ভারতীয় মুসলিমকে 'পাকিস্তানি' বলা কি আইনের চোখে অপরাধ?
Indian Muslim: ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে বলে যে পাকিস্তান বা অন্য কোন দেশকে কোনও বিষয়ে শুভেচ্ছা জানানো ফৌজদারি অপরাধ নয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে 'পাকিস্তানি' বলা খারাপ রুচির হতে পারে তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধের মতো কিছু নয়। কাট টু ৭ মার্চ। দিল্লির একটি আদালত বলে, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী মানুষদের যেভাবে 'পাকিস্তানি' বলে উল্লেখ করছেন নানা বক্তৃতায় তা "ধর্মের ভিত্তিতে শত্রুতা প্রচার করার একটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে"। আর ধর্মের ভিত্তিতে শত্রুতা প্রচার করা ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ১৯৬-এর অধীনে একটি অপরাধ, এর আগে ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও তা ছিল ১৫৩এ ধারায় একটি অপরাধ। উল্লেখ্য, ওই একই দিনে, বিজেপি বিধায়ক গোপাল শর্মা বারবার রাজস্থান বিধানসভায় কংগ্রেসের চিফ হুইপ রফিক খানকে 'পাকিস্তানি' বলে উল্লেখ করেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'পাকিস্তানি' শব্দটি অপবাদ হিসাবে ব্যবহার করা আইনের পরিপন্থী কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন শব্দটি জনসমক্ষে হিংসাকে আহ্বান করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন এটি ঘৃণামূলক বক্তব্যের আইনের আওতায় পড়ে। তবে ব্যক্তিগত বক্তৃতায় কেউ যদি শব্দটিকে অপবাদ হিসেবে ব্যবহার করে, তা ফৌজদারি আইনের আওতায় পড়বে না। এখানেই এমন অপবাদকে বেআইনি ঘোষণা করার জন্য একটি বৃহত্তর বৈষম্য বিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন অনেক আইন বিশেষজ্ঞই।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় মুসলিমদের আক্রমণ করার জন্য 'পাকিস্তানি' শব্দটি ব্যবহার করছেন। প্রথম এমন একটি বিষয় আদালতে ওঠে ১৯৯৪ সালে।১৯৯২-'৯৩ সালে বম্বে সাম্প্রদায়িক হিংসার সময় দলীয় সংবাদপত্র সামনায় প্রকাশিত একটি লেখার জন্য শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের বিরুদ্ধে বম্বে হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। বাল ঠাকরে মুসলিমদের 'বিশ্বাসঘাতক' বলে অভিহিত করেছিলেন যারা 'মিনি-পাকিস্তান' তৈরি করেছেন বলে তাঁর অভিযোগ। বাল ঠাকরে হুমকি দিয়েছিলেন, পরিণতি বাবরি মসজিদের মতোই হবে।
আরও পড়ুন-ভারত-পাকিস্তান উভয়ের অধীনতাই অস্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ : মাহফুজ আলম
ওই জনস্বার্থ মামলায় দাবি করা হয়, বাল ঠাকরের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিধানের অধীনে মামলা করা হোক। এই ধারাগুলি হলো ১৫৩এ (ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার করা) এবং ১৫৩বি (জাতীয় সংহতির পক্ষে ক্ষতিকারক)। হাইকোর্ট দু'টি কারণে পিটিশনটি খারিজ করে দেয়। আদালত বলে, "বিচ্ছিন্ন বাক্যকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না" এবং "দুই সম্প্রদায়ই মিলেমিশে থাকতে শুরু করেছে"। তাই "ইস্যুটি নতুন করে তুলে ধরার অর্থ নেই"।
উল্টোদিকে ৭ মার্চ কপিল মিশ্রের বিরুদ্ধে দিল্লি আদালতের আদেশ 'পাকিস্তানি' অপবাদের সমস্যাটি তুলে ধরে বলা হয়, "দুর্ভাগ্যবশত সাধারণ ভাষায় পাকিস্তানের উল্লেখ প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সদস্যদের বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়"। এই অপবাদের অভিপ্রায় কেবল ধর্মীয় অর্থে আটকে নেই। এমনটা বলে আসলে বোঝানো হয় যে মুসলমানরা ভারতের অন্তর্গত নয়," বলেছেন আইনজীবী প্রতীক চাড্ডা। তাঁর ব্যাখ্যা, "এর অর্থ এই যে, আপনি একজন বিশ্বাসঘাতক যার অন্তরে ভারতের প্রতি স্বার্থ নেই, আপনি কখনই ভারতীয় হতে পারবেন না।"
ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির পাবলিক ল অ্যান্ড জুরিসপ্রুডেন্স সেন্টারের অধ্যাপক এবং নির্বাহী পরিচালক সুমিত বৌধের মতে, ভারতীয় ফৌজদারি আইনের অধীনে অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য এই কারণই যথেষ্ট হতে পারে। তিনি বলছেন, "ভারতীয় ও পাকিস্তানি জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে শত্রুতার ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি এবং একে অপরের বিরুদ্ধে গভীরভাবে নিমজ্জিত বিষাক্ত সন্দেহের অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতীয় মুসলমানদেরকে 'পাকিস্তানি' বলা একটি অনুমান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে যে তারা আসলে ভারতের সংবিধানের প্রতি সত্যিই বিশ্বাসী এবং অনুগত নয়"।
আরও পড়ুন-ঘৃণাপ্রচারেই এদেশে আরও পিছিয়ে পড়ছেন সংখ্যালঘু মুসলিমরা?
পাকিস্তানের পক্ষে থাকা মানে ভারতের বিপক্ষে থাকা— এমন একটি ধারণার জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে হু-হু করে বেড়েছে। তবে ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে বলে যে পাকিস্তান বা অন্য কোন দেশকে কোনও বিষয়ে শুভেচ্ছা জানানো ফৌজদারি অপরাধ নয়।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আসলে কোন প্রেক্ষাপটে কথাটি বলা হচ্ছে তাই ঠিক করে দেবে যে ভারতীয় মুসলমানের বিরুদ্ধে 'পাকিস্তানি' শব্দের ব্যবহার আসলে ফৌজদারি অপরাধ কিনা। আইনজীবীদের অনেকে বলছেন, সাম্প্রদায়িক হিংসায় নেতৃত্ব দেওয়া বা উস্কানি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে, 'পাকিস্তানি' শব্দের ব্যবহারকে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের বিধানের আওতায় আনা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমিংটন ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রাক্তন ভারতীয় পুলিশ ধিকাআরিক অরবিন্দ ভার্মা বলছেন, "অশ্লীল ভাষাকে শুধুমাত্র দেওয়ানি অপরাধ হিসাবে সম্বোধন করা উচিত। এই ধরনের মানহানি দেওয়ানি মামলা হিসেবেই ভালোভাবে পরিচালনা করা হয়; নাহলে এয়ে পুলিশের হাতে অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতা চলে আসতে পারে যাতে অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।"
আইনজীবীরা আরও বলছেন, কেবল এই জতীয় বক্তব্যকে অপরাধ মনে করলেই সমাধান হবে না। যেহেতু জাতীয় আনুগত্য এবং জাতীয় স্বত্ব সম্পর্কে এই ধরনের কুসংস্কার ধীরে ধীরে তৈরি হয়, তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাউকে শুধু 'পাকিস্তানি' বলার জন্য জেল হতে পারে না। খুব শক্তিশালী সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া দিয়েই একে প্রতিহত করা সম্ভব। আইনজীবীরা বলছেন, এটি নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে বৈষম্যের শিকার করা হচ্ছে— এটি একটি সাংবিধানিক সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য ভারতের একটি বৈষম্য বিরোধী আইন প্রয়োজন।