অটোতেই রয়েছে ম্যাগাজিন থেকে ম্যাকবুক, গোটা বিশ্ব এক ডাকে চেনে ভারতের এই অটোওয়ালাকে
জের পছন্দ আর পেশাকে সহাবস্থানে নিয়ে এসেছেন আন্নাদুরাই। এমনকী, নয়া টেকনোলজি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণ করেছেন এই বছরের দুবাই এক্সপোতে।
উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের একটি অটো আদারের রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে যাত্রী নিয়ে। অটোর পিছনে মোটা সাদা অক্ষরে লেখা– ‘নিজের পরিচয় তৈরি না হওয়া অবধি কাজ করে যাও।’ আন্নাদুরাইয়ের জীবনে এই কথার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কে এই আন্নাদুরাই?
চেন্নাইয়ের এক টেক-প্রিয় অটোচালক। বয়স মাত্র ৩৮। নিজের পছন্দ আর পেশাকে সহাবস্থানে নিয়ে এসেছেন আন্নাদুরাই। এমনকী, নয়া টেকনোলজি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণ করেছেন এই বছরের দুবাই এক্সপো ২০২০-তে। ইতিমধ্যেই স্থানীয় ও বিশ্বদরবারে খানিক নামডাকও তৈরি হয়েছে আন্নাদুরাইয়ের।
দ্বাদশ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি আন্নাদুরাই। ২০১০ সালে বর্তমান পেশার সাথে যুক্ত হন তিনি। এর আগে এক ক্যাফেটেরিয়ায় কাজ করতেন এই অটোচালক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বাধা এলেও নতুন জিনিস শেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ কমেনি একটুও। তাঁর ওয়াই-ফাই অটোতে রয়েছে ট্যাবলেট, একটি ল্যাপটপ, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন এবং একটি টিভি। তাঁর কথায়, “যাত্রীদের জন্য এই সবকিছুর ব্যবস্থাই রয়েছে বিনামূল্যে। আমি চাই তাঁরা পড়ুন এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন।” আন্নাদুরাই নিজেও অবসরে বই পড়তে ভালবাসেন। এই মুহূর্তে তাঁর সময় কাটছে পুলিশের তদন্তে ব্যবহৃত টেকনোলজি-সংক্রান্ত বই ‘ফরটিটু মনডেস’ (‘42 Mondays’) পড়ে।
আরও পড়ুন: ‘আসতে লেডিস’ সমঝে বলুন, স্টিয়ারিংটা তারই হাতে
দুবাই এক্সপোতে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে একটি সংবাদজমাধ্যমকে তিনি বলছেন, ‘আসলে যাত্রীদের চাহিদা ক্রমাগত বদলাতে থাকে। তাই তাঁদের চাহিদা পূরণে সহায়ক এমন প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত থাকা প্রয়োজন।’ কথা বলতে বলতেই সাদা রঙের একটি যন্ত্র বের করে দেখিয়েছেন আন্নাদুরাই। ‘এর নাম এডাবলুএস ডিপলেন্স। এই যন্ত্রের সাহায্যে আমি প্রতিবন্ধী যাত্রীদের কথা সহজেই বুঝতে পারব।’
অটোর ভেতর প্রযুক্তির সম্ভার
আন্নাদুরাই তাঁর যাত্রীদের জন্য বাজারের সবথেকে অত্যাধুনিক গেজেটগুলিই রাখার চেষ্টা করেন । এই মুহুর্তে তাঁর সংগ্রহে রয়েছে আইপ্যাড, স্যামসাং-এর ট্যাবলেট, সৌরবিদ্যুৎচালিত হেডফোন। সদ্য দুবাই থেকে কিনে এনেছেন আইফোন ১৩। আন্নাদুরাইয়ের মতে, ‘প্রতি বছরই নতুন ধরনের প্রযুক্তি বাজারে আসছে এবং আপনি যদি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারেন, তবে আপনিই পিছিয়ে গেলেন।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন, ‘গরিব বস্তিতে থাকা শিশুরা যখন গাড়িতে রাখা ম্যাকবুক প্রো ঘেঁটে দেখে, তখনই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।’
আন্নাদুরাই জানিয়েছেন, তাঁর যাত্রীদের ৫৫% আইপ্যাড প্রো ব্যবহার করেন, ১৫% মানুষ ম্যাকবুক প্রো এবং ২৫% মানুষ সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন পড়েন। সকালের জন্য ছ'টি এবং বিকেলবেলা দু’টি সংবাদপত্র থাকে তাঁর অটোতে। সঙ্গে তামিল এবং ইংরেজি মিলিয়ে ৩৫- ৪০টি ম্যাগাজিনের সাবস্ক্রিপশন নেওয়া আছে তাঁর। শুধু টেকনোলোজি নয়, ব্যবসা, জীবনযাত্রা, ভ্রমণ, ফ্যাশন– এমন সব ধরনের ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ রয়েছে অটোর যাত্রীদের। আগে বাংলা, কন্নড়, মালায়ালম, তেলুগু ভাষার সংবাদপত্রও থাকত তাঁর গাড়িতে। তবে সেগুলির খুব বেশি চাহিদা না থাকায় এখন আর রাখা হয় না। সঙ্গে থাকে প্রতি মাসে একটি করে নতুন বই। এই মাসে রয়েছে ‘ফরটিটু মনডেস’, আগের মাসে ‘রিচ ড্যাড, পুওর ড্যাড’, ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ ইত্যাদি বই ছিল। অটোর ভেতর লাল রঙের ছোট্ট একটি ফ্রিজে রয়েছে ঠান্ডা নারকেলের জল। এছাড়াও যাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে রয়েছে বিস্কুট, চকোলেটের মতো স্ন্যাকসের ব্যবস্থা।
কেন এত আয়োজন?
হঠাৎ একটি অটোর মধ্যে এত কিছুর ব্যবস্থা কেন করলেন আন্নাদুরাই? এই প্রশ্নের উত্তরও তাঁর আয়োজনের মতোই অবাক করা। আন্নাদুরাইয়ের মতে, ‘আজকাল মানুষ খুবই চাপের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করেন। আমি চাই, তাঁরা যেন যাত্রাপথের সময়টুকুতে খানিক চিন্তামুক্ত হন।’ টেকনোলজি, বই, সংবাদপত্র বাদেও গাড়িতে রয়েছে রুবিক কিউব। সাজিয়ে ফেলতে পারলেই যাত্রীর জন্য থাকে নিশ্চিত উপহার। প্রতিমাসে ক্যুইজ প্রতিযোগিতারও ব্যবস্থা করেন আন্নাদুরাই। নিজেই তৈরি করেন এই প্রতিযোগিতার প্রশ্ন। সঠিক উত্তরদাতাদের মধ্যে লটারির সাহয্যে বেছে নেওয়া হয় বিজেতাকে। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় নগদ ১০০০ টাকা।
আন্নাদুরাইয়ের কথা অনুযায়ী, সাবস্ক্রিপশন ও বাকি জিনিস বাবদ মাসে ১৮ হাজার টাকা খরচ হয় তাঁর। পাঠকরা নিশ্চয় ভাবছেন, তবে আন্নাদুরাইয়ের মাসিক আয় কত? তিনি নিজেই বলেছেন, ‘অতিমারীর আগে মাসে এক লক্ষেরও বেশি আয় ছিল। তবে করোনার জন্য এখন সেই আয় কমে হয়েছে ৬০-৬৫ হাজার টাকা।’ অতিমারীর শুরু থেকেই বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা অনেক কম, সঙ্গে রয়েছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’– এসবের জেরে আয় কমে গেছে বলেই তাঁর মত।
শুনলে অবাক হবেন, যাত্রীদের এত সুযোগসুবিধা দেওয়ার পরও কোনও অতিরিক্ত ভাড়া নেন না এই অটোচালক। সরকারের ধার্য করা ভাড়ার চেয়ে এক পয়সা বেশি নেবেন না আন্নাদুরাই।
এখন দিনে ৩০-৪০ জন যাত্রী ওঠেন তাঁর অটোতে। তবে আন্নাদুরাই বিশ্বাসী, পরিস্থিতি ভাল হলেই ব্যবসা বাড়বে। আর একবার সব ঠিকভাবে চলতে শুরু করলেই আরও অনেক নতুন নতুন পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। ব্যবসায় উপার্জনের অঙ্ক কমলেও অতিমারী পরিস্থিতিতে চিকিৎসক, নার্স, সাফাই কর্মীদের বিনামূল্যে পরিষেবা দিয়েছেন আন্নাদুরাই।
কথায় বলে, এই পৃথিবীর সবকিছুর থেকেই জীবনের পাঠ পাওয়া সম্ভব। আন্নাদুরাই তেমনই এক চরিত্র। আন্নাদুরাই অনন্য। নিজের কাজেই আজ তাঁর পরিচয় তৈরি করেছেন আন্নাদুরাই।