'হ্যামলেট'-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন

P


২৩ এপ্রিল ছিল উইলিয়াম শেক্সপিয়রের মৃত্যুদিন এবং ২৬ এপ্রিল জন্মদিন। বাংলা নাট্যমঞ্চে বারবার ফিরে এসেছেন শেক্সপিয়র, বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। ২৯ মে 'স্বপ্নসন্ধানী' ও 'ক্যালকাটা ব্রডওয়ে'-র যৌথ প্রযোজনা 'হ্যামলেট' মঞ্চস্থ হচ্ছে। নির্দেশনায় কৌশিক সেন। নাটকটি অনুবাদ করেছেন চৈতি মিত্র। অভিনয়ে ঋদ্ধি সেন, রেশমি সেন,সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। জোরকদমে চলছে নাটকের মহড়া। কেন 'হ্যামলেট' এই সময়ে, কেন জরুরি এই প্রযোজনা। ইনস্ক্রিপ্ট-এর তরফ থেকে কৌশিক সেনের সঙ্গে কথোপকথনে প্রিয়ক মিত্র।


প্রায় এক দশক আগে শেক্সপিয়রের 'ম্যাকবেথ' নিয়ে আপনাদের প্রযোজনা আলোড়ন ফেলেছিল। এতদিন পর, ২০২২-এ, 'হ্যামলেট' কেন?

 

কৌশিক সেন 'হ্যামলেট' নাটকটি লেখার নেপথ্যে, তৎকালীন ইউরোপে যে মহামারী চলছিল, তার একটা ভূমিকা ছিল। শেক্সপিয়র 'হ্যামলেট' যেসময় লিখেছেন, সেসময় তীব্র প্লেগের প্রাদুর্ভাব চলছিল। চারপাশে সবকিছু বন্ধ। সেই অবস্থায় শেক্সপিয়র লিখছেন এই নাটক। তার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির একটা ইতিহাসও আছে। তাঁর পুত্র বছরখানেক আগে মারা গিয়েছিলেন। সেই পুত্রের নাম ছিল হ্যামনেট। বলা হয়, এই নাটক কোথাও তাঁর পুত্রের প্রতি একটা ট্রিবিউটও ছিল। সব মিলিয়ে 'হ্যামলেট' খুব ব্যক্তিগত। আমাদের মনে হয়েছিল, মহামারীর পর যদি নাটকে ফিরে আসতে হয়, তবে শেক্সপিয়রই হবে আমাদের অবলম্বন। এর নেপথ্য কারণ কেবলমাত্র এই নয় যে, আমরা সদ্য একটা অতিমারীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছি, বা এখনও যাচ্ছি তার মধ্য দিয়ে, আর 'হ্যামলেট'-এর সময়ও পরিস্থিতিটা তেমন ছিল। এটা তো একটা কারণ বটেই। তবে দ্বিতীয় যে কারণটা সবচেয়ে জরুরি, হ্যামলেট এমন একটা চরিত্র, তার যে সংশয়, তার যে দ্বিধা, তার যে প্রশ্ন, সেটা এই মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থাকা যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের মনের কথা।

 

কীভাবে মিলে যাচ্ছে হ্যামলেট এই সময়ের সঙ্গে?

 

কৌশিক সেন আমরা আসলে একটা জিঘাংসার ধারণার দ্বারা তাড়িত হয়ে নিয়ত ছুটে বেড়াচ্ছি। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে চাইছি প্রতিশোধ নিতে। সেই প্রতিশোধ যে সবসময়ই খুব রক্তাক্ত প্রতিশোধ হবে, তা নয়। কিন্তু একটা পাল্টা দিতে হবে, সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা সামান্য সিনেমা নিয়েও তর্ক হতে পারে, পোশাক নিয়েও হতে পারে, আবার রাজনীতি বা ধর্ম নিয়েও হতে পারে, যাইই হোক না কেন, ফিরিয়ে দিতে হবে আঘাত। খুব সুকৌশলে একটা অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় নামানো হয়েছে আমাদের। আমাদের সত্যি কোনটা দরকার বেঁচে থাকার জন্য, সেটার ভেতর না ঢুকে আমরা চালিত হচ্ছি একটা অদ্ভুত প্রতিহিংসাপরায়ণতার দ্বারা।

 

'হ্যামলেট'-এর প্রস্তুতি পর্বে ঋদ্ধি সেন ও সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য: ঋদ্ধি সেনের ফেসবুক প্রোফাইল

 

এই প্রতিহিংসাপরায়ণতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আপনাদের স্বর সুস্পষ্ট হয়েছে, 'নিজেদের মতে নিজেদের গান' হোক বা অন্যত্র। নাটক তো একটা জরুরি রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেই নিরিখে কী বার্তা দেবে 'হ্যামলেট'?

 

কৌশিক সেন হিংসার উত্তর যে হিংসা হতে পারে না, এটা কিন্তু হ্যামলেট তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে। যে কারণে ফ্রেডরিখ নিৎশে তাঁর বিখ্যাত বই 'বার্থ অফ ট্র্যাজেডি'-তে বলেছেন, হ্যামলেট সম্পর্কে যা বলা হয়, যে হ্যামলেট দ্বিধাগ্রস্ত হয় বারবার, এটা কিন্তু নয়। বরং হ্যামলেট অনেকের চেয়ে অন্য অনেক বেশি স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারে, যে এই প্রতিক্রিয়া ও পালটা প্রতিক্রিয়ার খেলায় যদি একবার আমাকে ঢুকে যেতে হয়, তাহলে তার অন্ত নেই। হ্যামলেটের পিতার প্রেতাত্মা যে ওকে বারবার ইন্ধন দেয়, প্রতিশোধ নিতে বলে, সেটা সে এড়িয়ে যেতে চায়। সে দ্বিধা করে, কারণ সে বোঝে, একবার যদি এই খেলাটায় ঢুকে পড়ি, তাহলে প্রভূত মৃত্যু হবে, প্রচুর রক্ত ঝরবে। তাও সে এড়িয়ে যেতে পারে না এই প্ররোচনা, পারে না বলেই সে ট্র্যাজিক চরিত্র। শেষ পর্যন্ত 'হ্যামলেট'-এ যে কতগুলো মৃত্যু আছে, তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এটার প্রেক্ষিত আমার মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। এই যে আত্মসংশয়, এই আত্মসংশয়ের অর্থ কি নিষ্কর্মা, নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা? তা কিন্তু নয়। এর অর্থ সবসময় নিজেকে জাগ্রত রাখা, যেটা আমরা ইদানীং ভুলে যাই। আমরা এখন প্রায় নিজেদের দিকে তাকাইই না। ধরেই নিই, যা করছি, ঠিক করছি।

 

আরও পড়ুন: ‘ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, তাই ব্যারিকেড’ || কথাবার্তায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়

 

অতিমারীর কারণে দু'বছরে অনেকটা সময় নাটক বন্ধ থেকেছে। এখন আবার মঞ্চে ফিরছে 'স্বপ্নসন্ধানী'। এই বছরটা 'স্বপ্নসন্ধানী'-র ৩০ বছরও বটে। কী প্রত্যাশা করছেন এই প্রযোজনার থেকে?

 

কৌশিক সেন এই প্রযোজনার নেপথ্যে আরেকটা বিষয় আছে, যেটা না বললে অন্যায় হবে, সেটা হল 'ক্যালকাটা ব্রডওয়ে'-র যে অবদান। এই সংস্থা ফিলানথ্রপিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। 'ক্যালকাটা ব্রডওয়ে'-র কর্ণধার বিক্রম দাশগুপ্ত আমাদের মূল নাটকটা প্রযোজনা করছেন। সেই অর্থে গ্রুপ থিয়েটারে ব্যক্তিগত প্রযোজনা খুব বেশি তো হয় না। কাজেই এই উদ্যোগ দুর্লভ। 'স্বপ্নসন্ধানী'-র সরকারি গ্রান্ট বিগত চার বছর ধরে বন্ধ। আমাদের কোনও টাকা নেই। কিন্তু কোভিডকালে থিয়েটার কর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা আমরা করেছি, এবং সফলও হয়েছি। আমরা জানি না, সেই টাকা কীভাবে জোগাড় করেছিলাম! আমরা মজা করে বলি, থিয়েটারের টাকা ভূতে জোগায়। আমরা তিন-চার বছর ধরে আরও অনেক থিয়েটার দলের সঙ্গে 'সৌভ্রাতৃত্ব' বলে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। কোভিড যখন সর্বোচ্চ স্তরে, তখন কিন্তু আমরা প্রায় দুশো জন নাট্যকর্মীকে সাহায্য করে গেছি প্রতি মাসে, প্রায় এক বছর ধরে। তারই একটা সূত্র বজায় রেখে 'ক্যালকাটা ব্রডওয়ে'-র সাহায্যে আমরা যা করছি, তা হল 'হ্যামলেট'-এর যতগুলো শো হবে, তার টিকিট বিক্রির একটা অংশের টাকা আমরা টেকনিশিয়ানদের দেব। অর্থাৎ, একটা শো থেকে একজন শব্দগ্রাহক, একজন আলোকশিল্পী, একজন মেক আপ শিল্পী, এঁরা এঁদের প্রাপ্য তো পাবেনই, পাশাপাশি একটা শো থেকে যে লভ্যাংশ উঠে আসবে, তারও একটা অংশ আমরা তাঁদের দেব। এটা ছিল 'ক্যালকাটা ব্রডওয়ে'-র একটা শর্ত, সেই শর্তকে মান্যতা দিয়ে আমরা কাজটা করছি। এমন উদ্যোগ বাংলা থিয়েটারে আগে কোনওদিন হয়েছে বলে আমি জানি না। আমার মনে হয়, যাঁরা একেবারে আমাদের কাছের লোক, আমাদের নেপথ্য কর্মীরা, তাঁদের এই স্বস্তিটুকু দেওয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ বলে আমি মনে করি।

More Articles