ইজরায়েলের ডানপন্থী সরকার প্যালেস্তাইনের হামাস, দুইয়ের পতন চাই
Israel Palestine War 2023 : সন্ত্রাসবাদ আসলে তো ফ্যাসিবাদ এবং ছদ্ম-ধর্মীয় মৌলবাদের পছন্দের অস্ত্র। সন্ত্রাস চিরকালই জাতীয় মুক্তি ও বিপ্লবের শত্রু।
শান্তিকে কখনও 'লক্ষ্য' হিসাবে ধরা উচিত নয়। শান্তি হচ্ছে লক্ষ্যে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় এবং পথ। শান্তির মাধ্যমে যা সম্ভব নয়, তা অনুসরণ করাই উচিত নয়। যদি মুক্তি এবং ন্যায়বিচার লক্ষ্য হয়, তবে হিংসার মাধ্যমে তা কখনই পাওয়া সম্ভব না। হিংসা তো মুক্তি এবং ন্যায়বিচারকেই হত্যা করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, একমাত্র শান্তিই মুক্তি ও ন্যায়ের জন্ম দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ প্যালেস্তাইন এবং সেদেশের জনগণের উপর ইজরায়েলি দখলদারিত্ব অবিলম্বে শেষ করতে হবে। একইসঙ্গে সংগ্রামের পদ্ধতি হিসাবে ফিলিস্তিনিদেরও সন্ত্রাসবাদের পথ ছাড়তে হবে।
বর্তমান ঘটনার আলোকে, একটি স্পষ্ট প্রেক্ষাপট স্থাপন করা অপরিহার্য। কোনও বিষয়কে তার প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করা আসলে সবটা ঘেঁটে দেওয়ার এক দুর্দান্ত অজুহাত। একইভাবে, একটি ঘটনাকে এর প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করাও ততটাই বিপজ্জনক। ১৯৩৬ সালে, ইহুদি দার্শনিক মার্টিন বিউবর মহাত্মা গান্ধীর কাছে ইহুদিবাদ এবং ইহুদিদের তাদের পৈতৃক জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার এবং পুনর্বাসনের অধিকারের বিষয়ে একটি বিস্তারিত চিঠি লিখেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী সেই চিঠির উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাননি। এই চিঠিটি গান্ধীর কাছে এসে পৌঁছনোর কিছুকাল পরেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। গান্ধী আগে লিখেছিলেন, ইহুদিদের উচিত অহিংস পথে হাঁটা। হিংসার পথে গিয়ে আত্মরক্ষা না করে বরং নিজেদের নাৎসিদের হাতে মরতে দেওয়াই ভালো। গান্ধী ইহুদিদের উপর নাৎসিদের আক্রমণ সম্পর্কে এমন কথা লেখার আগে অবশ্য ভয়াবহ হলোকাস্ট দেখেছেন তিনি। বিউবারের কাছে মহাত্মা গান্ধী চিরকালই ছিলেন এক প্রিয় পথপ্রদর্শক এবং অনুপ্রেরণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং ষাট লক্ষ ইহুদির মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে, ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ঠিক যেভাবে ঔপনিবেশিক দেশগুলি প্রভুত্বের জন্যই তৈরি হয়েছিল। হিব্রু বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট) এবং খ্রিস্টান বাইবেলে (নিউ টেস্টামেন্ট) মুসা, নবী এবং খ্রিস্টের দেশ বিভিন্নভাবে কেনান, কিংডম অব জুডিয়া এবং কিংডম অব ইজরায়েল নামে পরিচিত ছিল।
আরও পড়ুন- থিয়েটার করতেন চুটিয়ে, স্ত্রী-শিশুদের খুন করে ইজরায়েল! হামাসের মাস্টারমাইন্ড দেইফ এক রহস্য
যুদ্ধ চলাকালীন এবং এর পরেও মার্টিন বিউবার মনে করতেন, একটি আলাদা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সমগ্র প্যালেস্তাইনের উচিত ইহুদি ও আরবদের একটি যৌথ ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক দ্বি-জাতীয় প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠা। সেই সময়, অনেক ইহুদি বা আরব এমন ধারণাকে মেনে নিতে পারেননি। ফলত প্যালেস্তাইনকে দু'টি রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়েছিল, একটি ইহুদি এবং একটি আরব। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে এই বিষয়টির অনুমোদন দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো, ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হচ্ছে সেই সময়। এই দুই দেশ প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েলের কাছে দেশভাগের সমস্যা সমাধানের আদর্শ হয়ে ওঠে। তৎকালীন ইহুদি সরকার জাতিসংঘের এই বিভাজনের প্রস্তাব মেনে নেয়, কিন্তু আরব পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের 'স্বাধীনতার যুদ্ধ' বা ফিলিস্তিনিরা যাকে বলে 'নাকভা', শেষ হওয়ার পরও যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা লেগেইছিল ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। যুদ্ধের ফলে বিপুল সংখ্যক প্যালেস্তিনিয় মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যান এবং এখনও হচ্ছেন।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই এত যুদ্ধের পরও কি ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের জনগণের মধ্যে শান্তি চুক্তি হতে পারে? বিপুল সংখ্যক আরব এবং মুসলিম দেশ ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেছে এবং আরও অনেকগুলি দেশই সেই পথে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান ইয়াসির আরাফাত ইজরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই পিএলও-কে প্যালেস্তাইনের জনগণের এক বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। পিএলও ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই সময়ে ইজরায়েলের পাশাপাশি প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র তৈরির আশা ফের জেগে ওঠে। বহু ইজরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি এই চুক্তিতে আশার আলো খুঁজে পান। তবে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর, এক নতুন প্যালেস্তিনিয় উগ্র ইসলামপন্থী সংগঠনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে পিএলও। হামাসের জন্ম হয় তখনই। পিএলওর শাসন থেকে গাজা উপত্যকা চলে যায় হামাসের দখলে। হামাসের ভিত্তি সনদে সাফ লেখা আছে, প্যালেস্তাইন মুসলিম ভূমি এবং তাই কোনও ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকতে দেওয়া যাবে না। হামাস ইজরায়েলের সঙ্গে পিএলও-র শান্তি চুক্তিতে সই করতেও অস্বীকার করে। তারপর থেকেই সশস্ত্র হামলা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে হামাস। গাজার হামাস সরকার প্রধানত অন্যান্য মৌলবাদী মুসলিম দেশ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ইরানের ব্যাপক সমর্থন পায়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের এই সন্ত্রাসবাদী হামলাকে ইজরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম হিসেবে দেখা একেবারেই উচিত নয়। এটি ইজরায়েলে হামাসের সন্ত্রাসবাদী অনুপ্রবেশ ও হামলা। প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষ যথাযথ কারণেই হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। স্বাধীনতার আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিরোধ করার অধিকার সকলের আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু নারীদের ধর্ষণ করার, বৃদ্ধাদের অপহরণ করার, মা, বাবা এবং তাদের ৩টি ছোট বাচ্চাকে হত্যা করার, নাচের কনসার্টে আসা নিরীহ দর্শকদের গুলি করে খুন করার এবং শিশুদের অপহরণ করার কোনও অধিকার কারও নেই। শহরজুড়ে সহস্রাধিক নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা করার কোনও অধিকার কারও নেই। হামাস আসলে আইএসআইএসের যুদ্ধপুতুল, প্যালেস্তাইনের অধিকার রক্ষার 'মসিহা' নয়। হ্যাঁ, অবশ্যই অধিকৃত অঞ্চলে প্যালেস্তাইনের মানুষদের উপর ইজরায়েলের হিংসাত্মক দমন-পীড়নও একইভাবে নিন্দনীয়, কিন্তু ৭ অক্টোবরের এই ঘটনার পর সেই নৈতিক সংবেদনশীলতাও যেন ভেঙে গেছে।
আরও পড়ুন- পবিত্র দিনেই কেন খুন ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ? কারা এই হামাস, কী-ই বা তাদের লক্ষ্য?
মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে আমরা শিখেছি, মানবতার উপর হামলা, মানুষের উপর নৃশংস হামলাকে কখনই প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসাবে ভাবা উচিত নয়। সবসময়ই আমাদের আক্রমণের নির্দিষ্ট কারণ এবং এর পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। কারণ যাই হোক না কেন, অন্য কোনও দেশ, দল বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাই হোক না কেন, লড়াইয়ের উপায়ই বলে দেয় যোদ্ধা সঠিক নাকি ভুল। যোদ্ধা আসলে সত্যিকারের বিরোধী-বিদ্রোহী নাকি সে তলে তলে ফ্যাসিবাদকেই পুষে রাখছে। আমরা, যারা শান্তি খুঁজছি, অর্থাৎ দুই জনগণের জন্য দু'টি রাষ্ট্র চাইছি তাদের অবশ্যই হামাসকে প্রতিহত করতে হবে। হামাসকে যারা অন্ন জোগায়, অর্থ জোগায় তাদের হারাতে হবে। আমরা যারা শান্তি চাই, গণতন্ত্র চাই, তাদের অবশ্যই ইজরায়েলের ডানপন্থী, মৌলবাদী এবং নিজেকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর ভাবা সরকারের দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে।
দেশের মুক্তি আর সন্ত্রাসবাদ- আশ্চর্যজনকভাবে সহাবস্থান করে। যারা বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম করছে তাদের অবশ্যই সংগ্রামের সময় বিপ্লবের মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সন্ত্রাসবাদ আসলে তো ফ্যাসিবাদ এবং ছদ্ম-ধর্মীয় মৌলবাদের পছন্দের অস্ত্র। সন্ত্রাস চিরকালই জাতীয় মুক্তি ও বিপ্লবের শত্রু। আমরা যারা ফিলিস্তিনি জনগণের নিজস্ব সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারকে সমর্থন করি, যারা চাই ইজরায়েলের সার্বভৌম রাষ্ট্রের পাশেই গড়ে উঠুক স্বাধীন প্যালেস্তাইন, তাদের অবশ্যই দ্ব্যর্থহীনভাবে এই সন্ত্রাসের নিন্দা করতে হবে, সন্ত্রাসকে ঘৃণা করতে হবে। দক্ষিণ ইজরায়েলের জনগণের উপর হামাসের আক্রমণ নির্বিচারে হত্যা এবং নিরস্ত্র নাগরিকদের অপহরণের নিন্দা করতে হবে। সন্ত্রাস থামুক, শান্তি বিরাজ করুক চিরকাল।
লেখক হিউন মার্গুলিস একজন গবেষক এবং কবি। মার্টিন বিউবারের দর্শন এবং জেন বৌদ্ধধর্মের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন তিনি।