কেবল যিশু খ্রিস্টই ক্রুশবিদ্ধ হননি, বিশ্বের ভয়ংকর এই শাস্তির পেছনে রয়েছে কোন ইতিহাস?
History of Crucifixion : ক্রুশবিদ্ধের শাস্তি – এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ হয়েছে যিশু খ্রিস্ট আর খ্রিস্ট ধর্মের হাত ধরে।
দীর্ঘ পাথুরে রাস্তার দু’পাশে কাতারে কাতারে জড়ো হয়েছে মানুষ। প্রবল বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন তাঁরা সামনের দিকে। রোমান সৈন্যদের বর্শা আর তরোয়ালের মাঝেই চলেছে একটু লোক। পরনের কাপড় প্রায় খুলে পড়ছে। গোটা শরীর রক্তে ভেজা, জায়গায় জায়গায় চামড়াও ঝুলে পড়েছে। চোখ-মুখ কোটরে ঢুকে পড়েছে যেন। মাথায় কাঁটার মুকুট। গোটা রাস্তা রক্তের দাগে ভেসে যাচ্ছে। ক্লান্ত, রক্তাক্ত মানুষটি বিরাট একটি ক্রুশকাঠ বহন করে নিয়ে চলেছে। পরিশ্রম যেন আরও বেড়ে চলেছে, নিঃশ্বাস পড়ছে সামান্য। একসময় রাস্তায় পড়ে গেলেন তিনি। চারিদিক থেকে তখন দুয়ো উঠতে শুরু করল। ‘কই হে! তুমি নাকি নিজেকে ঈশ্বরের সন্তান বলতে? কোথায় এখন তোমার ঈশ্বর?’ অশ্রাব্য গালাগাল, থুতু আর হাসিতে এলাকা ভরে যাচ্ছে। তার মধ্যেই হাতেগোনা কিছু মানুষ তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছেন। সামনেই গলগথ পাহাড়। জেরুসালেমের নাজারেথ গ্রামের যিশু খ্রিস্টের গন্তব্য সেখানেই।
রুক্ষ, শুস্ক পাথরের ওপরই রাখা হল ক্রুশকাঠ। পাশাপাশি তিনটে কাঠ, তিনজন ‘অপরাধী’। দুজন চোর, ডাকাত, আর সঙ্গে ঈশ্বরের সন্তান বলে দাবি করা যিশু খ্রিস্ট। বয়ে আনা ক্রুশকাঠের ওপর তাঁকে শোয়ানো হল। হাত দুটোকে দু’পাশে পাখির ডানার মতো টানটান করে দেওয়া হল। পা দু’টো জোড়া। তারপর বড়, মোটা পেরেক এনে দুই হাতের কবজিতে গাঁথা আরম্ভ হল। পায়ের দিকেও একই পরিণতি। চিৎকার, আর্তনাদের মধ্যে উঠে দাঁড়াল ক্রুশগুলি। বাকিটা আর নিশ্চয়ই বর্ণনা করতে হবে না। যিশুর ক্রুশবিদ্ধের সেই দৃশ্য, সেই বর্ণনা পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় এখন লোকগাথা। সেই প্রবল যন্ত্রণার কথা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
ক্রুশবিদ্ধের শাস্তি – এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ হয়েছে যিশু খ্রিস্ট আর খ্রিস্ট ধর্মের হাত ধরে। আর ওই ধর্মের প্রতীক হিসেবে যেটি উঠে এসেছে, একটা সময় তার ভয়ে কাঁপত গোটা বিশ্ব। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ক্রুশকাঠ আসলে তাসের দুই পিঠের মতো। যার একদিকে রয়েছে যিশু খ্রিস্ট, ধর্মীয় ধ্বজা। অন্যদিকে রয়েছে নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। বিশ্বের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক, নৃশংস ও ভয়ংকর শাস্তিগুলোর মধ্যে একটি এই ক্রুশবিদ্ধকরণ। কেবল যিশু খ্রিস্ট নয়, তাঁর আগে ও পরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে এই নিয়মে। আর সেই যন্ত্রণার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাসের পাতায়।
আরও পড়ুন : যিশুর জন্মের সময় উপস্থিত ছিলেন এই ভারতীয় রাজা! যে কাহিনি চমকে দেবে আপনাকেও
গবেষকরা ক্রুশবিদ্ধকরণের ইতিহাসকে মূলত দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন। রোমান যুগের আগে এবং পরে। কেন এমন বিভাজন? একটু পরেই বোঝা যাবে। আগে বলা যাক এই শাস্তির পদ্ধতির শুরু কোথায় হয়েছিল? মূলত প্রাচীন সিরিয়া, ব্যাবিলন, পারস্যে ক্রুশবিদ্ধ করে শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতির প্রচলন ছিল। সেটাও প্রায় ৩০০-৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। কিন্তু এখানেও একটু আলাদা গল্প ছিল। দুই হাতে আর পায়ে পেরেকবিদ্ধ করে তিলে তিলে মৃত্যুর পদ্ধতিটা একই ছিল। কিন্তু শুরুর লগ্ন থেকে ক্রুশের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। বড় গাছ কিংবা কাঠের খুঁটি বানিয়ে সেখানে দড়ি দিয়ে ওই মানুষটিকে বাঁধা হতো। তারপরই হাতুরি মেরে পেরেক বসানো হতো।
একদিক থেকে দেখতে গেলে, এই শাস্তি মধ্যপ্রাচ্যে বেশি প্রচলিত ছিল। ইউরোপ তখনও ক্রুশবিদ্ধের কোনও নিদর্শন দেখেনি। সমস্তটা একটু একটু করে বদলাতে আরম্ভ করল আলেকজান্ডারের আমলে। গ্রিসের প্রবাদপ্রতিম এই সম্রাট বেরিয়েছিলেন বিশ্বজয় করতে। সেই সময় পারস্যেও আক্রমণ করেন তিনি। তখনই তিনি প্রাচীন এই ক্রুশবিদ্ধ করে শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতিটি লক্ষ্য করেন। পরে সেটাই গ্রিসে এবং ইউরোপে নিয়ে আসেন।
একটু একটু করে গ্রিস সাম্রাজ্যের সেই ধার কমে যায়। সামনে আসে রোমানরা। তখন তাঁরা কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কেউ হারাতে পারছে না। খ্রিস্টপূর্বাব্দ তৃতীয় শতাব্দী থেকে এই ক্রুশবিদ্ধ করে শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতিটি রোমানদের মনে ধরে। আর তখনই সামনে আসে ক্রুশকাঠ। দুটো বড় কাঠের খুঁটিকে যোগচিহ্নের মতো করে বেঁধে তৈরি হল ক্রুশ। শুধু তাই নয়, একেকসময় ক্রস বা কাটাচিহ্ন আকারেও ক্রুশ তৈরি করা হতো। শাস্তিটা আরেকটু কঠিন, আরও যন্ত্রণাদায়ক হল। তারপর কয়েকশো বছর ধরে রোমানরা এই পদ্ধতিতেই অপরাধী, চোর, ডাকাতদের শাস্তি দিত।
আরও পড়ুন : এখনও লেগে আছে যিশু খ্রিস্টের রক্তের দাগ! শ্রাউড অফ তুরিন কি সত্যিই ইতিহাস, না স্রেফ মিথ?
মূলত কাদের শাস্তি দেওয়া হতো? একটু আগেই সেই কথা বলা হয়েছে। অদ্ভুতভাবে, রোমানরা নিজেদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রুশবিদ্ধকরণকে কখনও ব্যবহার করত না। কারণ মনে করা হতো, এই উপায়ে মৃত্যু সবচেয়ে নিকৃষ্টতম। যারা একেবারে নীচু শ্রেণীর, দাস, প্রতিবাদী মানুষ, রাজনৈতিক শত্রু, সৈন্য, তাঁদের ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হতো। এমনটাই মনোভাব ছিল রোমীয়দের। মূলত তাঁদের হাত ধরেই ক্রুশবিদ্ধের নৃশংসতা বাড়ে।
প্রথম কবে ক্রুশবিদ্ধের প্রথা দেখা যায়? ইতিহাএর নথি ঘাঁটলে উঠে আসবে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের উক্তি। যেখানে তিনি বলেছেন, আথেন্সের বাসিন্দারা পারস্যের এক সেনানায়ককে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরেছিল। সাধারণত গ্রিসরা এই উপায়ে মৃত্যুদণ্ডকে শুভ মনে করত না। কারণ এই মৃত্যু অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। কেমন? ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত একটি লেখায় লন্ডন কিংস কলেজের চিকিৎসক জেরেমি ওয়ার্ড বিস্তারিতভাবে বলেছেন সেই কথা। প্রথমত, দুই হাতের কবজির জায়গায় মোটা দুটো পেরেক আর পা জোড়া লাগিয়ে আরও একটি পেরেক – হাড়, মাংস থেকে শিরা-ধমনি সমস্ত কিছু ফাটিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে স্নায়ুর অবস্থাও ভয়ংকর হয়ে যায়। ওরকমভাবে ঝুলিয়ে রাখার ফলে সম্পূর্ণ চাপটা ওই ক্ষতের ওপর পড়ে। ফলে রক্ত বইতেই থাকে। খানিকক্ষণ পর নিজের হাত আর পা যে রয়েছে, সেটাই বুঝতে পারবে না ভুক্তভোগী। স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অবশ হয়ে যায় শরীর।
পাশাপাশি বুকের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। যেহেতু সমানে রক্ত পড়ে যাচ্ছে, তাই একসময় ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে মানুষ। হার্ট আর ফুসফুসও কাজ করা একটু একটু করে বন্ধ করে দেয়। একেবারে নয়, তিলে তিলে মৃত্যু নেমে আসে শরীরে। ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট, প্রথম রোমান ক্যাথলিক সম্রাট ক্রুশবিদ্ধের এই প্রথা বন্ধ না করলে হয়তো আরও কয়েকশো বছর চলত।
কেবল যিশু খ্রিস্ট নয়, তাঁর অনেক শিষ্যকেও ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। একটা সময় রোমানরা একের পর এক খ্রিস্টানকে এই উপায়েই হত্যা করেছে। আজ সেটিই খ্রিস্ট ধর্মের প্রতীক। সেখানে লেগে আছে ধর্মের পবিত্রতা, মোমবাতির আলো। আর তার নীচে জমে থাকা রক্তের সারি? তাকেও স্মরণে রাখতে হবে!