বনবিভাগ নয়, বিষ্ণুপুরের দাবানল রুখতে ভরসা এই মানুষটি

প্রতি বছরই পুড়ে যাচ্ছে বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাইলের পর মাইল এলাকার পশুপাখি, মানুষজন,পরিবেশ। এই পরিবেশ, বন্য জন্তু ও সর্বোপরি জঙ্গল বাঁচানোর দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে বনবিভাগের। কিন্তু এই অঞ্চলের ক্ষেত্রে বনবিভাগের ততটা তৎপরতা চোখে পড়ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই আগুন নেভানোর কোনও চেষ্টাই করছে না তারা। কাজেই বাধ্য হয়ে বিষ্ণুপুর–সংলগ্ন এলাকার জঙ্গলের এহেন বারবার পুড়ে যাওয়া ঠেকাতে ব্যবস্থা নিয়েছেন সেই অঞ্চলের স্থানীয় কিছু মানুষ। এঁদের মধ্যে সোমনাথ সিংহ মহাপাত্র, গ্রিন প্ল্যাটুর দেবার্ণব সেন এবং অঙ্কুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা উল্লেখযোগ্য কাজ করছেন।

আরও পড়ুন: কার মদতে সাফ সবুজ দ্বীপের শ’য়ে শ’য়ে গাছ? যে উত্তর উঠে এল…

এই আগুন নেভানোর কর্মসূচির ব্যাপারে ‘ইনস্ক্রিপ্ট’–এর তরফ থেকে সোমনাথ সিংহ মহাপাত্রর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে তো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ফলত বিভিন্ন এনজিও, ব্যক্তি নিজেদের উদ্যোগে যেটুকু চেষ্টা করছে, তাই সম্বল। যেমন আমাদের বাড়ির পিছনে যে জঙ্গলের অংশটুকু, সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে আগুন না লাগে। এবার সেখানে আগুনই লাগেনি তাই। উপায় তো আছেই। এখন ইউটিউব দেখলেও এই বিষয়ে নানা তথ্য শেখা যায়। এছাড়া মানুষকে জনে জনে বোঝানো, যাতে আগুন লাগলে নেভানোর জন্য তাদের পাওয়া যায়। আমাদের এলাকায় জঙ্গল পোড়েনি বটে, কিন্তু এবারও বাকি সমস্ত জঙ্গল ভেতর ভেতর পুড়ে গেছে। বিষ্ণুপুর, উত্তরে বড়জোড়া থেকে দক্ষিণে মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত।” 

কারা আগুন জ্বালাচ্ছে? এতে লাভই বা কাদের আর কাদের লোকসান– এই প্রশ্নের উত্তরে সোমনাথ জানান, “খুব পরিকল্পিতভাবে জঙ্গল কেউ জ্বালায় না এই অঞ্চলে। বাকি অঞ্চলের কথা অবশ্য বলতে পারব না। কিন্তু এই অঞ্চলে জঙ্গলে আগুন লাগার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও কারণ নেই। গতবার এক রিটায়ার্ড টিচারকে ধরেছিলাম। আগুন লাগিয়ে যে পটপট করে পোড়ার শব্দ উঠছে, তাতেই ওঁর ফূর্তি। কী বলব বলুন তো! বয়স্ক মানুষ। বাচ্চারা এগুলো খুব একটা করে না। এক–আধটা বিড়ি খেতে গিয়ে জ্বালিয়ে ফেলল, সে অন্য কথা। কিন্তু এমনিতে নিজেদের মধ্যেই ছাত্ররা আলোচনা করে দেখি, আগুন জ্বালাস না, জ্বালালে কত পশু, কত পাখি মরে যাবে– বাচ্চারা অনেক সচেতন। আর দশ–পনেরোজন লোক জোগাড় করে আগুন নেভানো এমন কিছু ব্যাপার না। এ তো আর পাহাড়ি এলাকা নয়, আগুন নেভানোর জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে!। এ আগুনে গাছ তেমন পোড়ে না। পোড়ে ঝরা পাতার রাশ। সেই শুকনো পাতা সরিয়ে দিলে বা আগুন যেদিকে এগচ্ছে, সেই পথে সীমিত মাত্রায় পুড়িয়ে দিলেই আগুন থেমে যায়। কিন্তু বনকিমিটির যারা সব সদস্য হয়ে বসে আছে, তাদের কাউকেই এই কাজে ডেকে ডেকে পাওয়া যায় না। যুবকদের বরং পাওয়া যায়। বনদফতর আর কিছু না করুক, অন্তত সচেতনতা বাড়াতে পোস্টারটুকু তো করতে পারে! তাও করে না। গত বছর আমি নিজের খরচায় পোস্টার করে স্কুল-কলেজের সামনে, বাসস্ট্যান্ডে, রেশনের দোকানে মেরেছি। লোক দেখলেও সচেতন হয়। কোথাও আগুন লাগলে যুবকরাই তখন খবর নিয়ে আসত, দাদা অমুক জায়গায় এমনি আগুন লাগিয়েছে, চলো যাই, নিভিয়ে আসি। প্রচারে এইটুকু কাজ হয় খুব সাবলীলভাবেই। তবে আমাদের প্রচার আর বনবিভাগের প্রচারের মধ্যে তো পার্থক্য আছে! সাধারণ মানুষ আমার কথা অত গুরুত্ব দিয়ে শুনবে কেন? বা শুনলেও দু’দিন পর ভুলে যাবে। ইউনিফর্ম থাকলে ওরা অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। বনবিভাগের লোকজন যদি এই এক-দু’মাইল রেডিয়াসের মধ্যে যে গ্রামগুলো রয়েছে, সেই বনকমিটিগুলোর সঙ্গে কথা বলে একটু মাইকিং করে, প্রচার চালায়– তাহলে মানুষ আরও সচেতন হয়। এখানে এক আদিবাসী যুবক নানা ধরনের হাতের কাজ করত। খুব সুন্দর হাতের কাজ। ঘোড়ার মূর্তি, হাতির মূর্তি। সেটা দেখে আমি সেই মূর্তিগুলো দিয়ে একটা প্রদর্শন করলাম। ও পয়সার জন্যই বানাত। এতে ওরও একটু পরিচিতি বাড়ল, আর সেই প্রদর্শনে আমি কয়েকটা পোস্টার টাঙিয়ে প্রচার চালালাম। লোক এল, দেখল। একসঙ্গে দুই কাজই হল। এইসব উদ্যোগ সরকারি তরফে নেওয়াই যায়। কিন্তু কেউ নেয় না।”

আরও বলছেন সোমনাথ, “আর সচেতনতা বাড়লে কী হয়, আগুন লাগা যদি থামানো নাও যায়, আগুন নেভানোর অন্তত লোক পাওয়া যায়। পনেরো–কুড়ি জন লোক হলেই হয়। তাছাড়া এই সময় গাঁয়ে হরিনাম–টরিনাম হয়, প্রচুর লোক আসে শুনতে। বনবিভাগ উদ্যোগ নিলে সেখানেও এই সম্বন্ধে কিছু প্রচার চালানো যায়। গ্রামে গ্রামে গিয়ে যদি এটুকুও ওরা করে, জঙ্গল বাঁচে, মানুষ বাঁচে, পশুপাখি বাঁচে। কিন্তু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট তো কোনও কাজই করে না! ক’দিন আগে যেখানে মেলা হয়ে গেল, তার পিছনের জঙ্গল পুড়ছে এখনও। একদিন নিভিয়ে এলাম, দেখি পরের দিন আবার জ্বালিয়েছে। এভাবে পারা যায়! এদিকে বনবিভাগে ফোন করলেই বলছে, স্টাফ নেই। একথা পর্যন্ত বলেছি, আপনাদের এখানে আসতে হবে না। অন্তত গাঁয়ে বনকমিটির যে সভাপতি আছে, তাকে বলুন যে আপনার গাঁয়ের পাশে জঙ্গলে আগুন লেগেছে, নেভানোর ব্যবস্থা করুন। তারাই তখন ব্যবস্থা করবে। যদি নেভাতে নাও পারে, অন্তত সেই জঙ্গল পোড়ার তাপ কেমন লাগে– তা তো বুঝতে পারবে। এরপরে জঙ্গলে আগুন লাগানোর আগে দু’বার ভাববে।”

খেদ ঝরে পড়ছিল সোমনাথের গলায়, “আর এই আগুনে যে কত লোকের কত ক্ষতি হয়! গত বছর আমাদেরই দু’বিঘে সর্ষে পুড়ে গিয়েছিল। গাঁয়ের লোক পালা (কুটো) জোগাড় করে রাখে। সেই পালা স্কুলের মিড ডে মিল রান্না থেকে গরুর ঘাটা তৈরি— সবেতেই ব্যবহার করা হয়। জঙ্গল পুড়ে গেলে পালা কোথায় পাবে? দূর দূর থেকে সব পালা কুড়িয়ে নিয়ে যায়। এখন শালের জঙ্গল তো তেমন নাই, সব ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি লাগিয়ে দিচ্ছে। খুব ফালতু গাছ। তবু লাগাচ্ছে। সেই পালা–ও লোকে কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শাল পালার তো চাহিদা প্রচুর। আগে জঙ্গলে প্রচুর ছাতু পাওয়া যেত, লোকালেই চারশো টাকা কেজি, সেগুলো কুড়িয়ে লোকে বেচত। সেই ছাতুও লুপ্তপ্রায় আগুনের জন্য। মিক্স ফরেস্ট করার কিছু সমস্যা আছে। আইনের ফাঁক দিয়ে গাছ সমস্ত কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে গাছ কেউ লাগায় না। আগুনের ফলে চারা সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামে কত ফাঁকা জায়গা। তিরিশ ঘর লোক। পাশের গ্রামে চল্লিশ ঘর। চারপাশে প্রচুর ফাঁকা জায়গা। ওগুলোতে কিছু না হোক, যদি ফলের গাছও লাগানো হয়, মানুষ-পশুপাখি সবাই খেতে পারবে। একশো দিনের কাজে এইসব কাজও তো করাতে পারে!” 

তবে সোমনাথ প্রত্যয়ী হয়ে নিশ্চিত করছেন, জঙ্গল দখল করার জন্য আগুন লাগানো হয়নি। ‘আবারও বলছি, এই আগুন খুব সম্ভব পরিকল্পিত নয়। কারণ, জঙ্গলের জমি দখল করে যারা নিজের জমি বাড়ায়, তারা খুব ধীরে জঙ্গল মারে। কখনও অল্প আগুনে, আবার কখনও গোড়ায় বিষ দিয়ে, শিকড় কেটে দিয়ে। একবারে এতবড় কাণ্ড তারা করবে না। কারণ করলে ধরা পড়ে যাবে। জঙ্গল পুড়ে যাওয়ার পরে কিন্তু গাছ কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে, যে গুঁড়িটা থাকে, সেই গুঁড়িটা পর্যন্ত শিকড়সমেত কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন জঙ্গল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আকাশমণি, ইউক্যালিপটাসের জন্য জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। সেই শুকনো জমিতে একবার শাল জঙ্গল কেটে শেষ করে ফেললে ও আর হবে না। সেসব নিয়ে সচেতনতা নেই, সরকারের বাড়ানোর দায়ও নেই। অন্তত গাছ কাটার ফলে শাস্তিটা ঠিকঠাক হলেও লোকে ভয় পায়। কিন্তু বড় নেতা ধরা আছে। কারওই কোনও শাস্তি হয় না। আর গ্রামের লোকেদের কী, এক কাপ চা খাওয়ালেও তারা খুশি মনে গাছ লাগিয়ে দেবে, ক্যামেরায় ছবি তোলার আনন্দেও এমনি গাছ লাগিয়ে দেবে, বনবিভাগ যদি একশো দিনের কাজে এই নানা ধরনের গাছ, ফলের গাছ লাগায়, সচেতনতা বাড়ায়, প্রচার করে— তাহলে সবার উপকার হয়। কিন্তু কোনও উদ্যোগই নেই।”

এই নিয়ে কয়েকদিন আগেই একটি সমাবেশের আয়োজন করেন তাঁরা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, জঙ্গল লাগোয়া প্রাইমারি স্কুলে সচেতনতা শিবির, ব্যানার, পোস্টার এবং মাইকিং-এর মাধ্যমে ওঁরা নিজেরাই প্রচার চালাবেন। বনবিভাগের ডিএফও, রেঞ্জারদের কাছে যাওয়া হবে, এবং যাতে একশো দিনের কাজের আওতায় ফায়ার ফাইটিং-এর কাজটিকে আনা যায়– তার চেষ্টা করা হবে। ‘অল বেঙ্গল গ্রিন ক্লাব সোসাইটি’–র সম্পাদক অভীক গুপ্ত এই দিনে সোমনাথ সিংহ মহাপাত্র, গ্রিন প্ল্যাটুর দেবার্ণব সেন এবং অঙ্কুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সংবর্ধনা জানান। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন’ প্রকল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে এই স্থানীয় ক’জন মানুষের উদ্যোগ। জঙ্গল বাঁচাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর।

More Articles