'অপা'র পর এবার জ্যোতিপ্রিয়ের 'দোতারা'! কেন চোরেদের স্বর্গরাজ্য কবিগুরুর শান্তিনিকেতন?

Jyotipriya Mallick Bolpur Dotara : কবিগুরুর বোলপুর এখন কালো টাকাকে বিলাসে পরিণত করার এক 'হটস্পট'। ঘুষের টাকা, চুরির টাকা, জালিয়াতির টাকা উড়ে বেরাচ্ছে রাবীন্দ্রিক হাওয়ায়।

কবিগুরুকে বাঙালি বুকে রেখেছে। এই বাঙালির মধ্যে কিন্তু কোনও শ্রেণিভেদ নেই। বেকার প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে শুরু করে বাংলা দাপানো কবি, দেশ কাঁপানো নেতা, মধ্যবিত্ত করণিক... সকলেই প্রায় তীর্থের মতো একবার না একবার শান্তিনিকেতন ভ্রমণে যান। কবিগুরুর জায়গা, সাহিত্য, শিক্ষা, চেতনার পীঠস্থান। সেখানে জীবদ্দশায় একবারও পায়ের চিহ্ন দেননি এমন বাঙালি নেই প্রায়। শুধু তো পায়ের চিহ্ন দিলে হবে না। সোনাঝুরির গহিনকে পেতে হবে, সপ্তাহান্তে দাপাতে হবে কোপাইয়ের ধারে, তবেই না রবিঠাকুরকে একেবারে প্রাণে মনে মেখে নেওয়া যাবে! এই মাখামাখিকে পাকাপাকি করতে তাই অনেকেই বোলপুরে জমি কেনেন। অবসর কাটানোর ঠিকানা গড়েন। বোলপুর বিত্তশালীদের বাগানবাড়িতে যে ভরে উঠেছে তা শান্তিনিকেতনে নেমে খানিক হাঁটাহাঁটি করলেই বোঝা যাবে। এই বাগানবাড়িগুলি শুধুই কি শখের বাসা? নাকি এই বাগানবাড়ি আসলে কবিগুরুকে সামনে রেখে কালো টাকার এক ব্যাপক উদযাপন? গতবছরই 'অপা' বাড়িটি নিয়ে হইচই হওয়ার পর এবার জ্যোতিপ্রিয়র 'দোতারা' নিয়ে টানাটানি। দুর্নীতিতে জড়ানো মাথাদের কি বোলপুরে বাড়ি থাকাটা অন্যতম আভিজাত্য?

বোলপুরের ফুলডাঙায় বাড়ি গড়েছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থ তৃণমূলের একেবার গোড়ার মানুষ। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, এখন হাজতে। বস্তায় ভরে রাখা কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে তাঁর ও তাঁর বান্ধবী অর্পিতার একাধিক বাড়ি থেকে। বস্তামোড়া কোটি টাকা উদ্ধারের অশ্লীল সেই দৃশ্য এখনও উজ্জ্বল। বোলপুরের বাড়িটার নাম ‘অপা’! ভারী মিষ্টি করে অর্পিতার 'অ' আর পার্থর 'পা' মিলে বাগানবাড়ির নাম রাখা হয়েছিল। কবিগুরু, শান্তিনিকেতন, রাজ্যের শিক্ষা দফতর, শিক্ষামন্ত্রী- সব মিলে খুবই জোরালো 'কম্বিনেশন', বলা বাহুল্য। কম্বিনেশন ঘেঁটে দেয় ইডি। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হতেই অর্পিতা পার্থর সম্পর্ক প্রকাশ্যে আসে। প্রকাশ্যে আসে পার্থ অর্পিতাকে কী কী দিয়েছেন, কী কী দেবেন বলেছেন। গাছগাছালিতে ঘেরা, বিরাট জায়গা নিয়ে তৈরি বিলাসবহুল বাগানবাড়িটিও আসে প্রকাশ্যে।

আরও পড়ুন-২০ ঘণ্টার জেরা-তল্লাশি! জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে ইডির গ্রেফতারি কি সত্যিই ‘ষড়যন্ত্র’?

ইডি জানায়, ‘অপা’ নামক বাগানবাড়িটির মালিক প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। বাড়িটি কীভাবে কেনা হয়েছে তাও জেনে যান মানুষ। কবিগুরুর জনপ্রিয় স্থানে আলো খানিক কেড়ে নেয় 'অপা'। পর্যটকদের কাছে কোপাই, সোনাঝুরি, রবীন্দ্রনাথের বাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান হয়ে ওঠে 'অপা'। ভূমি দফতরের নথি বলছে, বোলপুরের শ্যামবাটি মৌজায় ‘অপা’ অবস্থিত। জমির খতিয়ান নং ১২। মোট জমির পরিমাণ ১০ কাঠারও বেশি। বাড়ির বহর জানলে চমকে যেতে হয়! একতলায় ১ হাজার বর্গফুট এবং দোতলায় ২০০ বর্গফুট থাকার জায়গা। বাকিটা ফাঁকা অংশ। ফাঁকা অংশে বাহারি ফুলের গাছ। অর্পিতা এই সম্পত্তি কেনেন কলকাতার বাসিন্দা দম্পতি শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় কাছ থেকে।

২০১২ সালে এই সম্পত্তির কেনা হয়। তখনকার হিসেবে এই বাড়ির দাম ছিল মাত্র ২০ লক্ষ টাকা! বর্তমান বাজারমূল্য সেই সময়কার দামের অন্তত ৩ গুণ। সোনাঝুরি হাটের পিছনের দিকে থাকা অত্যন্ত মূল্যবান জমিতে এই 'অপা' অবস্থিত। শান্তিনিকেতন-বোলপুর এলাকাতে কেবল 'অপা'ই নয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি, গেস্ট হাউস, ফ্ল্যাট রয়েছে বলেও জানা যায়। বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের নামেও গোটা চারেক জমি বোলপুর চত্বরে ছড়িয়ে রয়েছে বলে জানা যায়।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক-সম্পত্তি সবই কিঞ্চিৎ আড়ালে চলে গেছে। এরই মাঝে নয়া এক দুর্নীতির খোঁজ। ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের আরও এক মন্ত্রী। রেশন দুর্নীতি মামলায় দ্বাদশীর গভীর রাতে গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। প্রায় ২০ ঘণ্টা তল্লাশির পর মন্ত্রীকে গ্রেফতার করার পরেই 'দোতারা' নামে একটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। কবিগুরুর বোলপুরে এই বাড়ি। বাড়ির দাম শুনলে রবিঠাকুরও আঁতকে উঠবেন হয়তো! 'দোতারা' নামের বাড়িটি মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। তিনি খুব একটা যান বলে জানা যায়নি, তবে তাঁর পরিবার হামেশাই থেকেছেন সেই বাড়িতে। 'বালু'-র গ্রেফতারির পরই তাঁর সম্পত্তি, টাকা-পয়সা নিয়ে ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়েছে। হালকা টান মারতেই উঠে এসেছে শান্তিনিকেতনের এই বাড়ির কথা।

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি 'অপা'র মতোই বিলাসবহুল 'দোতারা'। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের এই বাড়ি দেখলে হাঁ হয়ে যেতে হয়। ইডি সূত্রের খবর, আনুমানিক দেড় কোটি টাকা দিয়ে এই বাড়ি কিনেছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তারপর বাড়ির পিছনে আরও প্রায় ৮৫ লাখ টাকা খরচ করেন তিনি। বাড়ির আগাপাছতলা বদলে যায়। তারপর এখনকার হিসেবে এই বাড়ির আনুমানিক বাজার মূল্য ৬ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন- চাল-গমেই কোটি কোটি টাকা নয়ছয়! কীভাবে রেশন দুর্নীতিতে জড়ালেন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়?

বোলপুরে বছর খানেক আগেও জমির দাম কম ছিল। রাজ্যের বহু কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতাদের এমন অনেক বাড়িই রয়েছে সেখানে। কালে কালে বাঙালির 'উইকেন্ড ডেস্টিনেশন' হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন। সোনাঝুরির হাট প্রতিদিন বসতে শুরু করে পর্যটকদের সাধ মেটাতে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বদলে যায়। একাধিক হোটেলের পাশাপাশি বিলাসবহুল রিসর্ট গড়ে উঠতে থাকে। হাতে টাকার জোগান থাকায় রিসর্টের মতো করেই বাড়িও তৈরি করতে থাকেন অনেকে। এই অনেকেই যে রবীন্দ্র ভক্ত এমন নয়। অনেকে হুজুগ ভক্ত, অনেকে সুরাভক্ত, অনেকে ক্ষমতাভক্ত। সকলেই নিজ নিজ প্রয়োজনে ও প্রদর্শনের তাগিদে সংস্কৃতিকে ঢাল করে নেন।

কলকাতায় বিলাসবহুল বাড়ি থাকাটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। বোলপুরে বাড়ি থাকলে একটু কবিগুরু রবিগুরু খেলাও যায়, সংস্কৃতিকে ধরে রাখার, টান বজায় রাখার এক উটকো দায়ও পালন করা যায়। কিন্তু বিলাস আর সামর্থ খুবই শত্তুর, মোটে বনিবনা নেই। বোলপুরে এই মাত্রার বিলাস করতে চাইলে খুব সহজ কথা হচ্ছে, সাদা টাকায় সম্ভব নয়। নিজের কষ্ট করে উপার্জিত টাকায় উইকেন্ডে শান্তিনিকেতন যাওয়া আর সেখানে পাকাপাকি বাসা তৈরি করে ফেলাই বুঝে দেয় কে কোন শ্রেণিতে আছেন। কবিগুরুর বোলপুর এখন কালো টাকাকে বিলাসে পরিণত করার এক 'হটস্পট'। ঘুষের টাকা, চুরির টাকা, জালিয়াতির টাকা উড়ে বেরাচ্ছে রাবীন্দ্রিক হাওয়ায়। সেই হাওয়াই কখনও 'অপা'-কে ঘিরে থাকছে, কখনও টান দিচ্ছে 'দোতারা'-য়। শান্তিনিকেতন গড়তে কতজনের কাছেই তো হাত পেতেছিলেন রবিঠাকুর। অপা বা দোতারা গড়তে আর কেউ হাত পাতেন না। হাত না পেতেও ভোটারদের টাকা ছিনিয়ে নেওয়া যায়। ভোটাররা গুনগুন করে কেবল গাইতেই থাকেন 'আমার যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি।'

More Articles