কখনও প্রলয়ঙ্করী, কখনও কল্যাণময়ী! বিভিন্ন রূপে পাল্টে যায় কালীর অবতার
Kali Mythology: তন্ত্র অনুসারে বিভিন্ন রূপে পূজিতা হন কালী। দেখে নেওয়া যাক সেসব রূপ।
ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজম্।
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং
মুণ্ডমালা বিভূবিতাম্।।
সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড্গাবামাধোদ্ধক রাম্বুজাম্।
অভয়াং বরদাঞ্চৈব দক্ষিণোর্দ্ধ করাম্বুজাম্।
দেবী ভুবনেশ্বরীদেবী আদ্যাশক্তি অনন্ত ব্রহ্মরই শক্তিস্বরূপা। রসত্রসূক্তে দেবী ভুবনেশ্বরী রাত্রিদেবী-কৃষ্ণা-ভয়ংকরী কালী। এই কালীই মহাভারতে বর্ণিত হয়েছেন— লোলজিহ্বা, বক্রনয়না, ভয়ংকরী, শত্রুমর্দিনী মহাদেবী কালীরূপে। পুরাণ অনুযায়ী কথিত আছে, সতী তাঁর পিতা দক্ষরাজের যজ্ঞে আমন্ত্রণ না পেয়ে উতলা হয়ে ওঠেন যজ্ঞস্থলে যাওয়ার জন্য। শিবের কাছে সতী অনুমতি প্রার্থনা করেন— শিব বিনা আমন্ত্রণে যজ্ঞস্থলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। তখন অনন্যোপায় সতী দশটি ভয়ংকরী মূর্তিতে শিবের সামনে উপস্থিত হলে শিব তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দেন। এই দশটি মূর্তি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিতা। এই দশটি মূর্তি হলো— কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। তবে দশমহাবিদ্যার এই দশটি রূপের মধ্যে কালী, তারা, ষোড়শী, বগলা মূর্তি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। সাধনক্ষেত্রে কালীরূপ সবার ওপরে।
শাক্ত (শক্তির উপাসক) মতে, কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন। তন্ত্র অনুসারে বিভিন্ন রূপে পূজিতা হন কালী। এক বিশেষ তন্ত্রমতে, মা কালী অষ্টধা, অর্থাৎ তাঁর আটটি রূপ আছে, যেগুলি হলো দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডা, শ্মশানকালী এবং শ্রীকালী। কালীর প্রসিদ্ধ রূপগুলি হলো-
আরও পড়ুন: পছন্দ ছিল না কালীর রুদ্ররূপ, রামকৃষ্ণকেও সহজভাবে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ
মা দক্ষিণাকালী
কালীর সবথেকে প্রসিদ্ধ ও জাগ্রত রূপ মনে করা হয় দক্ষিণাকালীর এই রূপকে। তাঁর এই নামের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রে বলা হয়েছে, দক্ষিণ দিকের অধিপতি যমরাজ (যিনি জীবন হনন করেন) কালীর এই রূপের ভয়ে পালিয়ে যান। এই কালীর গলায় ঝোলে মুণ্ডমালার হার, তিনিই মুণ্ডমালা বিভূষিতা।
ত্রিনয়নী দক্ষিণাকালীর বামদিকের দুই হাতে তিনি ধরে থাকেন সদ্যকাটা নরমস্তক। দুই ডানহাতের একটিতে তিনি ভক্তদের বর দেন এবং অপরটিতে অভয়। তাঁর ডান পা মহাদেবের বক্ষে স্থাপিত থাকে। তিনিই রামপ্রসাদের “কালো রূপে দিগম্বরী শ্যামা মা”।
রক্ষাকালী
রক্ষাকালী দক্ষিণাকালীর একটি নাগরিক রূপ। প্রাচীনকালে নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য এই দেবীর পূজা করা হতো। এই দেবীর পূজা-মন্ত্র ভিন্ন এবং এই দেবীর বাহন স্থানভেদে সিংহ।
কাম্যকালী
আমাদের বিশেষ কামনায় বা বিশেষ প্রার্থনায় যে কালীপুজো আয়োজন করা হয়, তাকেই কাম্যকালী পূজা বলা হয়, পূজা-বিধি দক্ষিণাকালীর মতোই। সাধারণত অষ্টমী, চতুর্দ্দশী অমাবস্যা পূর্ণিমা ও সংক্রান্তিকে পর্বদিন বলে। পর্বসমূহের মধ্যে অমাবস্যাকে বলা হয় মহাপর্ব। বিশেষ কামনায় এই সকল তিথিতে যে পূজা করা হয় তাকেই কাম্যকালী পুজা বলা হয়।
গুহ্যকালী
শাস্ত্রে কালীর এই রূপকে ভয়ংকরী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি সাধকদের আরাধ্যা। দ্বিভূজা এই দেবীর গায়ের রং কালো মেঘের মতো গাঢ় এবং লোলজিহ্বা। এই দেবীর গলায় ৫০টি নরমুণ্ডর হার এবং কানে শবদেহের আকারের অলংকার এবং কোমরে ছোট কাপড়।
মহাকালী
কালীর এই রূপের দু’টি মত আছে, যার একটি (তন্ত্রসার গ্রন্থমতে) অনুসারে এই রূপের ৫টি মুখ এবং ১৫ টি চোখ আছে। শ্রী শ্রী চণ্ডীমতে, আদ্যাশক্তির ১০ মুখ, হাত, পা এবং ৩০০ চোখ আছে। শাস্ত্রমতে, কালী এই রূপে সাধনার পূর্বে ভক্তকে ভয় দেখান কিন্তু সেই ভয়কে জয় করে যদি ভক্তসাধনায় ভরসা রাখতে পারেন, তবে কালী তাঁকে সৌভাগ্য, রূপ এবং শ্রী প্রদান করেন।
ভদ্রকালী
'ভদ্র' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কল্যাণ হিসেবে এবং কালী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে জীবনের শেষ সময় বোঝাতে। কালী এইরূপে ভক্তদের মরণকালে কল্যাণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে দুর্গা ও সরস্বতীর ওপর নাম হিসেবেই এই নামটি ব্যবহৃত হয়।
কালিকাপুরাণ অনুসারে তাঁর গায়ের রং অতসী ফুলের মতো এবং তাঁর কপালে অর্ধচন্দ্র বিরাজ করে এবং তাঁর মাথায় থাকে জটা। তিনি গলায় পড়ে থাকেন কণ্ঠহার। তবে তন্ত্রমতে তাঁর রূপের ব্যাখ্যা আলাদা। তন্ত্রমতে, ভদ্রকালী কৃষ্ণবর্ণা, কটরাক্ষী এবং মুক্তকেশী। এই মত অনুসারে ভদ্রকালীর হাতে থাকে আগুনের শিখা।
চামুণ্ডা কালী বা চামুণ্ডা
ভাগবত পুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুর বধের উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার ভ্রুকুটি থেকে এই দেবীর সৃষ্টি হয়। ভাগবত পুরাণ অনুসারে এই দেবী ব্যাঘ্র চর্ম পরে থাকেন এবং দেবী অস্থিচর্মসার। দেবীর দন্ত বিকট। চণ্ডীপুরাণ অনুসারে দেবী চণ্ডীর ৮ রকম ব্যাখ্যা এবং মন্ত্র আছে।
শ্রী কালী
অনেকে মনে করেন, এই রূপে দেবী দারুক নামে অসুরের বধ করেছিলেন। এই দেবীর রূপ নিয়ে কথিত আছে, তিনি মহাদেবের কণ্ঠে প্রবেশ করে তাঁর কণ্ঠের বিষে কৃষ্ণবর্ণা হন এবং পরবর্তীকালে মহাদেব শিশুরূপে তাঁর স্তন্যপান করে দেবীর শরীর থেকে বিষ গ্রহণ করেন।
ফলহারিণী কালী
গৃহধর্মকে সুন্দর করতে এই দেবীর আবির্ভাব, নামে ফলহারিণী হলেও অভিষ্ট সিদ্ধদায়িনী, জানা যায়, রামপ্রসাদ নিজ স্ত্রী-কে দেবীরূপে পূজা করে নারীজাতির সম্মানের জন্য এর ফল উৎসর্গ করেন। এটিও বাৎসরিক একটি পুজো।
শ্মশানকালী
এই দেবীকে শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করা হয়। শ্মশানকালী দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো। তিনি সর্বদা বাস করেন। তাঁর চোখদু'টি রক্ত-পিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি শুকনো ও ভয়ংকর। বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে নরমুণ্ড। শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তাঁর বাঁ-পা শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়্গ। এই রূপটিও ভয়ংকর রূপ। তন্ত্রসাধকরা মনে করেন, শ্মশানে শ্মশানকালীর পুজো করলে শীঘ্র সিদ্ধ হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসর স্ত্রী সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে শ্মশানকালীর পুজো করেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, শ্মশানকালীর ছবিও গৃহস্থের বাড়িতে রাখা উচিত নয়।
সিদ্ধকালী
সিদ্ধকালী কালীর একটি অখ্যাত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পুজো হয় না, তিনি মূলত সিদ্ধ-সাধকদের ধ্যান-আরাধ্যা। কালীতন্ত্র-তে তাঁকে দ্বিভূজারূপে কল্পনা করা হয়েছে। অন্যত্র তিনি ব্রহ্মরূপা ভুবনেশ্বরী। তাঁর মূর্তিটি দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃতরসে প্লাবিত হয়ে বামহস্তে ধৃত একটি কপালপাত্রে সেই অমৃত ধারণ করে পরমানন্দে পানরতা। তিনি সালংকারা। তাঁর বামপদ শিবের বুকে সংস্থাপিত।
‘মহাকাল সংহিতা’-য় দেবী কালিকার নয়টি রূপের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার অভিনবগুপ্তর ‘তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার’ গ্রন্থে দেবীর ১৩টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি হলো— সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নি রুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী। এছাড়াও কালীর আরও আরও যেসব রূপের সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলি হলো— ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সন্তার্নকালী।
‘কাল’ অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী বলেই দেবীর নাম ‘কালী’। তিনি শিব বা শব, অর্থাৎ মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে জীবনের প্রতীক। তিনিই রুদ্র, সূর্য, বসু, আদিত্য, বরুণ, ইন্দ্রাদি সকল দেবতার দ্বারা পূজিতা। তিনিই চেতনার প্রকাশ।