দুঁদে গোয়েন্দা না বিচারপতি! অভিজিতের নতুন স্ট্র‍্যাটেজি হার মানাবে ফেলুদাকে

Abhijit Gangopadhyay: অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়-ইতিহাস, তাঁর বিচার-বুদ্ধির যাবতীয় তথ্যতালাশের সূচনা পর্বেই ফের উঠে এসেছে, তাঁর একটি রায় এবং পর্যবেক্ষণের সাম্প্রতিক ফলের কথাই।

'রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি, বেকারদের যন্ত্রণা বুঝি। তাঁদের কান্নায় বালিশ ভেজার কথা জানি!'

সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে কলকাতা হাইকোর্টের এক বিচারপতির মুখ থেকেই এমন শব্দ শুনেছিল রাজ্য। বঙ্গের জনপ্রিয়তার আকাশে ফের জ্বলে উঠেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। দুর্নীতি আর চাকরি চুরির ঘিরে ঘিরে আলো ফেলেছিলেন তিনিই। তাঁর কথাতেই, সেই লড়াইয়ে এখনও বর্তমান অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Ganguly)।

যিনি বিচারপতি (Justice Abhijit Gangopadhyay) হিসেবে ঠিক যতটা বিবর্তিত, তুলনায় তাঁর বিচারের আঙ্গিক, বৃহত্তর অর্থে তাঁর দেওয়া একের পর এক রায় সর্বাধিক বিরচিত!

আর এই পর্যবেক্ষণ বা রায়ই তাঁকে নিয়ে গিয়েছে বঙ্গের বেকার সমাজ বা সোশ্যাল দুনিয়ার একটা বড় অংশের কাছে নায়কের আসনে! যদিও এই ভণিতা বা অভিজিৎ বন্দনা আমরা করছি না, বা এ কথা আমরা বলছি না, বলছেন বঞ্চিত-লাঞ্ছিত, রাজ্যের তথাকথিত শিক্ষিত বেকাররাই!

আরও পড়ুন: অন্ধ নয় আইন! দাদাগিরি থামাতে এবার যা করলেন বিচারপতি অভিজিৎ

কেন? অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়-ইতিহাস, তাঁর বিচার-বুদ্ধির যাবতীয় তথ্যতালাশের সূচনা পর্বেই ফের উঠে এসেছে, তাঁর একটি রায় এবং পর্যবেক্ষণের সাম্প্রতিক ফলের কথাই। কেন, কী ঘটল এদিন?

ঘটনাটি ঠিক কী, তার বলার আগে খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। টেট দুর্নীতির (TET Scam) পাহাড়ে হঠাৎ দুর্নীতির (Corruption) অভিযোগের তুষারপাত ঘটায় মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ! চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন আব্দুল হামিদ নামে এক চাকরিপ্রার্থী। তাঁর দাবি ছিল, তাঁর দেওয়া পরীক্ষার উত্তরপত্রে বদল ঘটেছে। বিস্ফোরক দাবি করে তিনি বলেন, তথ্য জানার অধিকার আইনে তিনি জানতে পেরেছেন যে, তাঁর উত্তরপত্র অর্থাৎ ওএমআর শীটে অন্য কেউ কলম চালিয়েছেন। তিনি যে উত্তর দিয়েছেন, সেটা ছাড়াও অন্য উত্তর করে ভুল হয়েছে, -এই দাবিতে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। এই মর্মে কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা করেন আব্দুল। জমা দেন তাঁর উত্তর লেখার সেই পেন-ও।

২৬ অগাস্ট, ২০২২। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, ওই উত্তরপত্রের ফরেন্সিক পরীক্ষা করতে হবে। রায়ের দিন থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে কেন্দ্রীয় ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে (Central Forensic Science Laboratory) পাঠাতে হবে সমস্ত কিছু, এই কাজ করবে মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ (West Bengal Madrasah Board) । আর ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দেবে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি (CFSL) । এই নির্দেশও দেন বিচারপতি (Calcutta High Court) ।

২০১৪ সালের টেট নিয়ে মাত্রাছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ, একাধিক মামলা এবং উত্তরপত্র নষ্টের গুরুতর অভিযোগের মধ্যেই ঝড় তোলে এই মামলাও। ফের শিরোনামে আসেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।

৯ নভেম্বর, ২০২২। ওই 'কালিবদল' সংক্রান্ত একাধিক কার্যকলাপের পর ফের এদিন শুনানি হয় এর। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চে (Single Benche) শুনানি চলাকালীন জানা যায়, ওই উত্তরপত্রের ফরেন্সিক রিপোর্ট জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা সিএফএসএল। সূত্রের দাবি, ওই রিপোর্টে মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে অতিরিক্ত একটি অপশনে অন্য কালির দাগ থাকার কথা। অর্থাৎ আব্দুল হামিদ যে অভিযোগ করছিলেন এতদিন, প্রাথমিকভাবে তাঁর অভিযোগের ভিত্তি খুঁজে পেতে পারে ফরেনসিক বিভাগ! আর এই প্রসঙ্গে ফের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের অবস্থান জানতে চেয়েছেন তিনি। এর সঙ্গেই পরীক্ষার্থীর ভিডিও ইন্টারভিউ নিতেও বলেছেন বিচারপতি।

আর এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ফের আলোচনায় এসেছেন বিচারপতি। যাঁর একের পর এক রায়, পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষক-নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির (SSC Teacher's Recruitment Scam) বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান, দেশের বিচার ব্যবস্থায় এক অন্য মাত্রাও এনেছেন।

কিন্তু কীভাবে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়?

বরাবরের মেধাবী ছাত্র অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সরকারি চাকরি ছেড়েছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোস না করে। হঠাৎ করে বিডিও অফিসের কাজ ছেড়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তারপর বেকারত্বের দিন শুরু। এই অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে একপ্রকার অনিচ্ছা নিয়েই তাঁর আইন পড়তে আসা। হাজরার ল'কলেজের 'ফাঁকিবাজ' সেই ছেলেটিই এখন মহামান্য বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যিনিই ক্রমশ হয়ে উঠেছেন বাংলার এসএসসি অথবা প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীদের ক্রাশ!

বিচারপতির সালতামামি
২০১৯ সাল। সবেমাত্র শেষ হয়েছে লোকসভা নির্বাচন (Loksabha Election)। নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) দ্বৈরথ ছাপিয়ে সবেমাত্র একটু শান্ত হয়েছে বঙ্গ। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ফের বাড়তে শুরু করল বাংলার দুর্নীতির ইতিহাসের আর এক ব্রহ্মাস্ত্র (Brahmastra) ! আগে থেকেই মামলা, বিচার আর অভিযোগের পাত্রে প্রায় নিমজ্জিত শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত কর্তারা তখনও প্রায় খোশ মেজাজে। এদিকে বঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী তখন পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর নেই। ব্রাত্য বসুর বিদায়ে যাঁর প্রভাব ছিল, কলেজ থেকে স্কুল। নিয়োগ থেকে শিক্ষা সেল, সবেতেই। তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা।

এর মধ্যেই মুকুল-বিপর্যের মতো শুভেন্দু-বিপর্যয়ের (Suvendu Adhikari) স্বাদ নিল তৃণমূল। নন্দীগ্রাম (Nandigram) আন্দোলনের অন্যতম মুখ যোগ দিলেন বিজেপি (BJP) শিবিরে। ব্যাস্! মামলায় আটক থাকা নিয়োগ দুর্নীতির বিক্ষোভ আঁচে আঁচড় দিলেন শুভেন্দু। বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পরেও নন্দীগ্রামে হারের কাঁটার মতোই আদালতের লড়াই নামল রাস্তায়! স্কুল সার্ভিস কমিশনের (School Service Commission) নিয়োগে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাস্তায় বসলেন চাকরিপ্রার্থীরা।

কিন্তু কথায় বলে এক রাবণে রক্ষা নেই, সুগ্রীব তাঁর দোসর! ঠিক এভাবেই রাজ্যের ঘাড়ে এবার চেপে বসল প্রাথমিকে দুর্নীতির অভিযোগও। যে কাণ্ড আগে থেকে বিরচিত হলেও আদালতের ভূমিকায় একের পর দুর্নীতির অভিযোগের পারদ এবার চড়ল তরতরিয়ে।

আর এখানেই বিরাট ভূমিকা নিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতার বাসিন্দা, আইনের শাসন আর বিচারকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক মামলায় দিলেন ঐতিহাসিক রায়! শাসকদল তৃণমূল (TMC) থেকে শুরু করে একাংশের আইনজীবীদের বিক্ষোভ, সব সামলে একের পর এক ঝোড়ো ইনিংসে চাকরিপ্রার্থীদের কথা বলতে থাকলেন বিচারপতি। নজিরবিহীনভাবে সর্বকালীন রেকর্ড গড়লেন একটি নিয়োগ দুর্নীতিতে সর্বোচ্চ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েও!

২০২১, নভেম্বর। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক মামলা, যা রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সেই সমস্ত মামলায় রায় দিতে শুরু করেন। যেখানে শুধুমাত্র এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির প্রশ্নেই প্রায় ৭ বার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি।

৩ মার্চ, ২০২২। এসএসসি শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। দ্রুত তদন্তের রিপোর্ট পেশের কথাও বলেন বিচারপতি।

১৮ মে, ২০২২। সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ই বহাল রাখে ডিভিশন বেঞ্চ। ডিভিশন বেঞ্চও বাগ কমিটির রিপোর্টকেই মান্যতা দেয়। রায়ে জানানো হয়, সিবিআই এই মামলার তদন্ত করবে। সেদিন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যে রায় দিয়েছিলেন, তাই-ই বহাল রাখা হয়। সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে হস্তক্ষেপ করেনি ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি আনন্দকুমার মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে বলেন, আদালতের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে কোনও ভুল নেই।

২৩ মে, ২০২২। বিস্ফোরক অভিযোগের তদন্তের ভিত্তিতে বেনজির ঘটনা ঘটান বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর (Paresh Adhikari) মেয়েকে বরখাস্ত করেন স্কুল শিক্ষিকার পদ থেকে। নির্দেশ দেন, কোচবিহারের ওই একই স্কুলে নিয়োগ করতে হবে মামলাকারী ববিতা সরকারকে (Babita Sarkar) । দিতে হবে মাইনে ফেরৎ। ঐতিহাসিক এই নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতির কঙ্কাল আলগা হয় সরকারের। যেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি হাতানোর অভিযোগ ছিল মন্ত্রী-কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর (Ankita Adhikari) বিরুদ্ধে।

এসএসসি গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি পর্ব ছাড়িয়ে তখন তাঁর এজলাসে উঠেছে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাও। এখানেও একের পর এক বিস্ফোরক নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।

১৩ জুন, ২০২২। ২৬৯ জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেন তিনি। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এঁরা প্রত্যেকে অতিরিক্ত এক নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছেন।

যদিও চলতি মাসেই দেশের শীর্ষ আদালত এই ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কোনও রায় না দিলেও ওই ২৬৯ জনকে ফের কাজে বহালের নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ।

এসএসসি গ্রুপ ডি, সি
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গেই উঠে আসে অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের দুর্নীতির কথা। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন এই দুর্নীতিও তদন্ত করবে সিবিআই।

'মাদ্রাসা পর্ষদ এবং কালি-বদল'
এক পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র বদলের অভিযোগের মামলার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে ভার দেন তিনি। এই ক্ষেত্রে বিচারপতি ওই উত্তরপত্রের ফরেনসিক পরীক্ষার কথা বলেন। যার রিপোর্ট নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে সম্প্রতি।

টেট-দুর্নীতি
শুধুমাত্র এসএসসি নয়, প্রাথমিকের অবস্থাও খারাপ। অভিযোগ এমন অভিযোগে ওঠে আগে থেকেই। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই একের পর অভিযোগে বিদ্ধ হয় রাজ্য। হস্তক্ষেপ করে আদালত। সেখানেও জড়িয়ে রয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

উল্লেখ্য, ২০১৪ এর প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে টেট পরীক্ষা হয়েছিল এবং ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় মেধাতালিকা। ২০১৭ সালে অতিরিক্ত একটি মেধাতালিকাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু, দ্বিতীয় তালিকাতে অনিয়ম হয়েছে অভিযোগ তুলে কলকাতা আদালতে মামলা দায়ের হয়। সেই মামলার প্রেক্ষিতে ২৬৯ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এ বিষয়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল টেটে ২৬৯ জন চাকরিপ্রাপককে অতিরিক্ত এক নম্বরের কারণ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ স্পষ্ট করতে পারেনি। এই বিষয়ে কোনও নথিও সেভাবে দেওয়া হয়নি। এরপরেই ২৬৯ শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশের উপরও ১৮ অক্টোবর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court of India) । তবে সিবিআই (CBI) তদন্তে কোনও বাধা দেয়নি শীর্ষ আদালত। যদিও সিবিআইকে বলা হয়েছে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে। মূলত, ২০১২, ২০১৪ - এই সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পরীক্ষা হয় ২০১৫ সালে। এবং ২০১৭ সালের প্রাথমিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়েও ওঠে প্রশ্ন।

২৩ জুন, ২০২২। ফের শোরগোল ফেলে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি রায়। আগে তাঁর দেওয়া একটি নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়া হলে সেখানেও খারিজ ওই আবেদন। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণকে মান্যতা দেন ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতিরা।

১৮ জুন, ২০২২। এদিনই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় রায় দেন, এবার থেকে এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত সব মামলার ক্ষেত্রেই, তদন্ত করবে সিবিআই।

হাজিরা-কথা
২০২১ এর নভেম্বর থেকে এই অবধি। বাংলা দেখেছে রাজনৈতিক নেতাদের সিবিআইয়ের কাছে ছোটার চিত্র। যেখানেও হাত রয়েছে সেই বিচারপতির। যেখানে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের কড়া পদক্ষেপে ছাপ রেখেছেন তিনি। একের পর নির্দেশে সময় বেঁধে দিয়েছেন হাজিরার। নিজাম প্যালেসে হাজির হয়েছেন বাঘা বাঘা আধিকারিক নেতা মন্ত্রীরা। আর এখানেই ফের নাম এসেছে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের।

পার্থ-মানিক কথা
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার দুই পর্বের দুই 'মাস্টারমাইন্ড' হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন, রাজ্যের প্রভাবশালী নেতা, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee) । সঙ্গে তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় (Arpita Mukherjee) । ২২ জুলাই মধ্যরাতে ইডি-র (Enforcement Directorate) হানা এবং অর্পিতার বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা ঘুম কেড়ে নিয়েছিল রাজ্যের। শাসকদল, সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল এই ঘটনা। শিক্ষক নিয়োগ, সামগ্রিকভাবে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগের পরশ পাথরে দাগ কেটেছিল এই ঘটনা। এখানেও নেপথ্যে সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশেই তদন্ত করছিল কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো।

এর আগে এসএসসির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, প্রাক্তন যুগ্ম-সচিবের গ্রেফতার। পরে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের গ্রেফতারির পথ প্রশস্ত করে আর এক গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়।

কয়েকদিন জল্পনা আর টানাপড়েন সৃষ্টি করেও গারদে বন্দি হন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা বর্তমানের তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য। যে মানিককে ঘিরেও আদালতে উঠেছিল প্রশ্ন। মানিকের সম্পত্তির পরিমাণ থেকে শুরু করে প্রাথমিকের নিয়োগ দুর্নীতি, সবক্ষেত্রেই কড়া নজর রাখছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বারবার শীর্ষ আদালতে গিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি মানিকের। রক্ষাকবচ আসেনি সেই অর্থে। শুধু কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিতের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি পদ হারানোর বিষয়টি বিবেচ্য করেছিল দেশের শীর্ষ আদালত।

নজির সৃষ্টি করে, দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্যকেও।

বিচার-মন্তব্য
এর শেষ দেখে ছাড়ব! যদি কেউ মনে করেন পার পেয়ে যাবেন, ভুল ভাবছেন। আমাকে ভয় দেখিয়ে রুখে দেওয়া যাবে না। তদন্তে আশা দেখছি না। কেউ যদি মনে করেন বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েও পার পাবেন, ভুল ভাবছেন। লড়াই চালিয়ে যাব। এত দুর্নীতি ভাবতেই পারি না!

ওপরের এই সমস্ত কথাগুলোই কোনও না কোনও সময়ে বলেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কখনও এক একটি মামলার শুনানি চলাকালীন। কখনও তাঁর একমাত্র টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে। যে মন্তব্যের ক্রেজ ছড়িয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ৬০০ দিনের বেশি সময় ধরে ন্যায্য চাকরির দাবিতে কলকাতার রাস্তায় ধর্নায় বসাদের কাছে অভিজিতের এই মন্তব্য হয়ে উঠেছিল হাতিয়ার। একের পর এক টুকরো টুকরো বাক্যবাণ, বিচারপতিকে নামিয়ে এনেছিল রাজপথে। আনুমানিক ১০০০ কোটির দুর্নীতির অভিযোগ আর শিক্ষার মেরুদন্ড ভাঙার অপ্রয়োজনীয় খেলায় তিনি হয়ে উঠেছেন সারথী! মানুষের জন্য, জনতার বিচারপতি হয়ে উঠেছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়! আর ঠিক এই পরিস্থিতিতেই তাঁর রায়ে তরতর এগিয়ে গিয়েছে নিয়োগ দুর্নীতির মামলার গাড়ি। যদিও সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ রেখেছিলেন স্বয়ং বিচারপতি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনিই তাঁর মন্তব্যের আলোকে বিচ্ছুরিত হয়েছেন বারবার।

এদিন অর্থাৎ ৯ নভেম্বর, ২০২২ এ-ও মন্তব্যে আলোচনা বাড়িয়েছেন সেই তিনিই। প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় পর্ষদের উপর ফের ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিচারপতি। 'প্রয়োজন হলে পরীক্ষা বন্ধ করে দেব,' এজলাসে বসে এমন মন্তব্যও করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।

বঙ্গের দুর্নীতি-ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র হল সারদা গোষ্ঠী এবং এসএসসি-টেট। যার দুর্নীতির রচনা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন! এমনই দাবি করেন সংশ্লিষ্ট মহলের বিশেষজ্ঞরা। আর এখানেই শিক্ষক নিয়োগের কু-দিক দেখেছে বাংলা। ২০১৪-র বিজ্ঞপ্তি, ২০১৫ সালের টেট পরীক্ষা থেকে শুরু করে ২০১৭ -য় ফের নিয়োগ। চাকরি বাতিল থেকে একাদশ-দ্বাদশে নিয়োগ দুর্নীতি। ববিতা থেকে সোমা। সব ক্ষেত্রেই নাম জড়িয়েছে এই বিচারপতির। বারবার আক্রান্ত হওয়া চাকরিপ্রার্থীদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন তিনি। প্রথা তৈরি করে নিজেই নিজের ট্যাবু ভেঙেছেন তিনি। যেখানে দুর্নীতি আর কষ্টের দিনযাপনের কারিগর রঞ্জনদের তাড়িয়ে যেন নন্দিনীর রঞ্জনের আগমন ঘটাতে তৎপর হয়েছেন তিনিও। যেন 'রক্তকরবী'র বিশুর গানের মধ্যেই,  কিশোরের কাঙ্খিত বিল্পবের রঙের করবীর রূপকে যেন আইন-আদালতেই রচনা করেছেন, এক অযাচিত মহাকাব্য। যা বিচার বা বিচারকের ইতিহাসে নজিরবিহীন না হলে কী? এই প্রশ্ন রইল আপনাদের কাছেই!

More Articles