তুলোর হৃদয় শুকনো ফুলের প্রেমদিবস কি বাঙালিয়ানা?

গীতগোবিন্দের কথা মনে আছে তো? জয়দেব লিখছেন, ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনং ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম; অর্থাৎ তুমিই আমার ভূষণ, তুমি আমার জীবন, এই জীবন সমুদ্রে তুমিই আমার রত্ন। তাই রত্নটি অর্থাৎ কিনা আসমুদ্র হিমাচলের প্রাচীনতম লাভারবয়টি নিজেও কিছু কম যান না। বাংলার কবিরা সুযোগ পেয়ে তাঁকে দিয়েও বলিয়ে নিয়েছেন অমোঘ প্রেমের কাব্য।


যব গোধূলি সময় বেলি
ধনি মন্দির বাহির ভেলি।
নবজলধর বিজুরি রেহা
দন্দ পসারি গেলি।।


মোটামুটি ভাবে এই ধরতাই থেকে যদি ‘বাংলা প্রেমের’ গল্প শুরু হয় তবে তার পর থেকে এই কৃষ্ণ এই রাধাই হাজার হাজার রুপে, হাজার হাজার বুলিতে যুগান্তের অবসানের পর ও গেয়ে চলেছেন প্রেমের গান। প্রাচীন কবি বিদ্যাপতি থেকে ঝাঁকড়া চুলো যাকে বলে সকলেরই তনু জরজর। মাঝে মাঝে মনে হয় রাধাকৃষ্ণ মোটিফে শুধুমাত্র প্রেমিক মনের রূপকল্পেরই সমাবেশ। যে সম্পর্কের ভার নেই, লালিত্য আছে অথবা যে ছেড়ে যাওয়ার গুরুভারে এক বেণী বেঁধে বিরহিণী হওয়া যায় সেই প্রাচীনতম নেশার এ সকলি অছিলা। সত্যি কথা বলতে, এই যুগল আদল খুঁজে একটা প্রেম পরিণয় বিবাহের ধুন্ধুমার লাগিয়ে দেওয়া বাঙালির সনাতন অভ্যাস। তা নইলে অত বড় যে শিব ঠাকুর তার বউ কিনা অপরের কাছে ঠাট্টার ছলে বলেন, ‘কোনও গুণ নাই তার কপালে আগুন’। যেন চিরকালীন বাঙালি বউ পড়শিনির কাছে স্বামী নিন্দার ছলে আদতে প্রশংসাই করতে বেরিয়েছেন।শুধু প্রেমের দৃশ্যায়ন দেখতে চাওয়ার ইচ্ছেয় বাংলার কবিরা প্রেমকে জাগতিক থেকে সাংসারিক করে সামগ্রিকের আলপনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই চির সনাতন রোম্যান্টিক আবহ থেকে বাংলার প্রেমের কবিতার দ্বিধা থরথর সাতটি কথার চূড়ে যে অমরাবতী ভর করেছিল হতচ্ছাড়া ক্যাডবেরি কোম্পানি তো সেই গল্প জানে না। জানে তো নাই, উপরন্তু গলা ফুলিয়ে তাঁরা তাদের গল্পই কেবল চকোলেটের সঙ্গে খাওয়াতে চায়। এদিকে আমরাও ভারী মজার মানুষ। সদাসর্বদাই যেন আমাদের পাচন গেলানো পিসিমা চাই। ওনার কথাতেই ওষুধ গিলি। যেমন ফুল কিনি আজকের দিনে। পশ্চিমই দুনিয়াই আমাদের সেই পাচন গেলানো পিসিমা। আমরা সোনামুখ করে তুলোর হৃদয় আর মরা ফুল কিনে দিনযাপন করি। ৯০ এর দশকে যখন ভারতে গ্লোবালাইজেশনের দোলা লাগল। ভারতীয় বাজার উন্মুক্ত হল বিদেশের কাছে। নিউ ইয়ারে কার্ড আর জন্মদিনে ক্যাডবেরির সেই শুরু। প্রেমের পণ্যায়নের প্রক্রিয়ায় এল উৎসব। ‘ভ্যালেন্টইন্স ডে’ মানেই হল ভালবাসার দিন। যে বাঙালি কবি রাতের চাঁদ দেখে প্রেমিকাকে চিঠি লিখত তার বদলে এল এসএমএস।

কিন্তু এই যে সংস্কৃতির মধ্যে জাঁকিয়ে বসল পশ্চিমী আচার, তার মধ্যে হৃদয়ের অস্তিত্ব ফিকে হতে হতে আজ বিপন্নপ্রায়। ক্যাপিটালিজমের নেশায় চে খোদাই হলেন কাপের গায়ে, টি শার্টের ওপর। এক প্রকাণ্ড অজগরের ছাগল গিলে ফেলার মত করে পশ্চিমের সংস্কৃতি গ্রাস করে নিল আমাদের সব। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতই ‘আমাদের সব দরকার। আমরা ঘরবাড়ি গড়বো’। কিন্তু ‘সভ্যতার স্থায়ী স্তম্ভ’ তুলে ধরতে গিয়ে ভালবাসা, আকুতি, হৃদয় সব কোথায় যেন রুপোলী মাছের মত হারিয়ে গেল।

তাই আমাদের কাছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-ই হল প্রেমের উদযাপনের দিন। যে বাঙালির জয়দেব- বিদ্যাপতি- শক্তি- উৎপলের প্রেমকাব্য পড়ে এককালে ভালবাসার মিনার গড়েছিল তারাই এখন কার্ড, শুকনো ফুল, আর টেডি-বেয়ারের মধ্যে ভালবাসাকে খুঁজে নেওয়ার দৌড়ে ধুঁকছে।

আশার কথা এই যে কোনও বিদেশি তত্ত্বই ভারতে এসে স্বধর্ম হারায়। বহুক্ষেত্রেই শিব গড়তে বাঁদর হলেও চমকে দেওয়ার মত ঘটনা আছে ভুরিভুরি। শতাব্দী পেরিয়ে ও তাই ঔৎসুক্য কমল না, দেখতে চায় বাঙালি, এ রঙ্গ কতদূর এগোয়। ভালবাসার বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি নাকি ভালবাসা মানেই আর্চিস গ্যালারি, জিতছে কে? বাছাই পর্ব শেষ হল কী?

More Articles