কেন ক্রমেই ইজরায়েলপন্থী হচ্ছে ভারত?

India Israel Relation: ইজরায়েল কেন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিল, কিংবা মানবিক সাহায্য পাঠানোয় বাধা সৃষ্টি করল, তা নিয়ে কোনও প্রশ্নও তোলেনি ভারত।

মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড যখন ভারত সফরে এসেছিলেন, তখনই ইজরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পুনরায় প্যালেস্তাইনে নরসংহারে মেতে ওঠে। বুধবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, ইজরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে ৫০৬ জন প্যালেস্তাইনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২০০ জন শিশু! ৯০৯ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। বুধবার ভোর থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই অঞ্চলে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হয়েছেন।

তুলসী গ্যাবার্ডের ভারত সফর শেষে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক মাত্র তিন লাইনের একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে শুধু পণবন্দিদের মুক্তির দাবি জানানো হয় এবং গাজার মানবিক সাহায্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়। তবে, ইজরায়েলের বোমা বর্ষণ বা নরসংহার বন্ধের কোনও দাবি সেখানে উল্লেখ করা হয়নি। ইজরায়েল কেন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিল, কিংবা মানবিক সাহায্য পাঠানোয় বাধা সৃষ্টি করল, তা নিয়ে কোনও প্রশ্নও তোলা হয়নি।

এটি স্পষ্ট যে, ভারতের এই অবস্থান মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টি রেখে নেওয়া হয়েছে। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার আগে থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামাসের কাছে পণবন্দিদের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিলেন।এই দাবি জানানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না কারণ ফেব্রুয়ারি মাসে হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় ধাপে ধাপে পণবন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া চলছিল। প্রথম পর্যায়ে হামাস ৩৩ জন ইজরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয়, যার বিনিময়ে ইজরায়েল শত শত ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়। এই সময় গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক মানবিক সাহায্য প্রবেশ করছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে নেতানিয়াহুর নির্দেশে ইজরায়েলি সেনারা গাজার প্রবেশপথে ব্যারিকেড বসিয়ে মানবিক সাহায্য নিষিদ্ধ করে।

আরও পড়ুন- দুর্নীতি ঢাকতেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার গাজায় আক্রমণ নেতানিয়াহুর?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনা থেকে দূরে সরে যায় এবং শুধু পণবন্দিদের মুক্তির দাবি জানাতে থাকে। এর ফলে নেতানিয়াহু তাঁর জোট সরকারের দক্ষিণপন্থী শরিকদের সমর্থন নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কৌশল গ্রহণ করেন। ইজরায়েল গাজায় হামলা পুনরায় শুরু করলে বিভিন্ন দেশ প্রতিবাদ জানালেও ভারত নীরব থেকেছে। ভারত শুধু পণবন্দিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে কিন্তু ইজরায়েলের নিষ্ঠুর আক্রমণ বন্ধের দাবি জানায়নি।

ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো, 'সরাসরি আলোচনার' মাধ্যমে দুই-রাষ্ট্র সমাধান, যেখানে একটি সার্বভৌম প্যালেস্তাইন "নিরাপদ এবং স্বীকৃত সীমানার মধ্যে শান্তিতে বসবাস করবে, ইজরায়েলের পাশাপাশি।" তবে, ২০২৩ সালের ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষের সময় ভারত যুদ্ধবিরতির পক্ষে সরাসরি ভোট দেয়নি, কারণ সেই প্রস্তাবে হামাসের বিরুদ্ধে কোনও নিন্দা ছিল না। ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ইজরায়েলের প্রতি তার ঝোঁক স্পষ্ট করে, যা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখার কারণে পরিচালিত হচ্ছে।

দেশিয়ভাবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণে ইজরায়েলপন্থী মনোভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে ইজরায়েলের নিরাপত্তা মডেলের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে এবং প্যালেস্তাইনপন্থী বিক্ষোভ দমনে সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের মতোই কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। আসলে প্যালেস্তাইন ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপকেই কার্যত অনুসরণ করে চলেছে ভারত।

আন্তর্জাতিকভাবে, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও প্যালেস্তাইনের প্রতি নীতিকে প্রভাবিত করছে। উপসাগরীয় দেশগুলো যেখানে ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার ও জ্বালানির উৎস, সেখানে ইজরায়েল পাকিস্তান ও চিনের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা প্রদান করছে। ফলে, ভারত একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে, তবে গাজার সংকট ক্রমশ তাকে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি করছে।

ভারতের নীতি একসময় উপনিবেশ বিরোধী সংহতির মধ্যে শিকড় গেড়েছিল কিন্তু এখন তা কৌশলগত বাস্তবতার দ্বারা পুনর্গঠিত হয়েছে। গাজার পরিস্থিতিতে ভারতের অস্পষ্ট অবস্থান এবং নৈতিক দ্বিধা তার আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের দাবিকে হাস্যকর করে তুলেছে । ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘর্ষ যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই ভারতের নীতি তার অস্পষ্টতা ও নীরবতার জন্য কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হবে।

More Articles