কেন ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস-কে নিশানা করেছে ইজরায়েল?
Iran Israel Conflict: ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইআরজিসি-কে একটি বিদেশি 'সন্ত্রাসী' সংগঠন হিসাবে মনোনীত করে।
গত শুক্রবার সকালে ইজরায়েল ২০০টি যুদ্ধবিমান নিয়ে নাতাঞ্জে ইরানের প্রধান পারমাণবিক কেন্দ্র সহ সেই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র পারমাণবিক ও সামরিক পরিকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, পাল্টা হামলায় সেই থেকে কোনও ছেদ পড়েনি। তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরান এবং ইজরায়েলের প্রধান মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা চলাকালীনই এই হামলা চালানো হয়েছে। জানা গিয়েছে, ইজরায়েলের প্রথম দফার হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) অন্তত চারজন সিনিয়র কমান্ডার এবং বেশ কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ইজরায়েলের দাবি, এই হামলার লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির ক্ষমতাকে একেবারে শেষ করে দেওয়া এবং ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী, আইআরজিসি-কে বিকল করে দেওয়া। কিন্তু এই আইআরজিসি আসলে কী? কেন ইজরায়েলের লক্ষ্য পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা? কাদের হত্যা করা হয়েছে এখনও অবধি?
গত শুক্রবারের হামলায় যে বরিষ্ঠ সামরিক নেতারা নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মহম্মদ বাঘেরি
খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দফতরের কমান্ডার গোলামালি রশিদ
আইআরজিসি এরোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার আমির আলি হাজিজাদেহ
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনেই সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে বাঘেরির জায়গায় আবদুলরহিম মুসাভিকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে আইআরজিসি-র প্রধান হিসেবে সালামির দায়িত্বভার নেবেন আহমদ ওয়াহিদি এবং আইআরজিসি বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে হাজিজাদেহর জায়গায় আসছেন মাজিদ মুসাভি। ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ আরও জানিয়েছে, খোমেনেইয়ের মুখ্য উপদেষ্টা আলি শামখানিও গুরুতর আহত হয়েছেন। শামখানিই আমেরিকার সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার নেতৃত্বে ছিলেন। এর পাশাপাশি ইজরায়েলের হামলায় ইরানের ছয়জন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন।

ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের মহাকাশ বিভাগের প্রধান জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ (বাঁদিকে), 'ফাতাহ' হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইআরজিসির প্রয়াত প্রধান হোসেইন সালামির পাশে।
ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি আসলে কী?
ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ইরানের সামরিক বাহিনীর একটি শাখা। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই আইআরজিসি। ইরানের মূল সেনাবাহিনীর পাশাপাশিই কাজ করে আইআরজিসি। সরাসরি আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনেইকেই জবাবদিহি করতে বাধ্য এই শাখা ইরানের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক অভিযানের পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারেও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রায় ১৯০,০০০ সক্রিয় কর্মী (এবং ৬০০,০০০ এরও বেশি সংরক্ষিত কর্মী) নিয়ে গঠিত আইআরজিসি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক কর্মসূচির তত্ত্বাবধানও করে এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এর ছায়া গোষ্ঠীগুলিকেও সমর্থন জোগায়। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইআরজিসি-কে একটি বিদেশি 'সন্ত্রাসী' সংগঠন হিসাবে মনোনীত করে।
ইজরায়েল গত শুক্রবার মূলত ইরানের রাজধানী তেহরান এবং তার আশেপাশের এলাকার সামরিক স্থাপনাগুলিকে লক্ষ্য করে হামলা করে, যার মধ্যে আছে নাতাঞ্জ শহর, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ মূল এক পারমাণবিক কাঠামোয় বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তাবরিজ শহরেও একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র এবং দু'টি সামরিক ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া তেহরানের দক্ষিণে ইসফাহান শহর, তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরাক শহর, তেহরানের পশ্চিমে কেরমানশাহ শহরে ইরাক সীমান্তের কাছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণের একটি ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রেও আঘাত হানা হয়েছে।
ইরান জানিয়েছিল, ইজরায়েলের প্রাথমিক হামলায় কমপক্ষে ৮০ জন নিহত এবং ৩২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২০ জন শিশুও রয়েছে। শনিবার থেকে চলা হামলায় কমপক্ষে ৪৮০ জন আহত হয়েছেন।
কেন নাতাঞ্জ বেছে নিল ইজরায়েল?
ইজরায়েলের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্র - ইরানের বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা ইসফাহান প্রদেশে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) অনুসারে, এখানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়েছিল, সবটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। সাবস্টেশন, প্রধান বিদ্যুৎ ভবন, জরুরি সরবরাহ এবং ব্যাকআপ জেনারেটরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎপরিকাঠামোও ধ্বংস হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ ক্যাসকেড হলে সরাসরি কোনও আঘাত লাগেনি, তবে বিদ্যুতের ক্ষয়ক্ষতির কারণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য ব্যবহৃত সেন্ট্রিফিউজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে বাইরের বিকিরণের মাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে, যদিও ভিতরে রেডিওলজিক্যাল এবং রাসায়নিক দূষণ হয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনেই
ইরানের তেল ও গ্যাসের উপর ইজরায়েলি হামলা
শনিবার, ইরানের সাউথ পার্সের বৃহত্তম কেন্দ্রে গ্যাস উৎপাদনও আংশিকভাবে স্থগিত করেছে। ইজরায়েলি হামলার ফলে এখানে আগুন লেগে যায়। আগুন নেভানো গেলেও চারটি ইউনিটের একটিতে তা ছড়িয়ে পড়ার ফলে ১ কোটি ২০ লক্ষ ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বুশেহর প্রদেশে অবস্থিত, সাউথ পার্স ইরানের গ্যাস উৎপাদনের মূল কেন্দ্র। শুধু এই কেন্দ্রে নয়, সাউথ পার্স থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফজর জাম গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রেও ইজরায়েল হামলা চালিয়েছে।
ইরানও ইজরায়েলের হামলার জবাবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ইজরায়েলের সূত্র বলছে, ইজরায়েলে ইরানের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০, আহতের সংখ্যা ২০০ জনেরও বেশি। জেরুজালেম এবং তেল আবিবে অজস্র ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে। ইরান গত তিন দশক ধরে বিভিন্ন ধরনের ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। ইজরায়েল সেসব ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র অনেকাংশে প্রতিহত করলেও সব পারেনি। ফলে দেশজুড়ে বড় ক্ষতি ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খোমেনেই বলেছেন, ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক কমান্ডার এবং বিজ্ঞানীদের হত্যার জন্য ইজরায়েলকে 'কঠোর শাস্তি' তাঁরা দেবেনই। কয়েক দশক ধরেই ইরান ও ইজরায়েলের শত্রুতা চলছে। নানা টুকরো সংঘাতের পর, এই প্রথম ইজরায়েল এবং ইরান এত তীব্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।