দক্ষিণ এশিয়ায় গণবিক্ষোভের নতুন যুগ! দুশ্চিন্তায় ভারত?

Sri Lanka, Bangladesh, and Nepal Mass Protests: ভারতে সরাসরি শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা নেপালের মতো ব্যাপক গণবিক্ষোভের সম্ভাবনা না থাকলেও, কিছু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ক্রমশ মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় কি গণবিক্ষোভের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে? শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের মতো দেশগুলোতে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে একের পর এক গণবিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় দেশগুলোতে সরকারের পতন ঘটেছে। এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে, গণতন্ত্র এখন আর শুধু ব্যালট বাক্সে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত হলেও,  আন্দোলগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ধারা রয়েছে। প্রতিটি আন্দোলনই দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

২০২২ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কায় 'আরাগালয়া' নামে একটি গণবিক্ষোভ শুরু হয়, যার মূল কারণ ছিল রাজাপক্ষে পরিবারের দুর্নীতি, স্বৈরাচারী শাসন এবং দেশের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটই শ্রীলঙ্কার জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়। সেই সময় জনগণ শুধু অর্থনৈতিক ত্রাণ নয়, বরং সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। এই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

একইভাবে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে এক বিশাল গণ-আন্দোলন শুরু হয়, যা 'কোটা সংস্কার আন্দোলন' এবং 'ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান' নামে পরিচিত। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল রাখার রায়ের প্রতিবাদে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই সরকারের দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সামগ্রিক অসন্তোষে পরিণত হয়। আন্দোলনকারীরা কৌশলগতভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ 'অসহযোগ আন্দোলন' শুরু করে, যার ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে রয়েছে 'জেন-জি' (Generation Z) নামে পরিচিত তরুণ প্রজন্ম। এই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা। যদিও কোনো তাৎক্ষণিক বড় অর্থনৈতিক সংকট ছিল না, তবুও এই ঘটনা তরুণ প্রজন্মের দীর্ঘদিনের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত করে তোলে। এই আন্দোলন প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব এবং তাদের পুরনো পদ্ধতির ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন-ভারত-চিন নতুন সমীকরণ! বিশ্বগুরু ইমেজে ধাক্কা?

এই তিনটি আন্দোলনই প্রমাণ করে যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তরুণ সমাজ ডিজিটাল মাধ্যমের সহায়তায় কীভাবে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে সক্ষম।

ভারতের উদ্বেগ ও নতুন নিরাপত্তা কৌশল

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে তরুণদের নেতৃত্বে গণবিক্ষোভের ঢেউ এবং তার চাপে সরকারের পতন- ভারতের নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। এই ধরনের আন্দোলন ভারতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ‘পুলিশ গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যুরোকে (বিপিআরঅ্যান্ডডি)’ দেশের স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের পরে সংঘটিত সব আন্দোলন নিয়ে বিশদ গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হল, আন্দোলনগুলোর ইতিহাস, কার্যকারণ, গতিপ্রকৃতি এবং আর্থিক উৎস বিশ্লেষণ করা। পাশাপাশি 'পর্দার আড়ালে ক্রীড়নকদের' খুঁজে বের করা। গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) আয়োজনে দুদিনব্যাপী 'ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজিস কনফারেন্স-২০২৫'-এ অমিত শাহ এই নির্দেশ দেন।

ভবিষ্যতে 'স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর ব্যাপক আন্দোলন' প্রতিরোধের জন্য একটি 'স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি' তৈরির জন্যই এই গবেষণা। আন্দোলনের আর্থিক দিকগুলো বিশ্লেষণের জন্য এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি), ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-ইন্ডিয়া (এফআইইউ - আইএনডি) এবং সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস (সিবিডিটি)-এর মতো আর্থিক তদন্ত সংস্থাগুলোকে এই গাবেষণায় যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, ধর্মীয় সমাবেশে ভিড় নিয়ন্ত্রণ, পাঞ্জাবের খালিস্তানি উগ্রবাদ, মাদক পাচার ও অন্যান্য নিরাপত্তা বিঘ্নিতকারী ঘটনাগুলোর মোকাবিলা করার জন্য ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ), বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এবং নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোকে (এনসিবি) আলাদা কৌশল তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সামগ্রিক পদক্ষেপটি সম্ভাব্য বিপদকে আগে থেকেই শনাক্ত করতে এবং তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নির্দেশের পর, বিপিআরঅ্যান্ডডি-এর একটি দল গঠন করা হয়েছে, যা রাজ্যের পুলিশ দফতরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করবে। এর মধ্যে পুরনো মামলার নথিপত্র এবং সেসব সম্পর্কে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের(সিআইডি) প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ভারতের পরিস্থিতি কি ভিন্ন?

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভ ভারতকে কিছুটা চাপে রাখলেও, ভারতের পরিস্থিতি বাকি দেশগুলোর থেকে ভিন্ন। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের বিক্ষোভের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক সংকট, ব্যাপক দুর্নীতি এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।

বাংলাদেশে 'কোটা সংস্কার আন্দোলন' এবং 'ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান'

অন্যদিকে, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহুস্তরীয় ও বিকেন্দ্রীভূত। এখানে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের মতো শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও কার্যকর। অর্থনৈতিকভাবেও ভারত শ্রীলঙ্কার মতো গভীর সংকটে নেই। যদিও ভারতে বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তা এখনও দেশব্যাপী একটি সর্বজনীন গণবিদ্রোহের জন্ম দেওয়ার মতন নয়। বর্তমানের বিচ্ছিন্ন আন্দোলনগুলো, যেমন কৃষক আন্দোলন বা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন, নির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে গড়ে উঠেছে। ফলে এই দেশগুলোর মতো ‘মৌলিক পরিবর্তন'-এর দাবিতে ভারতে এই মুহুর্তে গণবিক্ষোভের সম্ভাবনা কম।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভারতের উদ্বেগ

ভারতে এই ধরনের গণবিক্ষোভের সম্ভাবনা কম হলেও, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই আন্দোলনগুলো শুধুই অভ্যন্তরীণ কারণে ঘটেনি, বরং আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করেছে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট ভারতের জন্য ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগের কারণ। চীন, শ্রীলঙ্কার প্রধান ঋণদাতা এবং হাম্বানটোটা বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে। এই বন্দরটি যখন ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন একটি ৯৯ বছরের ইজারাতে চিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই পদক্ষেপকে ভারত চিনের "স্ট্রিং অফ পার্লস" কৌশলের অংশ হিসেবে দেখে, যা ভারত মহাসাগরে চিনের সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে এই অঞ্চলে ভারতের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এর মোকাবিলায়, আমেরিকা কলম্বো বন্দরের একটি টার্মিনালে বিনিয়োগ করেছে, যা ভারতের সঙ্গে কৌশলগতভাবে চিনের বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষা করে। সংকটকালে ভারত দ্রুত শ্রীলঙ্কাকে মানবিক ও আর্থিক সহায়তা (প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার) প্রদান করে, যা তার 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতির প্রতিফলন এবং এই অঞ্চলে চিনের প্রভাব প্রতিরোধের একটি চেষ্টা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং "জুলাই বিপ্লব"-এর পেছনে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি যদি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সার্বভৌমত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতেন এবং বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতেন, তাহলে তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। এই ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক শক্তির গভীর প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরেছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম অঞ্চলে মার্কিন সামরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত ও মায়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো কিছুটা সমস্যায়।  বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং সেখানে চিনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক ও সামরিক উপস্থিতি ভারতকে গভীরভাবে চিন্তিত করেছে।

নেপাল, ভারত ও চিনের মাঝে অবস্থিত হওয়ায়, উভয় শক্তির জন্য একটি কৌশলগত গেমপ্লেস বা খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের (বিআরআই) মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলোকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। চিন দ্রুত নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যম নেপালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পেছনে মার্কিন-চিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রভাব থাকার কথা দাবি করেছে। এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। কারণ নেপালের অস্থিতিশীলতা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা এবং ওই অঞ্চলের কৌশলগত ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে, ভারত বর্তমানে প্রকাশ্যে কোনো পক্ষের সঙ্গে না থেকে একটি সতর্ক অবস্থান নিয়েছে, কারণ তারা মনে করে যে কোনো পক্ষ নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

২০২২ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কায় 'আরাগালয়া' নামে একটি গণবিক্ষোভ

ঘটনার পরম্পরায় একটা বিষয় পরিস্কার, এই আন্দোলনগুলোর পেছনে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ও আর্থিক সহায়তার রয়েছে। সম্প্রতি  জামায়াতে ইসলামীর এক ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় মুখপাত্র আবু বকর মোল্লার কথায় তা স্পষ্ট।  তিনি বলেছেন, গত জুলাইয়ের বাংলাদেশের আন্দোলনের সময় ইউনূস মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে একটি বিদেশি লবিং ফার্ম নিয়োগ করেছিলেন।

শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ-নেপালের বিক্ষোভ ও বিদেশি শক্তি

ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভের ঘটনাগুলো নতুন করে বিদেশি শক্তির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা উসকে দিয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন এবং অনুসন্ধানে এসব আন্দোলনের পেছনে বিদেশি হস্তক্ষেপের সম্ভাব্য যোগসূত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার 'আরাগালয়া' আন্দোলন মূলত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শুরু হয়েছিল। তবে, কিছু প্রাক্তন শাসক নেতা, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলছে, তারা অভিযোগ করেছেন যে আমেরিকার সাহায্য সংস্থা ‘ইউ এস এ আই ডি’ দ্বারা অর্থায়িত এনজিও গুলো তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে, শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল এনজিও সেক্রেটারিয়েটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে বিদেশি এনজিও গুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিছু রাজনৈতিক মহল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে বিদেশি শক্তির মদত ও আর্থিক সহায়তায় এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। ইন্ডিয়া টুডের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের পেছনে বিদেশি অর্থায়নের যোগসূত্র থাকতে পারে। এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ছাত্র বিক্ষোভকারীরা অবৈধ ক্রিপ্টো বিনিয়োগের সাথে জড়িত, যা পরবর্তীতে অর্থ পাচারের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু ছাত্রনেতারাই নয়, আইটি উপদেষ্টারাও এই অবৈধ লেনদেনে জড়িত ছিলেন। এর ফলে, যে আন্দোলনকে প্রথমে ছাত্র-চালিত মনে করা হয়েছিল, তা পরে ক্ষমতা দখলের জন্য বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রচেষ্টা বলে মনে হয়েছে।

নেপালের জেন-জি আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ থেকে। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ আরও তীব্র। ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ইউ এস এ আই ডি’–এর অর্থ নেপালের কিছু এনজিও এবং রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃত  হয়েছে, যা দেশটির সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং অস্থিরতা বাড়িয়েছে। এমনকি, বিক্ষোভের সমন্বয়কারী একটি ডিসকর্ড গ্রুপে একজন এনজিও নেতার আর্থিক উৎস নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

এনজিও-দের ভূমিকা ও ভারতের গভীর উদ্বেগ

প্রতিবেশী দেশগুলোর গণবিক্ষোভের অভিজ্ঞতা থেকে ভারত সরকার বিদেশি তহবিলের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) ২০১৪ সালের একটি রিপোর্টে অভিযোগ করে, বিদেশি অর্থায়িত এনজিও গুলো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে দেশের জিডিপি ২-৩% কমিয়ে দিয়েছে।

এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে ভারত সরকার Foreign Contribution (Regulation) Act বা FCRA-এর মতো কয়েকটি আইন আরও কঠোর করেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ২০,৬৮৫টি এনজিও-র FCRA লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে বিদেশি অনুদান গ্রহণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এই ধরনের পদক্ষেপ প্রমাণ করে, ভারত সরকার যে কোনো ধরনের গণবিক্ষোভের নেপথ্যে বিদেশি প্রভাবের সম্ভাবনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং তা প্রতিরোধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।

নেপালের জেন-জি আন্দোলন

প্রতিবেশী দেশগুলোতে গণবিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ায় ভারত সরকার বিদেশি এনজিও এবং আর্থিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তারা এসব আন্দোলনকে শুধু স্থানীয় জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছে না, বরং এর পেছনে বিদেশি শক্তির ইন্ধন রয়েছে বলে সন্দেহ করছে। এই কারণেই ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় অমিত শাহ এই গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন- চিনের গোলামিই নেপালে কেপি ওলির পতন ডেকে আনল?

ভারতের ভবিষ্যৎ

ভারতে সরাসরি শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা নেপালের মতো ব্যাপক গণবিক্ষোভের সম্ভাবনা না থাকলেও, কিছু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ক্রমশ মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, দুর্নীতির মতো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো যদি তীব্র হয়, তাহলে তা জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বাড়াতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, নেপাল ও বাংলাদেশের মতো ভারতেও তরুণ প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম, যা প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে কৃষক আন্দোলন বা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনগুলো বিচ্ছিন্নভাবে চললেও, ভবিষ্যতে কোনো বড় সংকটে এই বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদগুলো একত্রিত হয়ে এক বিশাল গণবিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।

২০২১ সালে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনের মুখে সরকারের পিছু হটা এবং আইন বাতিল করতে বাধ্য হওয়াকে অনেকেই এক ধরনের 'সিঁদুরে মেঘের লক্ষণ' হিসেবে দেখছেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে সংগঠিত আন্দোলন যদি দীর্ঘস্থায়ী এবং শক্তিশালী হয়, তাহলে তা ক্ষমতাশীল সরকারের ওপরও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, ভবিষ্যতে এই ধরনের বিক্ষিপ্ত আন্দোলনগুলো যদি কোনো বড় অর্থনৈতিক বা সামাজিক সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তা ভারতেও এক বড় ধরনের গণবিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।

এইসব সমস্যা মাথায় রেখে, ভারতেরও তরুণ প্রজন্মের অসন্তোষ দূর করতে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া জরুরি। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করা উচিত। পাশাপাশি, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবশেষে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে শুধু নজরদারির কাজে ব্যবহার না করে বরং জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে সরকার জনগণের ক্ষোভকে একটি গঠনমূলক পথে চালিত করতে পারে, যা দেশব্যাপী বড় ধরনের গণবিক্ষোভ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত কার্যকর হবে।

More Articles