জংলা পাহাড়ে অধিষ্ঠিত দেবতা! অবাক করবে জঙ্গলমহলের বিখ্যাত পাহাড় পুজোর ইতিহাস

Jangalmahal Pahar Puja: বহু বছর আগে এলাকায় প্রবল বন্যায় ঘরবাড়ি ,গরামথান বা গ্রাম রক্ষার দেবতা সমস্ত কিছুই ভেসে গিয়েছিল।

প্রকৃতি তো আরাধ্যই। এককালে প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পেয়ে পুজো শুরু করেছিল মানুষ। তারপর কালে কালে প্রকৃতির এমন দুর্দশা ঘটাল সেই মানুষই যে এখন পুজো করতে হচ্ছে প্রকৃতিকে বাঁচাতে। নদী হোক, ক্ষেত হোক, বর্ষণ হোক, পুজো করার রীতি প্রাচীন।  চিন ও জাপানে পাহাড় পুজোর চল রয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। আসলে বৌদ্ধধর্মে পাহাড়ের বিশেষ গুরুত্ব আছেই। ফলে আগ্নেয়গিরি হোক বাসবুজে ঢাকা পাহাড়, মানুষ চিন ও জাপানের মানুষ পাহাড়কে দেবতা জ্ঞানেই পুজো করে। এরাজ্যেও পাহাড় পুজোর রীতি রয়েছে। রীতি প্রচলিত সেই মানুষদের মধ্যেই যাদের কাছে পাহাড় স্রেফ পর্যটন নয়, পাহাড় জীবন, প্রতিকূলতা যাপন। পাহাড় তাঁদের আশ্রয়, রক্ষাকর্তা, রুজি-রুটিও। তাই প্রতিবছর আষাঢ় মাসে পাহাড়পুজো হয় জঙ্গলমহলে।

আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার বেলপাহাড়ির কানাইসোর পাহাড়টিকে পুজো করা হয়। হাজার হাজার মানুষ সেই পুজো দেখতে ভিড় করেন। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি ও ঝাড়খণ্ডের সীমান্তবর্তী এলাকায় কানাইসোর পাহাড়টি অবস্থিত। আষাঢ়ের তৃতীয় শনিবার থেকে তিন ধরে মেলাও চলে এখানে। পাহাড় পুজোয় শুধু এই বাংলা নয়, সীমান্তবর্তী ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশার মানুষও যোগ দেন।

আরও পড়ুন- মিশর নয়! ২৫,০০০ বছর ধরে এই পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বিশ্বের প্রাচীনতম পিরামিড?

সবুজে ঘেরা জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রামে এক প্রান্তে রয়েছে একাধিক ছোট বড় পাহাড়। বেশ কিছু বছর যাবৎ বাঙালির অন্যতম পছন্দের 'উইকেন্ড ডেস্টিনেশন' হয়ে উঠেছে ঝাড়গ্রাম। পাহাড় পুজোকে কেন্দ্র করেও পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে এই এলাকায়। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায় গাড়রাসিনি, খড়িডুংরি সহ যে সমস্ত পাহাড় পুজো অনুষ্ঠিত হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাহাড় পুজো কানাইসোর পাহাড় পুজোটিই। স্থানীয় সূত্র বলছে, কানাইসোর পাহাড় পুজো বহু প্রাচীন। মূলত এখানকার আদি বাসিন্দারা চাষবাসের আগে প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করতে এই পাহাড়টির পুজো করে থাকেন। বিশ্বাস, পাহাড় পুজো করলে চাষ ভালো হবে। অতিবৃষ্টিতে কেউ বানভাসি হবে না। হড়পা বান হবে না। তাই চাষ শুরু করার আগে কৃষিজীবি মানুষ পাহাড়ে পুজো দেন।

আরও পড়ুন- সস্তায় বিশ্বদর্শন! এক যাত্রাতেই মিটবে পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্রের স্বাদ

বহু বছর আগে এলাকায় প্রবল বন্যায় ঘরবাড়ি ,গরামথান বা গ্রাম রক্ষার দেবতা সমস্ত কিছুই ভেসে গিয়েছিল। পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী ঢেঙাম গ্রামের বাসিন্দারা সেই সময় কাছের অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে সভা করে গ্রাম রক্ষার দেবতাকে এই পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহু প্রাচীন সময় থেকেই এই পাহাড়ে ঢেঙাম গ্রামের মাহালি সম্প্রদায় পুজারি হিসেবে রয়েছেন। অন্যান্য গরামথানের মতো পোড়া মাটির হাতি, ঘোড়ার মূর্তি উপবিষ্ট করে পুজো করা হয়। পুজোয় একাধিক উপাচারও মানা হয়।। পাহাড় পুজোর মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পাশাপাশি সমস্ত রকমের বাদ্যযন্ত্র ও কৃষি কাজের নানান সামগ্রীও পাওয়া যায়।

প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করতে শুরু হয়েছিল এই পুজো, তবে পরম্পরা মেনে প্রতিবছর বৃষ্টির শুরুতে বেশ আড়ম্বর সহকারে এই পুজো এখন এলাকার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ এই পাহাড়ি এলাকায় সর্বশ্রেষ্ঠ পরব এটিই। দেবতাজ্ঞানে পাহাড়কে পুজো করে আসলে যে বিশ্বাসের গাথা তৈরি হয়, তা কিছুটা হলেও মানুষেরই আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়ে রাখে প্রকৃতিকে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষ স্বাভাবিক কারণেই রক্ষা পায় এখন, তবে বিশ্বাসে মানুষের চেয়েও বেশি রক্ষা পায় এই জংলি পাহাড়।

More Articles