সাধক কমলাকান্ত থেকে ভবা পাগলা– এখানে আসতেই হবে কালীভক্তদের

কালী-ক্ষেত্র কালনার কালী মাহাত্ম্য দেখে নেওয়া যাক এক ঝলকে!

কালনার মেজকালী: নদিয়া জেলার ফুলিয়া থেকে সাহা পরিবার ব্যাবসার জন্য কালনায় আসার কিছু কাল পরেই কালনায় ‘মেজকালী’-র পূজা প্রচলিত হয়। কিন্তু ঠিক কবে থেকে শুরু হয়, তার সঠিক সন-তারিখ জানা যায় না।এখানে ভুত চতুর্দশীর দিন দেবী মাতার চক্ষুদান হয় এবং তারপর দেবী পাটায় ওঠেন। ওইদিন  কালনাবাসী মন্দির চত্বরে উপস্থিত হন। আগে বংশপরম্পরায় পুরোহিতরা পুজো করতেন, এখন নিয়মের কিছু রদবদল হয়েছে। কথিত আছে, দেবীর জন্য বলিপ্রদত্ত পাঁঠা একবার দড়ি খুলে চলে যায়, তারপর থেকে 'বলি' বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৪-’৫৫ সালে দেবীর মন্দির সংস্কার করা হয়।

 

সেজকালী: উনিশ শতকের প্রথমদিকে কালনায় আসেন নফরচন্দ্র কুন্ডু। এখানে এসে তিনি মায়ের পূজারম্ভ করেন। এই দেবী কালনার ‘সেজকালী’ নামে পরিচিত।ঘোর কৃষ্ণবর্ণা দেবীমূর্তি। রূপের ছটায় চতুর্দিক আলোকিত হয়ে ওঠে। ঐতিহ্য মেনে এখনও বংশানুক্রমিকভাবে বাঘনাপাড়ার 'পাল' পরিবার মায়ের মূর্তি গড়েন। নিয়মানুযায়ী, দেবী ছ'পোয়া। বর্তমানে এলাকাবাসী ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় এই পূজা সম্পন্ন হয়ে চলেছে। পূর্বে নিশিরাতে এই পূজার প্রচলন ছিল, বর্তমানে তার পরিবর্তন ঘটেছে।

আনন্দময়ী মাতার মন্দির: বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ রায় আনুমানিক ১৭৩২-’৩৪ সালের মধ্যে মা আনন্দময়ীর মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এই পূজা মূলত রাজকর্মচারী,যাঁরা ছিলেন শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষিত, অনুমেয়– তাঁদের জন্যই প্রচলিত হয়েছিল। রাজবাড়ি–সংলগ্ন চকবাজার এলাকায় এই পূজা হয়। এখনও রাজবাড়ির পুরোহিতেরাই এই পূজা করেন।

সত্যনাথ কালীবাড়ি: যোগীপাড়ার সত্যনাথ কালীবাড়ি একটি মহাপুণ্যস্থান। এই সত্যনাথ প্রথম কালনায় ১৩২৬ সনে দু’টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, তারপর তাঁর বসতভিটেয় তৈরি করেন দক্ষিণেশ্বরী কালী মন্দির, সেনপাড়ার সেনদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা মহল্লা কিনে নেন এবং নাম দেন যোগীপাড়া। এই কালীমাতা দশমহাবিদ্যার অন্যতমা এবং শনিদেবের আরাধ্যা। সত্যনাথের জীবন ছিল দুঃখ-যন্ত্রণায় ভরা। কিন্তু তবুও তিনি মাতৃ-আরাধনায় বিরত থাকতেন না। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন, এরপর থেকে নানাভাবে তাঁর জীবনে বিপর্যয়ের শেষ ছিল না।কন্যাসন্তানের অকালমৃত্যু, দোকান লুঠ হওয়া, দারিদ্র– নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে।এর মাঝেই কালীমাতার দৈব আদেশ পান। মাতার আদেশে তিনি হন একাধারে সাধক,পূজারী ও সেবাইত। ইংরেজি ১৯০৭ সালে তিনি মায়ের মন্দির ও নহবতখানা তৈরি করেন। এখনও মাতা এখানে নিত্যপূজা পেয়ে চলেছেন এবং মহাসমারোহে কালীপুজোর রাত্রে নিয়মবিধি মেনে পূজা সমাধা হয়।


বর্মনবাড়ির কালী: কালনার বর্ম্মনবাড়ির কালীপূজা প্রায় চারশো বছরের পুরনো।গভীর জঙ্গলের মাঝে এই মাতৃমূর্তিটি প্রয়াত সত্যচরণ বর্মন উদ্ধার করেন এবং মাতৃ-আরাধনা শুরু করেন। প্রত্যেক বছর পূর্বনিয়মানুযায়ী দুর্গাপূজার দশমীর দিন পাটা পুজো করা হয়। এরপর একমেটে, দোমেটে,খড়িমাটি ও রং– এই চার পর্বে মাতৃমূর্তির নির্মাণ চলে। সত্যচরন বর্মন ছিলেন বিত্তবান মানুষ, তাই মায়ের জন্য আসবাবপত্র ও স্বর্ণালংকারের কোনও খামতি রাখেননি। নিজের জীবদ্দশাতেই তিনি তাঁর দুই কন্যাকে পুজোর দায়িত্ব অর্পন করে যান। বংশানুক্রমিকভাবে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।মা এখানে শোলার সাজে ও স্বর্ণালংকারে ভূষিতা থাকেন। এই পুজোয় পাঁঠাবলির প্রচলন লক্ষ করা যায়।

সাধক কমলাকান্তের কালী: কালনার রীতিমতো প্রসিদ্ধ একটি স্থান হলো বিদ্যাবাগীশ পাড়ার সাধক কমলাকান্তের ভিটে। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই বিদ্যাবাগীশ পাড়াতেই জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী, বিদ্যান এবং বুদ্ধিমান ছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। ঈশ্বরমুখী সন্তানকে সংসারমুখী করে তোলার জন্য অল্প বয়সে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু মনপ্রাণ যার মায়ের পদপ্রান্তে নিবেদিত, সে কী করে সংসারী হবে!তিনি মহারাজা তেজশ্চন্দ্র বাহাদুরের গুরু ও সভাকবি ছিলেন। মহারাজের দান করা ভূমিটির ওপর এই মাতৃমন্দির বিরাজমান। বর্ধমানের বিশালাক্ষী মন্দিরে মহারাজের সঙ্গে কমলাকান্ত ভট্টাচার্যর সাক্ষাৎ ঘটে। শ্যামাসংগীতের অন্যতম কবি ছিলেন তিনি। শাক্ত পদাবলী ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কমলাকান্ত। কবি রামপ্রসাদ সেনের পরেই এঁর স্থান। তাঁর ধর্মচেতনা, তাঁর তন্ত্রসাধনা, তাঁর ভক্তিগীতি এবং বর্ধমানের রাজপরিবারে তাঁর প্রতিপত্তি তাঁকে ভারতের অন্যতম সাধকরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কালনার এই কৃতী সন্তান কালনাকে সুবিখ্যাত করে তুলেছেন। তাঁর লেখা অজস্র ভক্তিগীতির ভাণ্ডার রয়েছে। তাঁর লেখা ‘সদানন্দময়ী কালী’ ঘরে ঘরে সমাদৃত। কালনার এই কৃতী পুরুষ ১৮২১ সালে মাতৃচরণে ঠাঁই নেন।

যোগানন্দের কালীমাতা: স্বামী যোগানন্দ মুলত উত্তরপ্রদেশের মানুষ। ধর্মসাধনার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি কালনায় এসেছিলেন। আর ফিরে যাননি। ১৯২৪ সালে যোগানন্দ তাঁর মাতৃমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। যোগানন্দ যেখানে বাস করতেন, সেখানেই এই মন্দির স্থাপন করেন। তিনি নিজ বাসগৃহটিকে ‘ঝুপড়ি’ বলতেন। তাই তাঁর বাসভবনটি 'যোগানন্দের ঝুপড়ি' নামেই পরিচিত। তিনি কখনও কাউকে দীক্ষা দিতেন না, বলতেন মায়ের প্রতি ভালবাসা ও ভক্তিই হলো আসল দীক্ষা।

সিদ্ধান্ত কালীবাড়ি: বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদের আমলে, ১৭৪৪ থেকে ১৭৭১– এই সময়েই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। কালনার একটি সুবিখ্যাত কালীবাড়ি এটি, এখানে রয়েছে দেবীর পঞ্চমুন্ডির আসন। এই আসনে বসে অম্বরীশ মুনি না কমলাকান্ত ভট্টাচার্য– কে সিদ্ধিলাভ করেছেন, তা নিয়ে যথেষ্ট মতান্তর রয়েছে। কিন্তু নিঃসন্দেহে 'সিদ্ধিলাভ' থেকেই 'সিদ্ধান্ত কালীবাড়ি' নামকরণ হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী দেবীপুজোর সময় কোনও ঢাক বাজে না, দেবীর দৈবাদেশে ঢাক বাজানো নিষিদ্ধ।রামরাম তর্কসিদ্ধান্ত পরিবারের দ্বারা পূজিতা দেবী বর্তমানে ব্যানার্জি পরিবারের দ্বারা পূজিতা হন।

ভবার ভবানী: ভবা পাগলার আসল নাম ছিল ভবেন্দ্রমোহন। তিনি ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আসেন। বাংলাদেশ এবং ভারতে মোট সাতটি মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে পড়াশোনায় ইতি টানেন, কিন্তু অগাধ জ্ঞানভাণ্ডার ছিল তাঁর। কালনার পুরনো হাসপাতালের কাছে একটি জমি কিনে তিনি তাঁর মাতৃমন্দিরটি স্থাপন করেন। তিনি যেখানেই যেতেন, সঙ্গে করে কষ্টিপাথরে গড়া মায়ের মূর্তিটি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তিনি জাতপাত-ধর্মের বিভেদ মানতেন না। তাঁর বাণী ছিল, “মায়ের কাছে সবাই সমান, কিবা হিন্দু, কি মুসলমান।” তিনি বলতেন, “যারা ছোঁয়াছুঁয়ির ধার ধারে না, তারাই ভবার গৌরসুন্দর।” প্রসঙ্গত, বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আশ্রমে গেলেই মায়ের প্রসাদ হিসেবে 'লজেন্স' দেওয়া হয়। জনশ্রুতি আছে, মন্দিরের দরজা বন্ধ করে ভবাপাগলা তাঁর ভবানী মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন। ১৯৮৪ সালে মাতৃচরণে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেন।

কালনাকে যেমন বলা যায় মন্দির শহর, ঠিক তেমনই কালী-ক্ষেত্র কালনা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

[তথ্যসূত্র: কালনার জনশ্রুতি, ইউটিউব চ্যানেল ‘Memacts’ (অঙ্কিতা রায়চৌধুরী ও হিমাংশু দত্ত‌‌‌-কর্তৃক আলোচিত)]

More Articles