আরও অবৈধ বসতি বানাচ্ছে ইজরায়েল! দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের কফিনে শেষ পেরেক?
Israel illegal settlements: বর্তমানে পশ্চিম তীরে ৫০০,০০০-এরও বেশি ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর বাস, যারা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত ১০০টিরও বেশি বসতিতে অবস্থান করছেন।
ইজরায়েল সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২২টি নতুন অবৈধ বসতির অনুমোদন দেবে, যার মধ্যে এমন কিছু ‘আউটপোস্ট’ রয়েছে যা সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে এবং এতদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও ইজরায়েলি আইনের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত ছিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এই সিদ্ধান্তের ঘোষণায় বলেন, এটি “জুডিয়া ও সামারিয়া”— অর্থাৎ অধিকৃত পশ্চিম তীরের উপর ইজরায়েলি নিয়ন্ত্রণকে আরও শক্তিশালী করবে এবং একই সঙ্গে সম্ভাব্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথ রুদ্ধ করবে। কাটজ এই পদক্ষেপকে একটি “কৌশলগত সিদ্ধান্ত” হিসেবে বর্ণনা করেন যা ইজরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে স্মোট্রিচ, যিনি নিজে অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি জমিতে গড়ে ওঠা একটি বসতিতে বসবাস করেন এবং যিনি পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইজরায়েলি ভূখণ্ডে রূপান্তরের পক্ষে জোরালোভাবে সোচ্চার, একে “ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত” বলে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির পক্ষ থেকেও এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি “এক প্রজন্মে একবার” আসা সুযোগ যা ইজরায়েলের পূর্ব সীমান্তে, অর্থাৎ জর্ডান উপত্যকার পাশে, চূড়ান্ত দখলদারি বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করবে।
বর্তমানে পশ্চিম তীরে ৫০০,০০০-এরও বেশি ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর বাস, যারা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত ১০০টিরও বেশি বসতিতে অবস্থান করছেন। এই বসতিগুলো ছোট ও অননুমোদিত আউটপোস্ট থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামোযুক্ত শহুরে বসতিতে পরিণত হয়েছে, যার ফলে পশ্চিম তীরের তিন মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিটমহলের মতো বসবাসে বাধ্য হচ্ছেন। বসতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইজরায়েল এমন এক 'বাস্তবতা' তৈরি করছে, যেখানে এক অবিচ্ছেদ্য, টুকরো টুকরো করা ভূখণ্ডে একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি শুধু দখলদারিত্ব নয়, বরং “নীরব জাতিগত শুদ্ধির” কৌশল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ২৩৩৪, ২০১৬ সালে গৃহীত, এই ধরনের সকল বসতি স্থাপনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং বারবার আহ্বান জানিয়েছে বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করার জন্য। একই সঙ্গে ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে। তবুও, ইজরায়েল ক্রমাগত এইসব রায় উপেক্ষা করে যাচ্ছে এবং পশ্চিম তীরকে একটি ডি ফ্যাক্টো ইজরায়েলি এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- কীভাবে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে AI ব্যবহার করল ইজরায়েল?
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনেহ এই সিদ্ধান্তকে “বিপজ্জনক উত্তেজনার সূচনা” এবং “আন্তর্জাতিক বৈধতার প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ” বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন এবং তা একথা স্পষ্ট করে দেয় যে ইজরায়েল আলোচনার মাধ্যমে নয়, একতরফাভাবেই রাজনৈতিক বাস্তবতা চাপিয়ে দিতে চায়। তিনি মনে করিয়ে দেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সব বসতি কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং তা অবৈধই থাকবে। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্তকে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান প্রক্রিয়ার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যতের একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে মাটিচাপা দেওয়া। ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হামাসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি বলেন, “নেতানিয়াহুর সরকার পশ্চিম তীরে নতুন ২২টি বসতির ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।” তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নকে এই বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ এবং কার্যকর পদক্ষেপ করার আহ্বান জানান।
ইজরায়েলি বেসরকারি সংস্থা পিস নাউ এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই সিদ্ধান্ত পশ্চিম তীরের চেহারাকে আমূল বদলে দেবে এবং দখলদারি ব্যবস্থাকে আরও গভীর ও স্থায়ী করে তুলবে।” সংস্থাটি আরও জানায়, এটি একটি সময়োপযোগী কৌশল — যখন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি গাজার যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিবদ্ধ তখন ইজরায়েল পশ্চিম তীরে তার ভূখণ্ড ও জনসংখ্যাগত বাস্তবতা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে। আল জাজিরার সাংবাদিক নিদা ইব্রাহিম এই প্রসঙ্গে বলেন, “ইজরায়েলি বসতিগুলো ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিন সম্প্রদায়কে শ্বাসরোধ করছে। এই নতুন বসতিগুলো সেই ফাঁকগুলো পূরণ করে ফেলবে, যেগুলো ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য সামান্য যে ভূখণ্ড অবশিষ্ট ছিল, তাকেও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তুলবে।” তাঁর মতে, গাজার মানবিক সংকট আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও কূটনীতিকে ব্যস্ত রেখেছে, আর এই ফাঁকে ইজরায়েল পশ্চিম তীরকে চূড়ান্তভাবে নিজের দখলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা কার্যকর করছে।
এই ঘোষণাটি এমন এক সময়ে করা হলো, যখন ফ্রান্স ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে জাতিসংঘে একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পরিকল্পনা চলছে, যার উদ্দেশ্য দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা ইজরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান পুনরুজ্জীবিত করা। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বসতি সম্প্রসারণের এই সিদ্ধান্ত সেই প্রক্রিয়াকে কার্যত অকার্যকর করে তুলবে এবং এই অঞ্চলকে আরও গভীর সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক অবস্থান, ইজরায়েলকে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে উৎসাহিত করছে বলেও মত দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আদৌ কার্যকর কোনও পদক্ষেপ করবে? না কি এই নীরবতা আরও একবার অন্যায় দখলদারিত্বকে বৈধতা দেবে এবং একদিন ইতিহাসে লেখা হবে — দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান শুধু এক রাজনৈতিক কল্পনা ছিল, যার কবর রচিত হয়েছে শিলাখণ্ডের আড়ালে গড়ে ওঠা বসতি শহরের ভিতরেই।