'১৪৪ বছর' আসলে রাজনৈতিক প্রচার! এবারের মহাকুম্ভ সত্যিই বিরল?

Maha Kumbh 2025 Myth: যদি শেষ মহাকুম্ভ মেলা ১৪৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮১ সালে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে হিসেবমতো তখন ভারতে ব্রিটিশদের শাসন। তাহলে ইংরেজদের খাতায় নিশ্চয়ই এত বড় সমাগমের উল্লেখ রইবে।

ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরলেই এখন এমন একজনের মানুষের দেখা মিলবে যিনি মহাকুম্ভ ঘুরে এসেছেন। সঙ্গমে ডুব দিয়ে পাপস্খলন করে এসেছেন। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনাও দমিয়ে রাখতে পারেনি মানুষের পাপমুক্ত হওয়ার তাড়নাকে। ধর্মীয় সমাবেশে এমন উত্তেজনা খুব স্বাভাবিক। কুম্ভ বা গঙ্গাসাগরের মতো মেলা ঘিরে এই উন্মাদনা নতুন নয় একেবারেই। তবে এবারের মহাকুম্ভকে এতটা জনপ্রিয় করে তোলার নেপথ্যে উত্তরপ্রদেশ সরকারের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। সমস্ত মানুষ মহাকুম্ভ নিয়ে এত আগ্রহী কারণ নানা মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়েছে যে, ১৪৪ বছর পরে এই মহাকুম্ভের মহাসংযোগ ঘটছে। সহজ করে বলতে গেলে এই কুম্ভ ভীষণই বিরল এক ঘটনা। বেঁচে থাকাকালীন এমন মুহূর্তের সাক্ষী আর দ্বিতীয়বার হওয়া যাবে না। প্রয়াগরাজে ২০২৫ সালের মহাকুম্ভ মেলা ঘিরে সারা বিশ্বে পর্যাপ্ত উন্মাদনা ছড়িয়েছে। বিদেশ থেকে মানুষের ভিড়, তারকাদের ভিড় উপচে পড়েছে এবারের কুম্ভে। আর যত ভিড়, ততই ব্যবসা! কিন্তু সত্যিই কি এবারের কুম্ভ এত বিরল? ১৪৪ বছর আগে কী ঘটেছিল কারও জানা নেই, ১৪৪ বছর পর কী ঘটবে তাও বলা যায় না। তাহলে ১৪৪ সংখ্যাতত্ত্বের মাহাত্ম্যখানি এত জনপ্রিয় হলো কীভাবে?

লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে '১৪৪ বছরে একবার' শব্দবন্ধটি জুড়ে গেছে। তবে মজার বিষয় হলো, গত তিন দশকে একাধিকবার এই ধরনের দাবি করা হয়েছে। ২০২৩ সালে আদিত্যনাথ সরকার প্রকাশিত একটি নথি এবং ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (CAG) একটি অডিট রিপোর্ট এলাহাবাদে ২০১৩ সালের মেলাকে 'মহাকুম্ভ মেলা' বলে উল্লেখ করেছিল। সেখানেও বলা হয়েছে যে ওই মেলা ১৪৪ বছর পরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন- বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরিতে নয়, কুম্ভ আয়োজনে বেশি টাকা দেওয়াই বিজেপির লক্ষ্য

কুম্ভমেলার জন্ম কীভাবে?

প্রয়াগরাজের কুম্ভমেলা হিন্দুদের অন্যতম বৃহত্তম উৎসব এবং বহু শতাব্দী ধরেই তা চলছে বলে জানা যায়। কুম্ভ হচ্ছে এক পবিত্র কলস। মহাকুম্ভের নেপথ্যে সেই পৌরাণিক সমুদ্র মন্থন এবং অমৃত উঠে আসার কাহিনিটি রয়েছে। পুরাণে বলা হচ্ছে, অমৃতভরা পবিত্র কলস নিয়ে দেবতা ও দানবদের যুদ্ধ হয়েছিল। তখন বিষ্ণু মোহিনীর ছদ্মবেশে রাক্ষসদের কাছ থেকে কলসটি ছিনিয়ে নেন এবং স্বর্গে চলে যান। বিষ্ণুরূপী মোহিনী যখন কলসটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অমৃতের কয়েক ফোঁটা নাকি ভারতের চারটি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে – এলাহাবাদ (আজকের প্রয়াগরাজ), হরিদ্বার, নাসিক এবং উজ্জয়িনী। পুরাণ বলছে, অমৃতকে স্বর্গে নিয়ে যেতে ১২টি 'ঐশ্বরিক বছর' লেগেছিল। ১ ঐশ্বরিক বছর মানে হচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্যালেন্ডারের ১২ বছরের সমান। তাই প্রতি ১২ বছরে এই চারটি স্থানে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রয়াগরাজ, যেখানে গঙ্গা, যমুনা এবং পৌরাণিক নদী সরস্বতী মিলিত হয়েছে সেই স্থানটিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কুম্ভ সমাবেশের স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

সাধারণত অর্ধ কুম্ভ প্রতি ছয় বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় এবং পূর্ণ কুম্ভ বা মহাকুম্ভ প্রতি ১২ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়।

কুম্ভ মেলার রাজনীতিকরণ

২০১৮ সালে উত্তরপ্রদেশের আদিত্যনাথ সরকার বিজেপির রাজনীতির অংশ হিসাবেই কুম্ভের তাৎপর্য বাড়াতে অর্ধ কুম্ভের নাম পরিবর্তন করে শুধু কুম্ভ করে। এর এক বছর পরে, যোগী সরকার প্রয়াগরাজে একটি কুম্ভমেলার আয়োজন করেছিল। এই মেলা স্মরণীয় হয়ে থেকেছে কারণ সেই প্রথম যোগী আদিত্যনাথ নিয়ম ভেঙে সঙ্গমের ঘাটগুলিতে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছিলেন। আদিত্যনাথ এ বছরও মেলার মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছিলেন।

বিজেপি সরকার ২০২৪ সালের মহাকুম্ভ মেলাকে '১৪৪ বছর'-এর বিরল ঘটনা হিসাবে বিশ্বের বাজারে তুলে ধরেছে। বিজেপির দাবি মানতে গেলে, হিসেব বলছে শেষ এই ধরনের বিরল ঘটনা ১৮৮১ সালে ঘটেছিল। তবে এই তত্ত্বে কিঞ্চিৎ ফাঁক থেকে যাচ্ছে।

২০২৩ সালে যোগী সরকারের রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ "গণ সমাবেশে ভিড় পরিচালনার নির্দেশিকা, ২০২৩" শিরোনামে একটি ৬০ পাতার নথি প্রকাশ করে। সমাজবাদী পার্টির শাসনামলে অনুষ্ঠিত ২০১৩ সালের মহাকুম্ভ মেলার সময় এলাহাবাদ রেল স্টেশনে পদদলিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে নথিতে বলা হয়েছে, “২০১৩ সালের অনুষ্ঠানটিকে মহাকুম্ভ মেলা হিসাবে বিবেচনা করা হতো, যা প্রতি ১৪৪ বছরে একবার ঘটে৷ এটি ৫৫ দিন ধরে চলেছিল এবং ১০০ মিলিয়ন তীর্থযাত্রী এতে অংশ নেবেন বলে আশা করা হয়েছিল, এটি সেই সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম অস্থায়ী সমাবেশে পরিণত হয়েছিল।"

আরও পড়ুন-পদপিষ্ট গরিবরাই! উচ্চবিত্তদের জন্য মহাকুম্ভে কী আয়োজন? চমকে দেবে বিলাসের বহর

তাহলে ২০১৩ সালেও একবার '১৪৪' খ্যাত মহাকুম্ভ মেলা হয়েছিল?

২০১৩ সালের কুম্ভ মেলার CAG-এর পারফরম্যান্স অডিটও বলছে সেই বছর ১৪ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ৫৫ দিন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মহাকুম্ভ মেলা। CAG রিপোর্টে বলা হয়েছে, "মহাকুম্ভ মেলা প্রতি ১৪৪ বছরে, পূর্ণ কুম্ভ মেলা প্রতি ১২ বছরে, অর্ধ কুম্ভ মেলা প্রতি ৬ বছরে এবং গঙ্গা নদী ও তার উপনদী যমুনার তীরে প্রতি বছর মাঘ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।”

২০১৩ সালের মহাকুম্ভ মেলার উপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশিত একটি বই 'কুম্ভ মেলা-ম্যাপিং দ্য ইফেমেরাল মেগা সিটি'-তে বলা হয়, ২০০১ সালে মহাকুম্ভ মেলা হয়েছিল যা আসলে ১৪৪ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

বরিষ্ঠ ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টুলি এলাহাবাদে ১৯৮৯ সালের মহাকুম্ভ মেলায় এসেছিলেন। তাঁর বই 'দ্য কুম্ভ মেলা'-র ১২ নম্বর পাতায় তিনি লিখেছেন, পুরোহিতদের বিশ্বাস ১৯৮৯ সালের কুম্ভ আসলে মহাকুম্ভ যা ১৪৪ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৮৯ সালের মেলা নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের তথ্য বিভাগের তৈরি একটি তথ্যচিত্রে বলা হয়, এটি আসলে পূর্ণ কুম্ভ।

সরকারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ১৪৪ বছরের কোনও উল্লেখ নেই

প্রয়াগরাজ জেলার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং ২০২৪ সালের মহাকুম্ভ মেলার ওয়েবসাইটেও ১৪৪ বছর পরে অনুষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা নেই। প্রয়াগরাজ জেলার ওয়েবসাইট বলছে, “প্রতি ৬ বছরে অনুষ্ঠিত কুম্ভ এবং প্রতি ১২ বছর অন্তর প্রয়াগরাজ (সঙ্গম) মহাকুম্ভ এই পৃথিবীতে তীর্থযাত্রীদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। সাম্প্রতিকতম মহাকুম্ভ মেলা ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং আগামীটি ২০২৫ সালে।”

যদি শেষ মহাকুম্ভ মেলা ১৪৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮১ সালে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে হিসেবমতো তখন ভারতে ব্রিটিশদের শাসন। তাহলে ইংরেজদের খাতায় নিশ্চয়ই এত বড় সমাগমের উল্লেখ রইবে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ অফিসার এইচআর নেভিল প্রকাশিত এলাহাবাদের গেজেটিয়ারে কিন্তু ১৪৪ বছরের উল্লেখ নেই। ওই গেজেটিয়ার বলছে, শেষ কুম্ভ মেলা ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল - যা ২০২৫ মহাকুম্ভ মেলার ১১৯ বছর আগে।

তাহলে আদৌ ১৪৪ বছরে যে মোহ ছড়িয়ে দিয়ে ভিড় টানা হচ্ছে উত্তরপ্রদেশে, তা সত্য?

More Articles