'সাবানের বিজ্ঞাপনে নগ্ন হতে পারো, আমার ছবিতে পারবে না!' নায়িকাকে বলেছিলেন গোদার

Jean-Luc Godard: জঁ লুক গোদারের জীবন কম নাটকীয় নয়।

তিনি আধুনিক সিনেমার রাজপুত্র। ফরাসি নবতরঙ্গর নায়ক। ১৩ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন জঁ লুক গোদার। সুইজ্যারল্যান্ডে নিজের বাসভবনে অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গোদার। এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন! নিজের সিনেমা কেরিয়ারে গোদার চিরকাল ব্যাকরণ ভেঙেছেন। কলম ও ক্যামেরাকে মিলিয়ে দিয়েছেন নিজের ক্যারিশমায়। জীবনের প্রান্তবেলায় এসেও ব্যতিক্রম হিসেবে থেকে গেলেন গোদার। তাঁর মৃত্যু যেন তাঁরই নিজের পরিচালনা করা কোনও সিনেমার দৃশ্যের মতো আকস্মিক একটা জাম্প কাট।

গোদার ও আনা কারিনা
গোদারের সিনেমার মতোই নাটকীয় তাঁর জীবন। বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতে গিয়েই তাঁর আলাপ আনা কারিনার সঙ্গে। আলাপ হওয়ার পরে একদিন গোদার আনা কারিনাকে তাঁর সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। গোদারের শর্ত ছিল, দৃশ্যের প্রয়োজনে নগ্ন হতে হবে আনা কারিনাকে। সেই শর্ত শুনে গোদারের প্রস্তাব নাকচ করে দেন আনা কারিনা। পরবর্তীকালে এক ইন্টারভিউতে আনা কারিনা বলছেন, জেদি গোদার সেদিন শ্লেষের সঙ্গেই আমাকে বলেছিলেন, 'সাবান কোম্পানির বিজ্ঞাপনে নগ্ন হতে পারবে, আর আমার ছবির ক্ষেত্রে পারবে না!'

godard anna karina

জঁ লুক গোদার ও আনা কারিনা

এরপর সেই আনা কারিনা-ই হয়ে উঠবেন ফরাসি নবতরঙ্গর নতুন আবিষ্কার। আনা কারিনা পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমি যখন গোদারের সঙ্গে থাকতে শুরু করি, মাঝে মধ্যেই এমন হতো উনি সিগারেট কিনতে যাবেন বলে বেরোলেন, তারপর তিন সপ্তাহ হলো ফিরলেন না। এই তিন সপ্তাহে উনি হয়তো আমেরিকায় গিয়ে উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গে দেখা করে এলেন বা বার্গম্যানের সঙ্গে দেখা করে এলেন।'

আরও পড়ুন: সিনেমা বানাতে লাগে কেবল মহিলা এবং বন্দুক, কেন একথা বলেছিলেন জঁ লুক গোদার

১৯৬৮-র ফ্রান্স
১৯৬৮ সালের মে মাসে ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল প্যারিস। শহরের চারদিকে দাঙ্গা, অশান্তি। ছাত্রদের দাবি, প্যারিসের ডানপন্থী সরকারের পতন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমাজতন্ত্র। ছাত্রদের পাশে দাঁড়ালেন গোদার। মে মাসেই হওয়ার কথা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ওই অস্থির সময়ে ফেস্টিভ্যাল বাতিল করার দাবি তুললেন গোদার, ত্রুফো, ক্লদ শ্যব্রোল-সহ একাধিক পরিচালক। সেই বছর ফেস্টিভ্যাল শুরু হওয়ার কথা ১০ মে। প্রথম থেকেই গোদার এবং ত্রুফো অনড়। যে-কোনও মূল্যেই এই অশান্ত সময়ে বন্ধ করতেই হবে কান চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসব বন্ধ করার ডাক দিলেও তাতে মাথা নোয়ায়নি কান কর্তৃপক্ষ।  সেইবার কান চলচ্চিত্র উৎসবে অন্যতম প্রধান অতিথি রোমান পোলানস্কি। ইতিমধ্যেই গোদার, ত্রুফো এবং ক্লদ লেলুচ- তিনজনে মিলে ফেস্টিভ্যালের মধ্য থেকেই ফেস্টিভ্যাল লন্ডভন্ড করার পরিকল্পনা করেছেন। এরকমই এক তর্কাতর্কির মাঝে মেজাজ হারিয়ে গোদার ফেস্টিভ্যালের মধ্যে দাঁড়িয়েই ঘোষণা করলেন, 'আমরা ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছি আর আপনারা এখানে সিনেমায় কোন শট কীভাবে তোলা হয়, তাই নিয়ে আলোচনা করছেন!'

Godard in Cannes

কান চলচ্চিত্র উৎসবে জঁ লুক গোদার

কার্লোস সুয়েরা-র 'পিপারমিন্ট ফ্র‍্যাপ' ছবির স্ক্রিনিং চলাকালীন ফেস্টিভ্যাল বন্ধ করতে মরিয়া গোদার ও ত্রুফো স্ক্রিনের পর্দা ছিঁড়ে দিয়েছিলেন। সেই বছর ফেস্টিভ্যাল শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগেই ফেস্টিভ্যাল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। পরের বছর থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবে নতুন একটি বিভাগ সংযুক্ত হয়। সেখানে বিপ্লবী ভাবনার ছবিকে স্ক্রিনিং-এর সুযোগ দেওয়া হয়।

'হেইল মেরি' ও গোদার
১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জঁ লুক গোদারের 'হেইল মেরি' ছবিটি নিয়েও খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। 'হেইল মেরি' ছবিতে মাতা মেরিকে এক ছাত্রী এবং বাস্কেটবলপ্রেমী হিসেবে দেখান গোদার। তাঁর প্রেমিক হয় কলেজ ড্রপআউট। মেরি এবং তাঁর প্রেমিকের যৌন সম্পর্কই হয়ে ওঠে এই ছবির মূল রাজনীতি।

Hail Mary

'হেইল মেরি' ছবির দৃশ্য

এই ছবির জন্য গোদারের সমালোচনায় মুখর হন স্বয়ং পোপ দ্বিতীয় জন পল। সারা পৃথিবীর খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে গোদারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সমালোচনার ঝড় ওঠে।

অস্কার ফিরিয়ে দেওয়া
২০১০ সালে গোদার-কে সাম্মানিক অস্কারে মনোনীত করে অস্কার কর্তৃপক্ষ। গোদার-কে বলা হয়, আমেরিকায় গিয়ে তাঁকে গ্রহণ করতে হবে সাম্মানিক অস্কার। চিরজীবন আমেরিকার শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গোদার প্রত্যাখ্যান করেন অস্কার। সেই প্রসঙ্গে পরে গোদার বলেছিলেন, 'এই বয়সে এতদূর গিয়ে অস্কার নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার অস্কারে কিছু যায় আসে না।'

More Articles