ইরান-ইরাক সংঘর্ষ! কী বলছে ইজরায়েলের আরবসমাজ?

Arab Israeli: ইজরায়েলের জনসংখ্যার পাঁচভাগের এক ভাগ আরব। আইন অনুযায়ী, ইহুদি নাগরিকদের মতো তাদেরও সমান অধিকার পাওয়ার কথা।

ইরানের হামলায় গত ১৪ জুন উত্তর ইজরায়েলের তামরা শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটিই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। সিমেন্টের ছাদ ভেঙে পড়ে ঘরের ভেতরেই। হামলার সময় পুরো রাস্তাই অন্ধকার ছিল। রক্তের দাগ দেখে দেখে উদ্ধার-কর্মীরা কোনো রকমে দেহগুলি খুঁজে বের করেছিলেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ৬৭ বছর বয়সি কাসেম আবু আল-হিজা-র ৪৫ বছর বয়সি মেয়ে মানার খাতিব, তাঁর দুই নাতনি একজন ২০ বছরের আর একজন ১৩ বছরের আর ওদের ৪১ বছর বয়সি মাসি মানাল খাতিব। পরিবারের সবাই যে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্যালিস্টিক মিসাইলটি সরাসরি এসে পড়েছিল সেখানেই।

উত্তর ইজরায়েলের তামরা শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই আরব গোষ্ঠীভুক্ত। চারজনের মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে আসার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, তামরা শহরে মিসাইল হামলার পর একটা গান হচ্ছে, হিব্রুতে কেউ চিৎকার করে বলছে, "গ্রামে পড়েছে, গ্রামে পড়েছে।" এরপর দেখা গেল বেশ কয়েকজন একসঙ্গে হাততালি দিয়ে গান গাইছেন। গানের লাইনটি ছিল এরকম- "তোমাদের গ্রাম পুড়ে যাক"। মাঝে মাঝেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদীরা এই গান গেয়ে থাকেন। আসলে এটি একটি 'আরব-বিরোধী' গান বলে দাবি করা হয়। ভিডিওটি ইজরায়েলে ভাইরাল হয়ে গেছে। দেশেটির ভেতরেই ভিডিওটি নিয়ে প্রবল নিন্দাও হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ মন্তব্য করেছেন, এটি "ভয়াবহ এবং লজ্জাজনক।"

আসলে ইজরায়েলি আরবদের জন্য কোনো সরকারি বাঙ্কার নেই। তামরা এবং তার পার্শ্ববর্তী আরব প্রধান এলাকাগুলিতে আরবদের জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। তামরা শহরের কাছাকাছি একটি ইহুদি প্রধান শহর কারমিয়েল। শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। সেখানে ১২৬টি সরকারি বাঙ্কার আছে। দুটি এলাকার মধ্যে যে তফাৎ তা চোখে পড়ার মতো। তামরার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বৈষম্যর কথা বলে আসছেন।

ইজরায়েলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হাইফা দেশটির তৃতীয় বড় শহর। হাইফা এবং তামরার মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটারের দূরত্ব। অন্যদিকে, লেবাননের সীমান্ত থেকে তমারার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর তথ্য অনুযায়ী, হাইফায় ইজরায়েলের একটি শক্তিশালী নৌঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া এখানে বেশ কিছু তেল শোধনাগার ও বহু রাসায়নিক কারখানা রয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসেও বলা হয়েছে, ইজরায়েলের সবচেয়ে বড় তেল শোধনাগারটি রয়েছে হাইফায়। তাই ইজরায়েলকে পাল্টা জবাব দিতে হাইফা-সহ বিভিন্ন একাধিক এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। হাইফা এবং তামরার দূরত্ব এত কম বলেই হয়তো তামরার উপরও হামলা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

থিংক ট্যাঙ্ক ইজরায়েল ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউটের লিতাল পিলার বিবিসি-কে বলেছেন, "অনেক দশক ধরেই আরব প্রধান এলাকার স্থানীয় কর্মকর্তারা বিভিন্ন খাতে কম সরকারি অনুদান পান। তার মধ্যে রয়েছে, বোমা বা রকেট হামলার মতো জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্রস্তুতির খাতও"। তাঁর কথায়, যেসব জায়গায় বাঙ্কার রয়েছে, "সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও খুব খারাপ, দীর্ঘদিন থাকার উপযুক্ত নয়"।

ইজরায়েলের জনসংখ্যার পাঁচভাগের এক ভাগ আরব। আইন অনুযায়ী, ইহুদি নাগরিকদের মতো তাদেরও সমান অধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু বারবারই অভিযোগ ওঠে, সরকারি ভাবেই তাঁরা বৈষম্যের শিকার হন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মতো ব্যবহার করা হয় তাঁদের সঙ্গে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তেল আভিভ আর হাইফায় ইরাকি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় থেকেই ইজরায়েলি সরকার নির্দেশ দিয়েছিল, প্রতিটি নতুন ঘরে যেন ঢালাই করা নিরাপদ ঘর থাকে। সমাজকর্মীরা বলছেন, আরব সমাজকে এমনিতেই নতুন বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করতে গিয়ে এত কড়া নিয়মকানুনের সম্মুখীন হতে হয় যে অনেক ক্ষেত্রেই তারা অনিয়ম করেই বাড়ি বানান, যেখানে বাঙ্কারও রাখা সম্ভব হয় না।

তামরার ৪০ শতাংশ বাড়িতে নিজস্ব বাঙ্কার রয়েছে। বাকি সিংহভাগ মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতিবেশীদের বাড়িতে। অনেক সময় আবার এরকমও হয় যে হামলার যথেষ্ট আগে সতর্কবার্তা দেওয়া হয় না। এতে আশ্রয় নেওয়ার জন্যও যথেষ্ট সময়ও পাওয়া যায় না বলে জানাচ্ছেন সমাজকর্মীরা। অন্যদিকে, জেরুজালেমে প্রতিটি বাড়িতে বাঙ্কার আছে। প্রতিটা পাড়ায় একটা করে সরকারি বাঙ্কার রয়েছে। এও বলা জরুরি যে, তেল আভিভের দক্ষিণের এলাকাগুলিতে গরীব ইহুদিরাও থাকেন, সেখানেও বাঙ্কারের অভাব একটা বড় সমস্যা।

ইজরায়েল সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আরব সমাজের ৪২.৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে। ২০২১ সালে ইজরায়েলের আগের সরকার দুই সমাজের মধ্যে বৈষম্য কমাতে আরব সমাজের জন্য একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এনেছিল। দেশটির বর্তমানের ক্ষমতাসীন দক্ষিণ-পন্থী জোট,  ইতিহাসে সবথেকে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তারা ওই পরিকল্পনায় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। সেই অর্থ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। গাজার যুদ্ধের জন্য সরকারের বাজেটে যে পরিবর্তন এসেছিল সেই সময়েও একবার বরাদ্দ কমানো হয়।

উল্লেখ্য, কাসেম আবু আল-হিজা বিবিসি-কে বলেছিলেন, "বোম তো আর ইহুদি বা আরব দেখে ফাটে না। এই যুদ্ধটা শেষ করা দরকার আমাদের, এখনই।"

More Articles