যাদবপুর কাণ্ডে বেকায়দায় ব্রাত্য, কেন চুপ তৃণমূল?

Bratya Basu Jadavpur: খোদ শিক্ষামন্ত্রী এবং যাদবপুরের মতো এলাকা যেখানে জড়িত, সেখানে তৃণমূলের নীরবতা ভাবায়।

যাদবপুর আবারও শিরোনামে। গত শনিবার, ১ মার্চ দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়ির তলায় এক ছাত্রর চাপা পড়া এবং বিক্ষোভ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। সময় যত এগিয়েছে, তৃণমূল প্রমাণ করতে মরিয়া হয়েছে যে আসলে ব্রাত্য বসুর গাড়িতেই 'বাম ছাত্ররা' হামলা করেছে। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমে যে ছবি উঠে এসেছে সেদিনের, তা মর্মান্তিক এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শাসকদল যে স্বাভাবিকভাবেই উল্টোসুর গাইবে তাও স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক হচ্ছে, এতখানি সময় কেটে যাওয়ার পরেও তৃণমূলের সামনের সারির নেতৃবৃন্দ এই নিয়ে চুপ! আরও মজার হচ্ছে, ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের ফেসবুক এবং এক্স হ্যান্ডলে এই ঘটনা নিয়ে কোনও পোস্ট বা বক্তব্য ছিল না। একটা আস্ত দিন পার করে রবিবার বিকালে ব্রাত্য বসুর ঘটনায় প্রথম পোস্ট করে তৃণমূল। তবে নিতান্তই সাদামাটা পোস্ট! তৃণমূল কি জল মাপছিল? তৃণমূল কি ব্রাত্য বসুর ভূমিকায় শ্যাম রাখবে না কুল, সেই নিয়েই চিন্তিত ছিল?

দৃশ্য বড় গভীর ছাপ ফেলে যায়। ব্রাত্য বসুর ঘটনা ঘটতেই যে ছবি মানুষের মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ে তা খুব স্বাভাবিকভাবেই রোষ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। যাদবপুর আর শাসক তৃণমূলের সম্পর্ক মোটেও সুমধুর নয়। এই পরিস্থিতিতে ২৪ ঘণ্টা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে তৃণমূলের চুপ থাকা নিয়ে তাই প্রশ্ন ওঠেই। প্রশ্ন ওঠে, তুলকালাম করা ঘটনায় কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ শীর্ষ নেতৃত্বরা চুপ কেন?

আরও পড়ুন- যাদবপুরে ছাত্র ভোটের দাবিতেই সংঘর্ষ! কী বলছে পক্ষ ও বিপক্ষ?

উল্লেখ্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শনিবারের ঘটনার ঠিক পরেই পথে নামেন তৃণমূলের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, সাংসদ সায়নী ঘোষ-সহ যাদবপুর, টালিগঞ্জের প্রথম সারির তৃণমূল নেতারা। অরূপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে মিছিল হয়। অর্থাৎ ধরে নেওয়াই যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই তা হয়েছে। তাহলে সেই কর্মসূচিরও কোনও ছবি তৃণমূলের সমাজমাধ্যমের পাতায় দেওয়া হলো না কেন? সমগ্র তৃণমূলই কি তবে ব্রাত্যকে 'ব্রাত্য' করছে এই মুহূর্তে? তৃণমূল সমাজমাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয়। জন্মদিন থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্পের প্রচার, যে কোনও কাজেই তৃণমূলের আইটি সেল অত্যন্ত সক্রিয়। খোদ শিক্ষামন্ত্রী এবং যাদবপুরের মতো এলাকা যেখানে জড়িত, সেখানে তৃণমূলের নীরবতা ভাবায়।

এই মুহূর্তে তৃণমূলের আইটি সেলের মুখ্য দায়িত্ব পালন করেন দেবাংশু ভট্টাচার্য। হ্যাঁ, দেবাংশু এই ঘটনায় অতি সক্রিয়। তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন, আসলে ব্রাত্য বসুর গাড়িতে পিষে যাননি ওই ছাত্র। তিনি অন্যভাবে আহত হয়েছেন। যাদবপুরের বাম এবং অতি বামেরা কুৎসা করতেই 'নকশাল' ওই ছাত্রকে সামনে খাড়া করছেন। তবে দেবাংশু এই কথা নিজের পেজ থেকেই পোস্ট করেছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘ঘটনা ধরে ধরে ‘কাউন্টার’ করা পার্টির পেজের কাজ নয়। সেগুলো আমরা করছি। পার্টির মূল পেজ থেকে পোস্ট করে কয়েকটা সিপিএম আর মাওবাদীদের বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হবে কেন? দলের পেজ থেকে আরও অন্যান্য কর্মসূচি, অন্য রাজ্যের কর্মসূচি পোস্ট করা হয়েছে।’’ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বিবৃতিতে দেবাংশু আরও বলেছেন, "প্রথমে যে ভিডিওগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল, তা স্থানীয় ভাবে তোলা। সেখানে কোনও বড় সংবাদমাধ্যম ছিল না। তাই ধোঁয়াশা ছিল। সেটা দেখে নিয়েই পোস্ট করা হয়েছে।’’ এখানে আবারও প্রশ্ন ওঠে, ধোঁয়াশা থাকলে অরূপ বিশ্বাস, সায়নী ঘোষরা মিছিল করলেনই বা কীভাবে?

ছাত্রভোটের দাবিতে আন্দোলন, মন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে ধরে বিক্ষোভ, ঘেরাও কোনওটাই নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু খোদ শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নীচে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ পড়ুয়ার গুরুতর আহত হওয়া, রক্তাক্ত হওয়াকে কোনওভাবেই 'ছোট ঘটনা' বলে আর প্রতিহত করার জায়গা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের মুখেরা কি এইজন্যই চুপ? যাদবপুরের ঘটনায় এবিভিপির হাত ধরে বঙ্গীয় বিজেপি-আরএসএস নিজেদের স্থান পোক্ত করার চেষ্টা করবে, বলা বাহুল্য। তাতে তৃণমূলের পা থেকেই জমি হারানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অথচ খোদ শিক্ষামন্ত্রী যাতে জড়িত, সেই ঘটনার মোকাবিলা না করেও উপায় নেই! তাহলে তৃণমূল সুপ্রিমোর কাছে এখন কোন পথ খোলা?

আরও পড়ুন- শনিবার কী ঘটল যাদবপুরে? জানুন ঘটনার নেপথ্যে কারা

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্প বৈঠক করেছেন। বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন। অথচ ব্রাত্য বসু বা যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে চুপ! তবে কি ব্রাত্যর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বাড়িয়ে দলকে 'কলুষ মুক্ত' করার কথা ভাবছে তৃণমূল? কেন কুণাল ঘোষের মতো বিতর্কিত মুখদের ব্রাত্যকে নিয়ে পোস্ট করার অবাধ ছাড়পত্র রয়েছে, আর অভিষেক থেকে শুরু করে মমতারা চুপ? ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন নেতা একাধিক পোস্ট করে যাচ্ছেন, কাউন্সিলররা মিছিল করছেন, বিধায়ক মদন মিত্র পোস্ট করছেন। অথচ দলগতভাবে প্রতিবাদ নেই কেন? উল্লেখ্য, যাদবপুরের র‍্যাগিং কাণ্ডে সরব হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃত পড়ুয়ার ভোগান্তির দায় চাপিয়েছিলেন সিপিএমের উপরেই। ২০১৪ সালে হোক কলরব আন্দোলনের রেশ ধরে, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন মমতা। নিজে পৌঁছে যান যাদবপুরে। তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেন, বিধিভঙ্গ করেই। আর এবার, সরাসরি শিক্ষামন্ত্রী জড়িত! অথচ মুখ্যমন্ত্রী চুপ! 

এই নীরবতা নতুন প্রজন্মের ভোটারদের দলে টানতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো? কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর যে নতুন ছাত্রছাত্রীদের ঝাঁক ঢোকে সেখান থেকেই প্রতিটি দলই যুব সদস্য বাড়াতে চেষ্টা করে। যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক দশকে একটু একটু করে জমি তৈরির চেষ্টা করে গিয়েছে তৃণমূলের ছাত্র পরিষদ। সেখানে এই ঘটনায়, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে বিরূপ বার্তা যাচ্ছে না কি? 

তথ্য বলছে, রাজ্যের কলেজগুলিতে সাত বছর এবং যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। অথচ ক্রমেই শাসকের দাপট বাড়ছে ক্যাম্পাসে। জেলা, মফসসলের কলেজে পড়াশোনার উন্নয়নের কী হাল, তা নিছক শিশুও এখন জানে। চাকরি নেই, দুর্নীতি ভরপুর, আবার শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িই ছাত্রকে গুরুতর আহত করছে! ক্যাম্পাস দখলে রাখতে চেয়ে, দলের বৈঠকে ভিড় বাড়ানোর মুখ বাড়াতে গিয়ে শাসকদল আখেরে শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত কি?

More Articles