আমার বোনেরও বর্ণমালায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি! ভাষা আন্দোলনে অনুচ্চারিত মেয়েদের কথা

Women in Bhasha Andolan: ভাষার জন্য মার খাওয়া প্রতিটা মানুষের নাম জানুক সকলে, শুধু ভাইয়ের রক্তে নয়, বোনেরও বর্ণমালাতে বেঁচে থাক ২১ শে।

বাংলা ভাষাকে ছবিতে আঁকতে গেলে তা ময়লা কাপড়ের শ্রমজীবী মহিলার মতো হয়ে যায়। সামাজিক লিঙ্গ রাজনীতিটা এমন, তাতে ভাষা স্ত্রীলিঙ্গ আর রাজনীতি পুংলিঙ্গ! বর্ণমালা তো বরাবরের দুঃখিনী। তাঁর কাপড় ময়লা, ভাতের থালা তোবড়ানো। এভাবে আঁকলে ভাষার প্রতি মায়া হয়। মায়া বিক্রি করে বিপ্লবের ঘরে খুচরো সমর্থন (সলিডারিটি বলে ডাকেন অনেকে) আসে। ভাষা এমন কথা বলে বোঝে রে সকলে। ভাষার কাছে উঁচা-নীচা, ছোট-বড় সমান হওয়ার কথা। আসলে সাম্যের কথা বলে ভাষা। অন্তত ভাষা তাই বলতে চায়। কিন্তু গ্লোবাল প্যালেটে যে শোকগ্রস্ত বর্ণমালাকে আঁকা হয় তার দীন ঘরের এক কোণে আলো পড়ে। অন্যখানে দিনেও নিকষ কালো। যেটুকুতে আলো, সেটুকু নিয়েই আমাদের মাতৃভাষার উৎসব। বাকি অন্ধকার নিয়ে উচ্চবাচ্যই নেই। তাই খণ্ডসত্য নিয়ে চালাও ফোয়ারা! ভাষা স্ত্রীলিঙ্গ, ভাষা আন্দোলনের মেয়েরাও তাই। শুধু ভাইয়ের নয়, সমানভাবে বোনেরও রক্তের দাগ লেগে আছে ২১শে-র তোরণে, কেবল আমরা বিস্মৃত। 

ভাষা আন্দোলনের কথা পড়তে গিয়ে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারদের শহিদ হওয়ার কথা প্রায় সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে ভাষা আন্দোলনের প্রতিটা দিন রাত, প্রতিটা মিটিং, প্রতিটা লড়াইয়ের কৌশল কোথাও লিপিবদ্ধ নেই তেমন। থাকলেও আমাদের কাছে পৌঁছয় না। ফলত, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভাষার লড়াইয়ে মেয়েদের ভূমিকা কতখানি তীব্র ছিল তা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের কোটার বাইরেই থেকে যায়। আমরা শহিদদের কথা জেনেছি, আন্দোলনকারীদের নয়। ১৯৫২-র প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কেবল ভাষার জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া মুসলিম পরিবারের মেয়েদের কথা এখনও কোনও আলোচনা সভা, পোস্টার-ব্যানার আলো করতে পারে না।

১৯৪৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি। উর্দু এবং ইংরাজির পাশাপাশি বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি উঠেছিল করাচিতে তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদের বৈঠকে। বলা বাহুল্য, গণপরিষদে এই দাবির বিপক্ষেই মতামত যায়। বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে ঢাকা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্য বহু জায়গাতেই সর্বপ্রথম ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই। তার আগেই অবশ্য বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। ওই বছরই, ৩১ জানুয়ারি, ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় এক সভায় ছাত্রীদের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, “বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনে মেয়েরা তাঁদের রক্ত বিসর্জন দেবে।” ৭০ বছর আগে এই এগিয়ে থাকা উচ্চারণে ধক লাগে। মেয়েদের পক্ষে কখনই সহজ নয়, ছিলও না।

আরও পড়ুন-এ ভাষা বোঝে না সকলে, কেন রহস্যে মোড়া হিজড়েদের উল্টিভাষা? 

বাংলা ভাষার আইনি স্বীকৃতির লড়াইয়ের লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকার ফজলুল হক সভাগৃহে ডাকা হয় জরুরি বৈঠক। গণপরিষদের সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের মুদ্রা এবং ডাকটিকিটে বাংলা ভাষার ব্যবহার না থাকা, নৌবাহিনীর পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে এবং পূর্বপাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১১ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানেই ধর্মঘট ডাকা হয়। ধর্মঘট সফলের উদ্দেশ্যে পথে নামেন ছাত্র-ছাত্রীরা। সেদিনের ধর্মঘটে পিকেটিংয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ যাঁরা করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই মহিলা। এ গল্প সকলেরই অল্পবিস্তর জানা।

মুশকিল হল গল্পটা জানা হলেও চরিত্রগুলো অজানা। আর সে কারণেই সামনে আসে না মমতাজ বেগম, রাজিয়া আফরোজা, লিলি খান, সামসুন্নাহার, খালেদা খানম, মালেকা, লুলু বিলকিসদের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান লিখছেন,

“১১ মার্চ ভোরবেলা থেকে শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং এবং অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সকাল ৮ টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। মার খেল কয়েকজন ছাত্রীও....। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত। আর বিকেল ৪ টেয় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না’- এমন কত রকমের স্লোগান।”

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমেদ, হালিমা খাতুন, সারা তৈফুর, নাদিরা বেগম। ভাষা আন্দোলনকারী হিসেবে পুলিশের নজরে প্রথম থেকেই ছিলেন নাদিরা। পুলিশি ঘেরাও থেকে বাঁচতে আত্মগোপনও করেন। আশ্রয় দেন আরেক আন্দোলন নেত্রী সুফিয়া কামাল। সুফিয়ার বোনের মেয়ের পরিচয়ে জাহানারা নামে আত্মগোপন করে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে নাদিরাকে জেলে যেতে হয়। এবং স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য রাজবন্দীদের মতো তাঁর উপরেও অত্যাচার চলে সমান তলে। আন্দোলনের আরেক নেত্রী মমতাজ বেগমেরও জোটে কারাবাস। পাল্লা দিয়ে চলে অত্যাচারও। সর্বহারার মধ্যে যারা সর্বহারা তাঁদের কাছে প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাওয়ার হরেক রকমের ‘শাস্তি’ রয়েছে। আন্দোলনকারী স্ত্রীকে ঘরে তোলা যায় না। তাই, জেল থেকে ছাড়া পেলেও মুমতাজের স্বামী তাঁকে তালাক দেন।

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন বক্সিবাজার কলেজ, মুসলিম গার্লস স্কুল, বাংলা বাজার গার্লস স্কুল, কামারুন্নেসা গার্লস স্কুলে গিয়ে গিয়ে লাগাতার প্রচার এবং ছাত্রীদের আন্দোলনে সামিল করতে গিয়ে জেল বন্দি হন ছাত্রী ইলা বক্সী, বেনু ধর, হামিদা খাতুনও। সিলেটের ছাত্রী সালেহাকে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য তিন বছর বহিষ্কার করা হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই পরে আর কখনই পড়াশোনার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাঁর। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির সামনেই কোনও পুরুষের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি মিলত। এত সবের পরেও সামাজিক-ধর্মীয় এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের বিধিনিষেধের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকা মেয়েদের কথা তবু সেভাবে কোথাও নথিবদ্ধ নেই, নেই প্রয়োজনীয় গবেষণাও। 

আরও পড়ুন- বিশ্বের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন ঘটেছিল এই বাংলায়, জানেন কীভাবে জন্ম হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ফের ধর্মঘট, ফের পিকেটিং শুরু। সামনের সারিতে আবারও ছাত্র-ছাত্রীরাই। লাগাতার পোস্টার লেখা আর প্রচারের দায়িত্ব পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাদিরা বেগম আর শরিফা খাতুনের উপরেই। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সুবিধার নয় দেখে তদানীন্তন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল সভা এবং শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ছাত্রদের দু’ তিনটি দল বাইরে বেরিয়ে যায়। যেমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ছাত্রীদের দল বেরিয়েই পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা শুরু করে। গুলি চালায় পুলিশ, সঙ্গে কাঁদানে গ্যাস, এলোপাথাড়ি লাঠি। পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যায় রফিকের। মারা যান সালাম, বরকত জব্বারও। গ্রেফতার হন ২১ জন ছাত্রী।

তবু ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর বয়সে এসেও লড়াইয়ের ময়দানে সমানভাবে সজাগ থাকা বড় অংশের ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে চলেছে আমাদের ভাষাবিদ চেতনা। বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায় কিন্তু আন্দোলনের নেপথ্যের সকলে নন। আন্দোলন বা বিপ্লব সেই সর্বগ্রাসী তাগিদ যা সমস্ত সংবেদনশীল মানুষকেই ছুটিয়ে মারে। আন্দোলনের কোনও লিঙ্গবিচার নেই। তবু, ভাইদের রক্তের পাশে ভাষা আন্দোলনের বোনদের ছিটেফোঁটা নামোচ্চারণ পর্যন্ত বাড়ন্ত।

আব্দুল গফফার চৌধুরী লিখেছিলেন ঠিকই,

“ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি../ একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি/ তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী।”

ভাষা আন্দোলনের ক্যাচলাইন থেকে তবু ‘বীর নারী’দের কথা বাদই পড়ে যায়। আমাদের দেশে কবে কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হওয়া ছেলে জন্মাবে এই অপেক্ষায় বাঙালি কেঁদে মরে। কাঁদতে কাঁদতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখ দেখতে পায় না বহুকাল আগেই শুধু কাজ নয় চিন্তায় অনেক অনেক বড় হয়ে থাকা সুফিয়া কামাল হেঁটে যাচ্ছে। হেঁটে যাচ্ছে রওশন আরা বাচ্চু, মুমতাজ বেগম, সামসুন্নাহাররা। বর্ণমালার ঘরে আলো জ্বলছে। ঝলমলে সাম্যের আলো। 

ভাষার জন্য মার খাওয়া প্রতিটা মানুষের নাম জানুক সকলে, শুধু ভাইয়ের রক্তে নয়, বোনেরও বর্ণমালাতে বেঁচে থাক ২১ শে।

More Articles