যাকটিস চালু করেছিলেন কানাইলাল যা পরের দিকে গুপ্তসমিতির মার্শাল টেকনিক হয়ে উঠেছিল। শিক্ষার প্রয়োগ, শাসকের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ নেওয়ার ম্যানিফেস্টো শুরু করলেন কানাইলাল দত্ত— যা আগামী দিনে নরেন-বধের ইতিহাসকে লিখে দিল অগ্নিযুগের 'প্রথম রাজনৈতিক হত্যা' হিসেবে।

More Articles